আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে কয়েকটা কথা বলি।
ভালো নেতৃত্ব ছাড়া একটা দল কোন রকমে টিকে থাকলেও জয়ী হতে পারে না। গত ১৬ বছরে বিএনপি, জামাত টিকে থাকলেও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। মূল কারণ নেতৃত্বের সঙ্কট। কয়েকদিন আগের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতা প্রায় ১,০০০ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে দেশের জন্য। এছাড়া প্রায় ১০,০০০ ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে। এই ত্যাগের বিনিময়ে হাসিনার পতন হয়েছে এবং নতুন একটা সরকার পেয়েছি আমরা। বিএনপিতে নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন মেধাবী নেতা নেই। সাংগঠনিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে জামাতের অবস্থা বিএনপির চেয়ে ভালো। কিন্তু জামাতের গায়ে অতীতের কালিমা এখনও আছে এবং তাদের জনসমর্থন সীমিত। এই ছাত্র আন্দোলন না হলে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যেত আগামী কয়েক বছরের মধ্যে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দলের হাল না ধরলে আওয়ামী লীগের অবস্থা হয়তো মুসলিম লীগের মত হত। ১৯৭৫ সালের পরে আওয়ামী লীগের একটা সুবিধা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যা জাতির হৃদয়ে রেখাপাত করেছিল। জনগণের এই আবেগকে আওয়ামী লীগ সফলভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। এছাড়া ১৯৭৫ সালের আগে তারা মাত্র সাড়ে তিন বছর শাসন করেছে যখন দেশটা ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত। কিন্তু এই বারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে যে নির্যাতন, দুর্নীতি, হত্যা, গুম, লুটপাট করেছে সেটা তার বাবার সময়ের চেয়েও ভয়াবহ ছিল। আরেকটা ব্যাপার হল এই আন্দোলনে শেখ হাসিনা নিহত হননি বা গ্রেফতার হননি। বরং তিনি নিরাপদে ভারতে আছেন এবং তার মাতাল ছেলে প্রায়ই উস্কানিমুলক কথা বলে বেড়াচ্ছে। তাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে মানুষের যে আবেগ বঙ্গবন্ধুর প্রতি তৈরি হয়েছিল ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার প্রতি সেই মাত্রার আবেগ তৈরি হবে না। রোকেয়া প্রাচীর মত কিছু দলকানা মানুষ ছাড়া আওয়ামীলীগের নেতাদের জন্য কান্না আর কেউ করবে না।
ভালো নেতৃত্ব ছাড়া যে কোন দল ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ব প্রাচীন দল কংগ্রেসের সেই দাপট এখন নাই। বরং। অবস্থা করুণই বলা যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরিতে নেতৃত্ব দেয়া মুসলিমলীগের আজকে কোন অস্তিত্ব নেই। এই দুই দলের ক্ষেত্রেই মূল সমস্যা হল যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। যুগের সাথে সাথে এভাবেই ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আওয়ামী লীগের হাল ধরার মত কেউ নেই। শেখ হাসিনা প্রকাশ্য রাজনীতিতে আর আসতে পারবে না। কারণ সে অন্য দেশের কৃপায় আছে। তাছাড়া তার বয়স ৭৬ বছরের বেশী এখন। শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং আরও হবে। ওনারা নিকট ভবিষ্যতে কেউ দেশে আসতে পারবে না। শেখ হাসিনার পরিবারের কোন সদস্য ছাড়া আওয়ামীলীগ দলকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। এই উপমহাদেশে পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি খুব জোরালো এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আওয়ামীলীগের মধ্যে হাজারো কোন্দল আছে। হাসিনা তার দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে এগুলিকে এতদিন নিয়ন্ত্রণ করেছে। হাসিনার এই কাজের দায়িত্ব নেয়ার মত নেতা আওয়ামীলীগে নাই। ফলে শেখ পরিবারের বাইরে কেউ নেতৃত্বে আসলেও ঐক্য ধরে রাখতে পারবে না। হয়তো আওয়ামীলীগ অনেক উপদলে বিভক্ত হয়ে যাবে।
হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং নির্যাতন করার কারণে দল হিসাবে আওয়ামীলীগ তার নৈতিক অবস্থানকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে অতীতের ১৬ বছরের হত্যা, গুম, রিমান্ড, নির্যাতন, দুর্নীতি। তাই ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগ টিকে থাকলেও দুর্বল হয়ে যাবে। তবে যদি বিএনপি, জামাত অথবা নতুন কোন দল ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করে সেই ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ পুনরায় জনসমর্থন পেতে পারে। কিন্তু সেই সময় আসতে এবার হয়তো ২১ বছরের বেশী লাগবে। ততদিন ভালো নেতার অভাবে দল টিকবে কি না এটাও একটা প্রশ্ন। তাই বলা যায় নিকট ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগের কোন আশা নাই। এমন কি এই দলটি মুসলিম লীগের মত শেষ হয়ে যেতে পারে। যুগের পরিবর্তন এবং নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রাজনীতি করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে যাবে। ফলে সনাতনী ধারায় চলা রাজনৈতিক দলগুলি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তার মধ্যে প্রথমে থাকবে আওয়ামী লীগ। এই দলে হাসিনা কোন ভালো লোককে নেতৃত্বে রাখেন নি। রেখেছেন কিছু হত্যাকারী, গুন্ডা, দুর্নীতিবাজ। তাই আওয়ামীলীগের জন্য নিকট ভবিষ্যতে কোন আশার আলো নেই।