বাড়ি থেকে মায়ের ফোন, বাবা তুমি কোথায়? আমি সদরঘাট লঞ্চে আছি। ও পাশ থেকে মা বললেন, বাবা ঠিকঠাক মতো এসো, আমি জ্বি আচ্ছা বলে লাইন কেটে দিলাম। লঞ্চ হাউজ ফুল।কেবিন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।সমস্যা নাই আমি সিঙ্গেল ও একা আছি। লঞ্চে ডেকের মধ্যে বিছনা পেতে যেতে পারব। লঞ্চ উঠলে মানুষের ক্লাসিফিকেশন বুঝা যায়। প্রথম শ্রেণি- কেবিন, তৃতীয় শ্রেণি স্টাফ কেবিন, তৃতীয় শ্রেণি চেয়ার কোচ, চতুর্থ শ্রেণি ডেকে বিছানা ইত্যাদি। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ডেকের মধ্যে কোন যায়গা নেই। বাধ্য হয়ে ছাঁদে উঠলাম। ছাদও মানুষ দখল করে ফেলেছে। ছাদের পিছনের দিকে একটু যায়গা খালি আছে যেখান দিয়ে মেশিনের ধূয়া বের হয়। বাধ্য হয়ে সেখানে বিছানা করলাম। মেশিনের আওয়াজে একটু সমস্যা হলেও হাল্কা শীতে ধূয়া বের হওয়ার চিমনির গরম অতিরিক্ত কাজে আসবে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চ ছেড়ে দিবে। এমন সময় অনুর্ধ পঞ্চাশ বছরের একজন ভদ্রলোক একজন মহিলা সাথে করে দুটি বাচ্ছা সহ ছাদে উঠলেন। এদিক ও দিক কোথাও যায়গা খুঁজে না পেয়ে আমার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে বললেন, বাবা একটু যায়গা ছেড়ে দিন আমরা বিছানা করব। আমি বললাম, সিউর, আবশ্যই আপনি বিছানা করবেন।
লোকটি বিছানা করলো। মহিলা হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বাচ্চা দুটি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। বৃদ্ধ লোকটি বিছানার চাঁদর যথা সম্ভব চারিদিকে টেনে প্রসারিত করতে লাগলেন। মহিলা বিছানায় রাখা ব্যাগের মধ্যে মাথা দিয়ে জড়োসরো হয়ে আধা বসা অবস্থায় শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণপর পুরুষ মানুষটি বিছানার এক কোণে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে উউটিউবে পুরানো দিনের বাংলা গান দেখতে লাগলাম।
কিছুক্ষণপর মহিলার সাথে করে আসা আনুমানিক পাঁচ ছয় বছরের খুকিটি ( বাচ্ছা মেয়েটি) আমার কাছে এসে বসল। আমার সাথে মোবাইলের স্কিনে চোখ মেলে ধরল। কিন্তু মোবাইলে সাদাকালো জমানার বাংলা গান তার পছন্দ না, তার চোখে বিরুক্তি ফুটে উঠেছে।আমি বললাম- কার্টুন দেখবা? সে মাথা নাড়াল। এতক্ষণে মেয়েটির মায়ের হুশ ফিরে এলো। আমাকে বলল- ভাই কিছু মনে করবেন না, বাচ্চা মানুষ, অতিরিক্ত মোবাইলের নেশা। বলা শেষ হলে মহিলাটি কিছুটা বিরুক্তি নিয়ে মেয়েকে কাছে ডাকল। মেয়ে মাথা নেড়ে অপরাগতা প্রকাশ করল। মাঝখান থেকে আমি বললাম, সমস্যা নেই আপা। আমার মোবাইল শিশু বান্ধব, মোবাইলে তেমন কিছু নেই, বাড়িতে আমার মেয়ে ও ছেলের প্রিয় খেলনা হলো মোবাইল।
আমি বাচ্ছা মেয়েটির হাতে মোবাইল ধরিয়ে নিচতলায় ক্যান্টিনে এসে সিগারেট ধরালাম। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিগারেট টানছি। বুড়ি গঙ্গার কালো বিষাক্ত পানির ঘ্রাণ নাকে এসে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে। রাতের বাতাসটা শরীলে মেখে নিচ্ছি নিজেকে রিফ্রেস ও পিউরিফাই করার জন্য। সিগারেট খাওয়া শেষ হলে আবার বিছানায় ফিরে আসলাম। বাচ্চা মেয়েটি মোবাইলে কার্টুন দেখছে। মুরুব্বি লোকটি হাতে তসবি নিয়ে মুখে বিরবির করে আঙ্গুল চালাচ্ছে।মহিলাটি এতোক্ষণে ঘুমের মধ্যে চলে গেছে। আমি বিছানায় বসে সাংসারিক নানা হিসাব মিলাচ্ছি- ঘর ভাড়া দশ, মা-বাবার জন্য ছয়, সাংসারের আনুষঙ্গিক দশ, বাবুর ডায়াপার আর দুধের জন্য দুই, নিজের জন্য মাত্র তিন হাজার….. বাকিটা ইতিহাস। কিছুক্ষণপর মুরুব্বি লোকটি আমার সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করলেন। নিজের পরিচয় দিলেন.. মেজর জেনারেল (অবঃ) হাফিজ ইসলাম, বংশগত পদবী, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম থাক চাচা এতো কিছু বলা লাগবেনা, আমার আর আপনার জেলা এক কিন্তু উপজেলা ভিন্ন, আমরা সবাই একই এলাকার মানুষ। এবার আমার পরিচয় দেই, মোঃ আবির হোসাইন, প্রাইভেট চাকুরিজীবী, পিতা, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা আংকেল, সাথের মহিলাটি আপনার কি হয়? আমার প্রশ্ন শুনে আংকেল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিছুটা থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন, আমার শ্যালকের সাবেক সহধর্মিণী। ‘সাবেক সহধর্মিণী’ বলাতে আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম, মনে মনে কিছুটা কৌতূহলও জাগল। আমার আবার কিছুতে কৌতূহল জাগলে সেটা না মিটা পর্যন্ত আত্মা শান্তি পায়না। আপাতত মনে হচ্ছে আংকেল সহজে ‘সাবেক স্ত্রী’ কথাটার রহস্যের জট খুলবেন না। আংকেলের সাথে আরো ভাব জমাতে হবে।তাই আংকেল কে ফিলোসফি চোখ দিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম, অতঃপর আংকেল কে বললাম,
-ডোন্ড মাইন্ড, স্মোক করেন? আংকেল আমার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খাইলেন, তারপর বললেন,
- তোমরা এই যুগের পোলাপান যা হইছো! আমরা তো এই বয়সে মুরুব্বিদের সাথে কথা বলতেই সাহস পেতাম না। যা হউক, আর্মি লাইফে নিয়মিত স্মোক করতাম। অবসরের পর হজ্জ্ব করে সিগারেট খাওয়া এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হলো কেউ অফার করলে না করতে পারিন।তাছাড়া তোমার মত এই বয়সে আমাকে কেউ কখনো সিগারেট খেতে অফার করেনি।
--দু:খিত, বেয়াদবি মাফ করবেন।
-ঠিক আছে বাবা, মাফ পরে করা যাবে, এখন না হয় সিগারেট আর লাইটারটা দাও।
আমি আংকেল কে সিগারেট আর লাইটারটার বের করে দিলাম। আংকেল পুরাপুরি অভিজ্ঞতার ছাঁপ রেখে সিগারেট ধরালেন, অতপর ইহা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে টানছেন, ধোঁয়া আমি আংকেল কে দেখে নিজেকে ঝালাই করে নিলাম। আংকেলের সিগারেট টানা শেষ হলে তার সাথে পুনরায় আলাপ জমালাম। আংকেল তার ছাত্র জীবনের, সৈনিক জীবনের এমনকি শান্তিরক্ষী মিশনের কথা দিল খোলাভাব বললেন। কিন্তু ‘আমার শ্যালকের সাবেক সহধর্মিণী’ কথাটির দিকে একটুও হাত বাড়ালেন না। অবশেষে আমি তাকে এই সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আংকেল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রচনা স্টাইলে বলা শুরু করলেন, ঘটনার ভূমিকা দিলেন-
বিএ-৯৯৯১ মেজর এম এম আশিক, ইঞ্জিনিয়ার্স মিরপুর স্টাফ কলেজে চলমান স্টাফ কোর্সে অধ্যায়নরত অফিসার। সম্পর্কে তিনি আমার আপন শ্যালক। বিগত ১৯৮৫ সন হতে তাকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে সেনাবাহিনীতে গোগদান নিশ্চিতসহ চাকুরীকালীন তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার বিষয়টি আমার স্ত্রী এবং আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতাম। ২০০৬/২০০৭ লাইবেরিয়াতে শান্তিরক্ষী মিশনেও আমি তার সাথে ছিলাম। দেশে ফিরে ২০০৭ এর ১০ ডিসেম্বর মেজর আশিকের কন্যা বাছাইসহ বিবাহের যাবতীয় কার্যাবলী আমরা সম্পাদন করি। তার এবং তার পিতা/ভাই বোনে পছন্দে বিবাহ হয় (মা মৃত)। সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত শৃংখলা বিষয়ে আমার বা আমাদের কারও কোনরূপ পর্যবেক্ষণ ছিলো না। স্টাফ কলেজে প্রস্তুতি কালীন তার স্ত্রী (রোজা) সহ আমরা সকলে উৎসাহিত করি এবং সে স্বীয় যোগ্যতায় স্টাফ কলেজে অধ্যায়নের সুযোগ পায় এবং এ দ্বারা আমরা সকলে আনন্দিত ও আশান্বিত হই।
আংকেলের ভূমিকা শুনে আমি ঘটনার বিস্তারিত জানতে আরো অতিউৎসাহী হয়ে উঠি। বুঝতে পারি ঘটনার গভীরতা আছে। তাই আংকেল কে মেজর এম এম আশিকের পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আংকেল পুনরায় বলতে লাগলেন,
মেজর এম এম আশিক এর বাবা/মা বর্তমানে উভয়ে মৃত। ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সে সর্ব কণিষ্ঠ। আমার স্ত্রী সর্ব জৈষ্ঠ। বিবাহ পরবর্তী সে তার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, স্ত্রী এবং ০২ জন সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) পায়। তার শ্বশুড় দীর্ঘদিন টেক্সটাইল মিলে সহ ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকুরী করে বর্তমানে অবসরে আছেন। বয়স ৭০ উর্দ্ধে। শাশুড়ী অসুস্থ-হুইল চেয়ারে চলাচল করেন। স্ত্রীর বড় ০২ ভাই। বড়জন মোঃ নয়ন, ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়ামে আইটি প্রশিক্ষক এবং ২য় ভাই জনি একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে উচ্চ পর্যায়ে চাকুরীরত। বাড্ডায় তাদের বাসা। মেজর আশিফের বিয়ের ২/৩ বছর পর তার বড় সম্বন্ধি নয়ন বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম ঐশী, আজিমপুর গোরস্থান নিকটস্থ তাদের বাসা, ঐশীর বাবা জাফর কাওয়ালী একজন বিশিষ্ট কাউয়ালি সংগীত শিল্পী। মাঝে মধ্যে তাকে বিটিভিতে অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। এছাড়া তাকে মিডিয়াতেও বিভিন্ন সামাজিক কাজ কর্ম করতে দেখা যায়। মেজো ভাই (জনি) মেজর আশিফের বিয়ের ২/৩ বছর আগে বিয়ে করেন। মেজর আশিফের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি এবং সম্বন্ধী ও অন্যান্ন আত্মীয় স্বজন অত্যন্ত আন্তরিক এবং সামাজিক, যা প্রশংসা যোগ্য। একমাত্র জামাই হিসেবে তারা সকলেই মেজর আশিফের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তার স্ত্রী রোজ অত্যন্ত সহজ, সরল এবং নামাজি ও স্বামী ভক্ত পরেজগার নারী। গাড়ী/ফ্ল্যাট হতে শুরু করে মেজর আশিফের চাওয়া/না চাওয়া হিসাব না করে তারা উজার করে সম্প্রদান করে এসেছেন। ইতিমধ্যে মেজর আশিফের এক ছেলে এক মেয়ে এবং তার সম্বন্ধী জনির ও ২টি ছেলেমেয়ে রয়েছে। যাদের বর্তমান বয়স ২-৬ বছরের মধ্যে।
আংকেল এটুকু বলে কিছুক্ষণ থেকে রইলেন। পকেটে হাত ঢুকালেন। হয়ত সিগারেট খুঁজছেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আংকেল সিগারেট ধরাবেন? মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক জবাব দিলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম তারপর কি হয়েছে আংকেল? আংকেল উত্তর দিলেন, ঘটনার পট পরিবর্তণ। আমি বললাম তাহলে পটপরিবর্তন একটু বলুন না। আংকেল বলতে লাগলেন-
সবকিছুই অত্যন্ত চমৎকার ভাবে চলছিলো। সেপ্টেম্বর, ২০১5 তে স্টাফ কলেজ প্রবেশী পরীক্ষা কাপ্তাই হতে এসে বেশ ভাল দেবার পর হঠাৎ মেজর আশিকের সাথে তার সম্বন্ধী রনির স্ত্রীর সখ্যতা গড়ে উঠে। প্রাথমিকভাবে তার সহজ-সরল স্ত্রী (রোজা) বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয় নাই। পরবর্তীতে অক্টোবর ২০১৭ তে তারা স্বপরিবারে ঢাকা এসে আজিমপুরে মেজর আশিকের সম্বন্ধীর শ্বশুড় জাফর কাওয়ালীর বাড়ীতে ৫/৭ দিন থাকেন। ৫ তলা ভবনের ৫ম তলায় আশিকরা ও তার সম্বন্ধী রনি দম্পতি এবং ২য় তলায় সম্বন্ধীর স্ত্রী ঐশী এর বাবা/মা থাকতেন। বড় সম্বন্ধী রনি যখন স্কুলে অবস্থান করতেন তখন ৫ম তলায় ও ছাঁদে প্রায়শই দিনে ঐশী এবং মেজর আশিক একাকী গল্প গুজবে মশগুল থাকতন। আশিক ও ঔশীর মধ্যে সখ্যতা হতে ক্রমান্বয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিষয়টি গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়, যা পাশ্ববর্তী ভবনে ঐশীর বিদেশ হতে আগত চাচার দৃষ্টি গোচর হয়। বিষয়টি তিনি কৌশলে মেজর আশিকের স্ত্রী রোজা কে জানান। রোজা ২/১ দিন পর স্বামী বাচ্চা সহ বাড্ডা বাবার বাড়ীতে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে কাপ্তাই স্বামীর চাকুরী স্থলে গমণ করেন।
এটুকু বলে আংকেল জোড়ে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমি বললাম তাপর পর কি হলো আংকেল?
চলবে----------
.............................
বি.দ্রঃ চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
স্কেচঃ শাহাদাৎ হোসাইন।
উৎসর্রগঃ ব্লগার কানিজ রিনা আপা এবং শ্রদ্দেয় ব্লগার খায়রুল আহসান স্যার।
অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমা যোগ্য।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯:২৬