সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বলতেই চোখের সামনে কম্পিউটারের মনিটরে বা মোবাইলের ক্ষুদে স্ক্রিনের উপর ভেসে ওঠে নীল-সাদার মিশেল দেয়া একখানা পেইজ যার নাম ফেইসবুক। শুধু সামাজিক যোগাযোগই না দিনে দিনে ফেইসবুক হয়ে উঠেছে মানবিক আবেদন থেকে শুরু করে প্রতিবাদের প্রকাশ পর্যন্ত অনেককিছুরই প্রাণকেন্দ্র... এতদুর পর্যন্ত ‘অতিরিক্ত ইন্টারনেট তথা ফেইসবুক আসক্তি’ ছাড়া হতাশ হবার কিছু ছিল না কিন্তু হতাশ না হয়ে কি আর দুনিয়া চলে??? তাই ফেসবুকীয় দুনিয়াতেও হতাশ হবার মত কিছু বিষয় আসতে শুরু করেছে এবং এই আসার গতিটাও বেশ দ্রুত... ফেইসবুক ইউজাররা ‘পেইজ’ ব্যাপারটির সাথে বেশ ভালভাবেই পরিচিত। পছন্দের পেইজে লাইক দেয়া ফেইসবুক অ্যাকটিভিটির একটি অংশ কিন্তু হতাশ তখুনি হই যখন দেখি ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকেই লাইক দিচ্ছেন নারী বিষয়ক অসুস্থ পেইজগুলো...মাঝে মাঝে এইধরনের পেইজের সাজেশন ও আসে যাতে করে লাইক দিয়ে ‘লাইকার’ বাড়ানোয় ভুমিকা রাখতে পারি... শুরুতে ফেইসবুকে নোংরামির ব্যাপারগুলি ‘১৮+ জোকস” এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা মেনে নেবার মত কখনই আমার মনে হয়নি কারণ ১৮+ মানেই যে কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্করাই সেই পেজের লাইকার বা নিয়মিত রিডার তা কিন্তু নয়, কারণ এগুলো পেইজ; কোন ক্লোজড গ্রুপ না, এর সবকিছুই ওপেন...যে কেউ-ই পোস্টগুলো দেখতে পারে, পড়তে পারে, লাইক দিতে পারে বা পড়ে বিনোদিত হয়ে লাইক/কমেন্টের ধারপাশে না ঘেঁসে চুপিসারে কেটে পড়তে পারে ... নির্দিষ্ট বয়সের আগে এধরনের পোস্ট পড়ে তা থেকে বিনোদিত হওয়া কতটা নৈতিক ও যৌক্তিক তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ থাকেনা । এই পেইজগুলোর এডমিনরা লাইকের জোরে জনপ্রিয় হবার জন্য , নিজেদের পেইজ কে জনপ্রিয় করার জন্য আনন্দের সাথে অশ্লীলতার সাপ্লাই দিচ্ছেন আর গোগ্রাসে তা গিলছে হাজার হাজার ফেইসবুক ইউজার যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ,অপ্রাপ্তবয়স্ক সকলেই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কখনও কি তাঁরা ভেবে দেখেন যে এই অশ্লীলতাগুলো তাঁদের হাত ধরে ঢুঁকে পড়তে পারে তাঁদেরই ছোট ভাইবোনদের মগজের ভেতর, সৃষ্টি করতে পারে অহেতুক কৌতূহল, ঘটাতে পারে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়??? ফিরে আসি নারী সংক্রান্ত পেইজের প্রসঙ্গে। ইদানিং ফেইসবুকে নারী সংক্রান্ত নোংরা পেইজের সংখ্যা ‘প্রাকৃতিক ব্যাঙের ছাতা’ না বরং ‘হাইব্রিড ব্যাঙের ছাতা’র মত গতিশীল গতিতে বেড়ে চলেছে... এইধরনের পেইজগুলোতে আমি ঢুঁ মেরে দেখেছি... পেইজগুলোর প্রধান উপকরন হল একাধিক সুন্দরী কিশোরী/তরুনী মেয়েদের ব্যাক্তিগত বা বিশেষ ছবি... ছবিগুলো দেখে মনে হয় সেগুলো অবশ্যই অনুমতি ছাড়া এবং ছবির মালিকের অজান্তেই আপলোড করা হচ্ছে। আমি জানি এইটুকু পড়তে না পড়তেই অনেকের মাথায় একটা প্রশ্ন চলে এসেছে ‘ এরকম ছবি তুললে দোষ নাই, আর আপলোড করলে দোষ’??? অবশ্যই যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন...আমি নিজেও সহমত জানাচ্ছি এই প্রশ্নের সাথে যে মেয়েরা কেন এই ধরনের ছবি তুলবেন বা কেনই বা তাঁদের এই ধরনের ছবিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপারগুলো যথাযথভাবে তাঁরা রক্ষা করেন না... তবে এই প্রশ্ন করার আগে একটু ভাবুন তো একটা মেয়ের এরকম ব্যক্তিগত ছবি তোলার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় ভুমিকা কার/ কাদের??? এবার আসুন সমস্যার একটু গভীরে আসি। ‘প্রেম’ ব্যাপারটা ইদানিং খুব সস্তা। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন ও সে অনুযায়ী নিজেকে আপ-টু-ডেট করার প্রচেষ্টা, হিন্দি সিরিয়াল, দৃঢ় মূল্যবোধের অভাব, নৈতিক অবক্ষয় বা কখনও কখনও কিছুই না শুধুমাত্র ক্ষণিকের ব্যাক্তিগত আবেগের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস প্রকাশের চক্করে পড়েই প্রেম নামক পবিত্র ব্যাপারটির সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে ‘বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্ক’ এর মত বিষয়টি। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের সম্পর্কের ফলাফল হয়েই বের হচ্ছে এই ব্যাক্তিগত ছবিগুলো। এই ধরনের সম্পর্কের ব্যাপারটিও ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে অনৈতিক কিন্তু এই মুহূর্তে আলোচনার বিষয়ের খাতিরে এই সম্পর্কের ব্যাপারটি ছাপিয়ে প্রসঙ্গক্রমে বলছি যে ব্যক্তিগত এই ছবিগুলো তাহলে এই পেইজগুলো পর্যন্ত আসে কিভাবে??? কার মাধ্যমে??? একবার ভেবে দেখুন তো??? নৈতিকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে এরকম ছবির পাত্রী ও ছবির নেপথ্যের নায়ক দোষ উভয়ের-ই সমান কিন্তু তারপরও এই ছবিগুলোকে লোকসম্মুখে ভোগের বস্তুতে পরিণত করা এবং তাঁদের এই পদক্ষেপ কে পেইজ লাইকের মাধ্যমে আরও উৎসাহিত করাটা কতটুকু নৈতিক??? একবার চিন্তা করে দেখুন তো, এই পেইজগুলোতে লাইক দিয়ে আপনি নিজেও কি দোষীর তালিকায় পড়ে গেলেন না??? শুধু তাই না এই পেইজগুলোতে যে শুধু এ-ধরনের ছবি-ই আছে তা নয় এমন অনেক ছবি আছে যেগুলো দেখেই বোঝা যায় ওগুলো ছবির পাত্রীর অজান্তেই তোলা হয়েছে, হয়ত ফটোগ্রাফার সাহেব ছবির পাত্রীটির নাম পর্যন্ত জানেন না।মেয়েটি কথাও বসে আছেন, বা কোথাও কারো জন্য অপেক্ষা করছেন এমন সময় বা চলার পথে তাঁর অজান্তেই তাঁকে মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দী করে আপলোড করা হয়েছে এই ধরনের পেইজে-এমন ঘটনা যে হচ্ছে না তাও না... আমি নিজেই আমার পরিচিত একজনের সাথে এমন হতে শুনেছি, দেখেছি... এর বিচার কি????
আমি জানি আমার এই দু’পাতা লেখা দিয়ে এই ধরনের অসুস্থ পেইজ খোলার মানসিকতাকে একবিন্দুও টলাতে পারব না, পারব না লাইক দেয়া থামিয়ে এই নোংরামিকে নিরুৎসাহিত করতে। কিন্তু আশার কথা এটুকুই যে ফেইসবুকে যেমন এইধরনের পেইজ আছে তেমনি ‘ইভটিজিং বিরোধী গেরিলা বাহিনী’র মতন পেইজ ও আছে, আছে ‘খাঁটি গরীব’ এর মতন গ্রুপ... অশ্লীল জোকস জনপ্রিয়তা পেলেও এখানে মানবিক আবেদনগুলো ফেলনা যায়না, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই... সঠিক প্রতিবাদের ভাষায় গলা মেলানোর মতন কণ্ঠস্বর এখানে বিরল না তাই সেই ভরসাতেই বলি একবার ভেবে দেখুন তো এই পেইজগুলোর বিরুদ্ধে আসলেই কিছু করা যায় কিনা???? চলুন না, এবার না’হয় আমরাই এগিয়ে আসি এই অসুস্থতার বিরুদ্ধে...।।