তুরস্কে রুশ রাষ্ট্রদূতকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাজধানী আংকারায় এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়েছিলেন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কার্লভ। সেখানে সোমবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক ও অতিথিদের সামনে তাকে হত্যা করা হয়।
আঙ্কারায় `তুর্কিদের চোখে রাশিয়া` (রাশিয়া অ্যাজ সিন বাই তার্কস) শীর্ষক এক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বন্দুকধারী। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, গুলি করার পর অস্ত্রধারী তুর্কি ভাষায় চিৎকার করে বলছিলেন- “আলেপ্পোর কথা মনে রেখ, সিরিয়ার কথা মনে রেখ।”
এ থেকে কি বুঝলাম?
১। বর্তমান বিশ্ব এখন বড়ই অদ্ভুত সময় পার করছে। আমেরিকান মাস্টার মাইন্ড এখন আগের মত কাজ করে না। তারাও তুরুপে ভুল করে। আর তাদের ভুল বিশ্বে নতুন পরিবর্তন সূচিত হয় আর সাথে কিছু মানুষের চোখের পানিও ঝড়ে। আমরিকা এযুগে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে তুরস্কে সেনা অভুথ্যানের ষড়যন্ত্র করে। তুরস্ক মনে করে অভুথ্যানের সময়-ছিনতাই হওয়া সাঁজোয়া বিমানগুলোতে জ্বালানি ভরা হয়েছিল ইনসিরলিক থেকেই। সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দক্ষিণের আদানা প্রদেশের ইনসিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে দিয়েছিল তুরস্ক।
বাস্তবে ক্যুতে ব্যবহৃত দুটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তুরস্কের মার্কিন সেনাঘাঁটি থেকেই উড়েছিল। এবং আকাশে তাদের জ্বালানি সরবরাহ করেছিল ওই ঘাঁটিরই আরও দুটি বিমান। শুধু তা-ই নয়, এফ-১৬ দুটির একটি চালাচ্ছিলেন রুশ বিমান ভূপাতিত করা সেই পাইলট। তুরস্কের অভিযোগ, মার্কিন ওই সামরিক ঘাঁটির উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগব্যবস্থা দিয়েই অভ্যুত্থানকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতেন।
ওবামার ওপর এরদোয়ানের ক্ষোভের কারণ যথেষ্ট। ওবামা প্রশাসনই একেপি সরকারকে সিরিয়ায় টেনে নিয়েছে বাশারকে উচ্ছেদের নিশ্চয়তা দিয়ে। সিআইএ–প্রধান ডেভিড পেট্রাউস কয়েকবার তুরস্ক সফর করে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের চাপ দেন। কিন্তু বাশার টিকে থাকছেন রুশ সহযোগিতায় কিন্তু তুরস্ক একদিকে কুর্দি বিদ্রোহী অন্যদিকে সিরীয় উদ্বাস্তুর ভার আর জঙ্গি হামলায় বিপর্যস্ত। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে স্বাধীন কুর্দিস্তানের হুমকি। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক সিরিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘাট বাধা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
তবে সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাদের যোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কের শ্রমমন্ত্রী সুলেমান সায়লু রোববরাই অভিযোগ করেছিলেন, সেনা অভ্যুত্থানে মদত দিয়েছে আমেরিকা। এরদোয়ান সরাসরি অভিযোগের তীর ছুড়ে ছিলেন মার্কিন মগের মুল্লুকে নির্বাসিত ফেতুল্লা গুলেন কে।
ঘটনা চমৎকার এবং অদ্ভুত। তুরস্কে জিতল এরদোয়ান কিন্তু আনন্দের বাজি ফুটল রাশিয়ায়। পুতিনের মতো খুশি সিরিয়ার বাশারও। দূর থেকে সন্তোষ প্রকাশ করছে ইরান।
আমেরিকার সেই ষড়যন্ত্র ভন্ডুল হয়েছে। ফলে আমেরিকার দীর্ঘদিনের মিত্র তুরস্ক লেজের উল্টো পিঠ দেখিয়ে পুরানো শত্রু রাশিয়ার সাথে একজোট হয়ে সিরিয়ায় আদাজল খেয়ে আমেরিকান সাহায্যপুষ্ট বিদ্রোহীদের কোনঠাসা করে আলেপ্প পুর্নদখল করেছে। ফলে মধ্য প্রাচ্যের আমেরিকান শক্তি আর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন অস্ত্রের ব্যবসা আর লাখো লাখো তেলের ব্যারেল এখন উল্টো দিকে মুখ করবে। আরবের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো এখন বুঝে গেছে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করলে তাদের ক্ষমতা, সার্ভবৌমত্ব রক্ষা পাবে। যেমনটা করেছেন আসাদের প্রয়াত বাবা।
রাশিয়ার পুতিন আসলেই একটা চিজ! তিনি মিখাইল গর্বাচেভ এর মত গর্দভ নয়। তিনি বিদ্রোহীদের কে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর্যন্ত সময় দিলেন না, বিদ্রোহীরা আসা করছিল ভীতু বারিক্কা ক্ষমতা থেকে গেলে ট্রাম্প এসে তাদের উদ্ধার করবেন! হয়ত ট্রাম্প এ্যাডভেঞ্জার হিসেবে সিরিয়ায় যুদ্ধে জড়াতে চাইলেও জড়াতে পারতেন। যেটা বারেক ওবামা দ্বারা সম্ভব নয়। সেটি উপলদ্ধি করে পুতিন বিমান হামলার পরিমান আগের থেকে বাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। ফলে বাসার সহজে জিতে গেছেন।
এবারও চমক এবং অদ্ভুত। সিরিয়ায় জিতল বাশার কিন্তু আনন্দের বাজি ফুটল রাশিয়ায়। পুতিনের মতো খুশি সিরিয়ার বাশারও, সে এখন মধ্য প্রাচ্যের হট ফেবারিত। ঈসরায়েল জন্য দু:শ্চিন্তার কারণ। আর দূর থেকে সন্তোষ প্রকাশ করছে ইরান, সেখানে ঘরে ঘরে আনন্দ চলছে।
বিশ্বে এখন নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে তা হল রাশিয়ার জাড় আর তুরুস্কের সুলতান দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে একবাহুতে আবদ্ধ হয়েছে। তবে, একথা মনে রাখতে হবে আগেরকার তুরুস্কের সুলতানগণ বিশেষ করে (সুলতান সালাহ্ উদ্দিন আয়ূবী) ছিল ইউরোপমুখী কিন্তু বর্তমান সুলতান এরদোয়ান এশিয়ামুখী। এটা বিশ্ব মোড়লদের ভাবিয়ে তুলছে। তুরস্ক চাইছে মধ্য প্রাচ্যে খেলোয়ার হতে, রাশিয়ার চায় তার হারানো শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরে পেতে এলক্ষ্যে তারা জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, ইউক্রেনে আক্রমণ করে সফল।
আমেরিকা এখন মার খাচ্ছে। আমেরিকান অনুগত্য ভূত্যদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাংলাদেশের জামায়াতি থেকে শুরু করে সিরিয়া, জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, ইউক্রেন সবখানে তাদের অস্তিত্ব সম্মুখীন। এটা ভূইফোঁড় রাষ্ট ঈসরায়েল জন্য মাথা ব্যাথা।
কারণ সিরিয়া, লেবানিজ হিজবুল্লা আর ইরান এখন ফ্রন্ট লাইনে। তুরুস্কের সুলতানের আর্বিভাব আরবের সুন্নিদের সাহস জোগাবে। সামনে দিনে ফিলিস্তিন নিয়ে খেলতে খেলে সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ ইসরাইলী প্রভু আমেরিকার শক্তি দিন দিন খর্ব হচ্ছে।
২।
একসময় বলা হতো, কনস্টান্টিনোপলে যাঁর দখল থাকবে, তিনিই হবেন মধ্য এশিয়ার শাসক। পনেরো শতকে সুলতান মেহমেত কনস্টান্টিনোপল দখল করে যে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত করেন, আজকের এরদোয়ান তারই ধারাবাহিকতা। সেই কনস্টান্টিনোপলই এখনকার ইস্তাম্বুল এবং এখান থেকেই উসমানিয়া সুলতানেরা বিরাট সাম্রাজ্য চালাতেন। তুরস্কের সুবিধা হলো তা ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যকার সেতু। যুক্তরাষ্ট্রের তুরস্ককে দরকার কয়েকটি কারণে:
ক. কাতার থেকে ইউরোপ পর্যন্ত জ্বালানির পাইপলাইন টানতে এবং
খ. কৃষ্ণসাগরে (এবং ভূমধ্যসাগর) ন্যাটোর স্থায়ী নৌঘাঁটি বসিয়ে ওই সমুদ্রে রাশিয়ার ঐতিহাসিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে। এটা দিতে পারে তুরস্ক। ১৯৩৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে, কৃষ্ণসাগর তীরের দেশ ছাড়া অন্য কারও স্থায়ী অবস্থান সেখানে নিষিদ্ধ। ওই চুক্তি বসফরাস প্রণালি ও দারদানেলেস প্রণালির নিয়ন্ত্রণ
এদিকে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলেও চীন বনাম পাশ্চাত্য শক্তির উত্তেজনা বাড়ছে।
যুদ্ধ ও রাজনীতি মতবাদ, আদর্শ বা ধর্ম দিয়ে হয় না। তা হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বার্থের মিল বা অমিলের ভিত্তিতে। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়া, চীন ও ইরানের স্বার্থ মিলে, এরদোয়ান আরও শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক খেলায় ঢুকছেন, বাশার তার হারিয়ে যেতে থাকা সাম্রাজ্য পেয়েছেন। দেশে-বিদেশি নতুন মিত্রও পাবেন। কিন্তু এরদুয়ান অভ্যুত্থানপন্থীদের যে কঠোরতা দেখিয়েছেন তা ইতিহাস ক্ষমা করবে না। বাসারের সিরিয়াতেও বিদ্রোহীদের জন্য কোন সু-খবর নেই। আর আমেরিকা তাদের অনুগত্যেদের সুখবর দেয়ার যোগ্যতা ইতিমধ্যে হারিয়েছেন।
পরিশেষে,
শুরু করেছিলাম তুরুস্কে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত হত্যা নিয়ে। আমরা চাই এই হ্ত্যার তদন্ত করে দোষিদের শাস্তি দেয়া হউক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৯