রেনুফা ইয়াসমিন পার্স থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, "আছে সাক্ষী।"
অদিত নিচু হয়ে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, "কে?"
"আমার সাথে সেদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত আলম ছিল”, বড় লজ্জা নিয়ে অপরাধী মুখে কথাটা বললেন রেনুফা ইয়াসমিন। তার পুরো মুখটায় লজ্জায় লালচে একটা ভাব চলে এসেছে।
"আলম কে?"
রেনুফা ইয়াসমিন ইতস্তত করে বললেন, "আমার মেয়ের টিচার। ও আমার বন্ধুও। একটা জব করে, আর অবসর সময়ে আমার মেয়েকে পড়ায়।"
"আপনার মেয়ের টিচারের সাথে আপনি সেদিন ছিলেন?"
রেনুফা ইয়াসমিন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, "বললাম তো হ্যাঁ। একই কথা এতবার করে জিজ্ঞেস করার কী আছে? না-কি খুব মজা পাচ্ছেন এসব জেনে?"
অদিত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু হাঁটাহাঁটি করে বলল, "আচ্ছা আপনি এখন যেতে পারেন। আপনাকে আপাতত জিজ্ঞেস করার আর কিছু নেই।"
রেনুফা ইয়াসমিন উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁদছেন, চোখের কাজল সে কান্নায় মুছে যাচ্ছে না। এখন মেয়েদের প্রসাধনসামগ্রীর সবই ওয়াটার প্রুফ হয়ে যাচ্ছে। তার কাজলও ওয়াটার প্রুফ। টিস্যু দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতেই চলে গেলেন রেনুফা ইয়াসমিন।
অদিত সোজা কায়েস আর রাদিবের দিকে তাকাল। প্রশ্নের সুরে বলল, "আপনাদের কী মনে হয়? একেও কি সন্দেহ করা যায়?"
কায়েস এক কথায় উত্তর দিল, "অবশ্যই স্যার।"
"আর ডাক্তার সাহেব আপনার কী মনে হয়?"
রাদিব একটু দ্বিধার সুরে বলল, "হতে পারে। আলম সাহেব তার সাথে ছিল এগারটা পর্যন্ত। এরপরেও ঘটনাটা ঘটতে পারে কিংবা রেনুফা ইয়াসমিনকে তার আলম নামের বন্ধুটা সাহায্য নিয়েও কাজটা করতে পারেন। আমি নিশ্চিত ভাবে বলছি না, শুধু সম্ভাবনা।"
অদিত চিন্তিত ভঙ্গিতে বসল। কায়েসের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তাহলে একদম নিচের তলার মেহেদী আশিক সাহেবের সাথে আমাদের কথা বলতে হবে তাই তো?”
কায়েস সায় দেয় মাথা নেড়ে।
মেহেদী আশিক, বয়স ত্রিশ। থাকে এ বাড়ির দোতলায়। সাথে থাকে তার স্ত্রী উপমা, বয়স সাতাশ। তার শ্যালিকা মৌ, বয়স তেইশ। আর তার মা, বাবা। মেহেদী আশিক একটা ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মার্চেন্ডাইজার হিসাবে আছে। লিকলিকে শরীরের মেহেদী আশিক এসে বসেছে অদিত, কায়েস, রাদিবের সামনে। আজ তার অফিস বন্ধ। সপ্তাহে দু দিন বন্ধ থাকে অফিস। তার চোখে মুখে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছাপ। হয়ত মার্চেন্ডাইজিং করার কারণে এ আত্মবিশ্বাসী ছাপটা এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়েও, তার মধ্যে কোনো সংকোচের ছিটেফোঁটা নেই।
অদিত, মেহেদী আশিকের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনাদের পাঁচ তলার প্রফেসর সাজিদ এলাহী যে খুন হয়েছেন, এ ব্যাপারে তো আপনি জানেন, তাই না?"
মেহেদী আশিক স্বাভাবিক সুরেই বললে, "জি, জানি।"
"যেহেতু আপনাদের উপর তলায় খুন হয়েছে, তাই সাধারণ ফর্মালিটি হিসাবে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা।"
"অবশ্যই, জিজ্ঞেস করুন। আমি যদি এ তদন্তে কোনোভাবে সহায়তা করতে পারি তো বেশ, নিজের কাছেও ভালো লাগবে।"
"আপনি ছয় তারিখ সন্ধ্যার পর কোথায় ছিলেন? মানে গত মঙ্গলবার।"
মেহেদী আশিক একটু চিন্তা করল কিছুটা সময়, এরপর উপরে দেয়ালের ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, "উম, মঙ্গলবার। মঙ্গলবার আমার একটা প্রোগ্রাম ছিল। আমার এক কলিগের বিয়ে। আমরা বাসার সবাই ধানমন্ডি গিয়েছিলাম।"
"সেটা কয়টা নাগাদ হবে?"
"এই সাতটার দিকে।"
"আর ফিরে আসেন?"
"রাত বারোটার পর, বুঝতেই পারেন, ঢাকা শহরে বিয়ের প্রোগ্রাম এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না।"
"আচ্ছা, ফ্যামিলির সবাই ছিলেন একসাথে?"
"হ্যাঁ, একদম সবাই।"
অদিত কায়েস আর রাদিবের দিকে তাকাল। কায়েস চিন্তিত মুখে ব্যাপার গুলো টুকে যাচ্ছে। অদিত জিজ্ঞেস করে, "আপনার সাথে প্রফেসর সাহেবের কোনো ঝামেলা ছিল কি?"
মেহেদী আশিক কিছুটা আনমনা হয়ে গেল এ কথা শুনে, কিছুটা বিষণ্ণ ভাব ভর করল মেহেদী আশিকের চোখে মুখে হুট করে। একটু থেমে বলল, "না ওভাবে কোনো ঝামেলা তার সাথে ছিল না।"
অদিত ঝুঁকে বসল মেহেদী আশিকের দিকে। মেহেদী আশিক একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে। এদিক ওদিক তাকাল। অদিত একটু কাশি দিয়ে মেহেদী আশিকের মনোযোগ ফিরিয়ে বলল, "আপনার সাথে তো আপনার শ্যালকও থাকত। তার নাম যেন কী ছিল?"
মেহেদী আশিক ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল, গলার স্বরে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাব এনে বলল, "তানিম।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ তানিম। ও যতটা সম্ভব মারা গেছে, এই বছরের প্রথম দিকে, যদি না আমি ভুল বলি।"
"জ্বি", ছোটো করে জবাব মেহেদী আশিকের।
"আপনি কী আমাকে বলতে পারবেন, মারা যাবার কারণটা?"
মেহেদী আশিক স্থির বিষণ্ণ চোখে বলে, "সুইসাইড করেছিল।"
"একটু বিস্তারিত বলবেন ব্যাপারটা?"
একটা উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট মেহেদী আশিকের চোখে।
"বিস্তারিত এর কিছু নেই, হতাশ হয়ে গিয়েছিল কোনো কারণে তানিম। তাই সুইসাইড করেছিল।"
"সেই হতাশার কারণটা কী?"
"আমি জানি না সঠিক।"
অদিত উঠে দাঁড়াল। একটু পায়চারী করে বলল, "আমি কিন্তু কারণটা জানি।“
মেহেদী আশিকের চোখে মুখের অতি চঞ্চল্ভাবে এবার স্থিরতা ভর করল। অদিত বলে যায়, “তানিম এবং আপনাদের উপর তলার রেনুফা ইয়াসমিনের মেয়ে মিলি, একই ক্লাসে পড়ত। যেভাবে হোক, অতি অল্প বয়সে দুজনের মাঝে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। টিনএজ বয়সের ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় আর কি, সেখানে ভালোবাসা বুঝতে পারার চেয়ে আবেগের পরিমাণ বেশি থাকে। তো ওরা মাঝে মাঝেই এই আবেগে আক্রান্ত হয়ে, বাসার ছাদে দেখা করত। একটু আধটু হাত ধরাধরি কিংবা আর একটু বেশি কিছু। একদিন ছাদে যখন বিকাল বেলা দুজন একটু ঘনিষ্ঠ সময় কাটাচ্ছিল, আচমকা কখন প্রফেসর সাজিদ এলাহী ছাদে চলে এসেছেন, তা খেয়াল করেনি ওরা। প্রফেসর সাহেব ঐ অবস্থায় দুজনকে দেখে, ধমক দিয়ে উঠলেন। ওরা আতঙ্কে ভয়ে, প্রফেসর সাহেবের কাছে মাফ চাইল। প্রফেসর সাহেব ভাবলেন, এভাবে এদের ছেড়ে দেয়া উচিৎ হবে না। তিনি দুজনকে নিয়ে সোজা আপনাদের ফ্ল্যাটে গেলেন, ফ্ল্যাটে গিয়ে ঘটনা বললেন। রেনুফা ইয়াসমিন যখন আসলেন, তাকেও ঘটনা বললেন। তখন এক হুলস্থুল কান্ড। আমি ঠিক বলছি তো না-কি?”
মেহেদী আশিক কোনো জবাব দেয় না।
“আপনি অফিস থেকে ফিরে ঘটনা শুনলেন। তানিমকে আপনি অনেক পছন্দ করতেন। এই ঘটনা মেনে নিতে পারলেন না, তানিমকে ধরে যাই হোক আপনি থাপ্পড় মারলেন। অনেক বকা ঝকাও করলেন, প্রফেসর সাজিদ এলাহী আর রেনুফা ইয়াসমিনের সামনে। আপনার শ্যালক সে অপমান সহ্য করতে পারল না। টিনএজ বয়সের আবেগে, সে রাতেই নিজের রুমে গলায় ফাঁসি দিয়ে মরে গেল। শুধু আপনি না প্রফেসর সাহেবের নিজেরও মনে হয়েছিল, এভাবে ছেলে মেয়ে দুটোকে অপমান করাটা উচিৎ হয়নি। তিনি মাফ করে দিলেই তো পারতেন, তাহলে আর ছেলেটা মরে যেত না। আপনার প্রফেসর সাজিদ এলাহীর প্রতি এ বিষয় নিয়ে রাগ থাকাটা কিন্তু অবিশ্বাস্য কোনো ব্যাপার না, তাই না বলেন?"
মেহেদী আশিকের সেই আত্মবিশ্বাসী চেহারায় এখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত ভাব। অসহায় একটা মুখ করে মেহেদী আশিক বসে আছে। কোনো কথা বলল না। কোনো উত্তর দিলো না। মৌনতা বলে দিলো, অদিতের বলা প্রতিটা কথা সঠিক। মেহেদী আশিককে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না অদিত। মেহেদী আশিকের স্ত্রী এবং শ্যালিকাকে পাঠাতে বলে মেহেদী আশিককে পাঠিয়ে দিলো অদিত।
মেহেদী আশিকের স্ত্রী উপমা এবং শ্যালিকা মৌ, দুজনের চেহারা দেখে মনে হয় যেন দুজনে জমজ। চেহারার মধ্যে খুব কমই অমিল। শুধু উপমা সংসার করে একটু মুটিয়ে গিয়েছে, আর মৌ এর শরীর মেদহীন। অদিত দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনাদের খুব ছোট দুইটা প্রশ্ন করব, উত্তর দিয়েই আপনারা চলে যাবেন। ভয় পাবার কিছু নেই।"
কিন্তু দুজনেই খুব ভয় পাচ্ছে। চোখ মুখের অস্থিরতা তাই বলছে। অদিত জিজ্ঞেস করে নম্র গলায়, "আপনারা তো মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে গিয়েছিলেন মেহেদী আশিকের কলিগের বিয়েতে, তাই তো?"
উপমা ধীর গলায় জবাব দিলো, "জি, গিয়েছিলাম।"
"বাসায় কেউ ছিল না, সে সময়টায়?"
"জি না।"
অদিত মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনার কি স্পষ্ট মনে আছে, পুরো অনুষ্ঠানের মাঝে আপনারা কেউ বাসায় আগেই কেউ ফিরে আসেননি?"
মৌ ঈষৎ ভাবনায় চিন্তা করল কিছু। সহজে উত্তর দিল, "জি না, আমরা বারোটার দিকে ফিরে আসি। তবে নয়টার দিকে দুলাভাই একবার বাসায় এসেছিলেন।"
রক্তচক্ষু নিয়ে উপমা তাকাল মৌয়ের দিকে। মৌ জিবে একটা কামড় দিলো। যেন কিছু মুখ ফসকে বলে দিয়েছে। অদিত বলল, "হ্যাঁ বলুন আপনি।"
মৌ বোনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, "না, আসলে আমি কিছু জানি না।"
"আপনার দুলাভাই মাঝে একবার নয়টার দিকে বাসায় এসেছিল।"
মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, "আমি কিছু জানি না।"
অদিত বুঝতে পারল, এই ব্যাপারটা বলতে না করা হয়েছিল মৌকে। কিন্তু ভয় পেয়ে বলে দিয়েছে কথাটা। অদিত উপমার দিকে তাকিয়ে একটু কড়া করে বলল, "দেখুন ম্যাডাম, আপনারা যদি কিছু লুকান, সেটা বের করা আমাদের জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। সত্যিটা বলুন এতে আপনাদেরই ভালো হবে।"
উপমা বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। হতাশ হয়ে যাবা একটা গলায় বলল, "হ্যাঁ নয়টার দিকে একবার এসেছিল আশিক বাসায়। আমরা বিয়ের পাত্রীর জন্য যে রিংটা কিনেছিলাম গিফট হিসাবে, তা ভুলে বাসায় ফেলে বিয়েতে চলে গিয়েছিলাম। ওটা আনতেই বাসায় এসেছিল।"
"কয়টা নাগাদ এখান থেকে আবার ধানমন্ডি পৌছাল?"
"এই সাড়ে দশটা হবে?"
"তো আপনারা ব্যাপারটা লুকাচ্ছিলেন কেন?"
"আপনারা যদি আবার ওকে সন্দেহ করেন, তাই। দেখুন আশিক অনেক সহজ সরল একটা ছেলে। ওকে এসবে অযথা জড়াবেন না।" অনুরোধের সুরে বলল উপমা।
অদিত ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আর মেহেদী আশিক সাহেব নির্দোষ হলে আমরা তাকে কেন শুধু শুধু এসবে জড়াতে যাব?"
উপমা আর মৌ চলে যাবার পর, অদিত আসন ছেড়ে উঠে, রাদিব আর কায়েসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ গম্ভীর গলায় ধীরে ধীরে বলল, "তো আমাদের ভাবনা মতে এরাই ছিল মোটামুটি প্রফেসর সাজিদ এলাহীর খুনের সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গ। এর বাইরেও কেউ হতে পারে, যার আসা যাওয়া আছে, এ বাড়িতে। তবে আপাতত আমরা ধরে নিচ্ছি এরাই সন্দেহভাজন। তাহলে শেষমেশ আমরা যে তথ্য গুলো পেলাম", বলে অদিত কায়েসের লেখার প্যাডটা হাতে তুলে নিল। ওটার দিকে চোখ বুলিয়ে কিছুক্ষণ তারপর বলল, "সন্দেহভাজন ব্যক্তি এবং তাদের খুনের কারণ যে গুলো হতে পারে তা হলো,
নাসির উদ্দিন। খুনের কারণ: নোমান কাদেরের টাকা নিয়ে পলায়ন এবং নোমান কাদের প্রফেসর সাহেবের বন্ধু। বিশেষ দ্রষ্টব্য: নাসির উদ্দিন সেদিন রুমেই ছিলেন, এ ব্যাপারে তার কোনো অ্যালিবাই নেই।
রেনুফা ইয়াসমিন। খুনের কারণ: তাকে সামাজিকভাবে বাজে উপস্থাপন। তার নামে আজেবাজে কথা রটানো। আর একটা কারণ হতে পারে, তার মেয়ে মিলি ও তানিমকে ছাদে প্রফেসর সাহেবের ধরে ফেলা। বিশেষ দ্রষ্টব্য: রেনুফা ইয়াসমিন এদিন রুমেই ছিলেন এ ব্যাপারে তার অ্যালইবাই, তার মেয়ের টিচার আলম, যার সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক। তাকে খুনে সহায়তা মেয়ের টিচার আলমও করতে পারেন।
মেহেদী আশিক। খুনের কারণ: প্রফেসর সাহেব তার শ্যালক তানিম ও মিলিকে ধরে ফেলার কারণে, শ্যালকের আত্মহত্যা। তার শ্যালককে তিনি খুব স্নেহ করতেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য: মেহেদী আশিক সেদিন নয়টার দিকে একবার মাঝে বাসায় ফিরে আসেন।
দিদার। খুনের কারণ: তার ভাই নাহিনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে প্রফেসর সাজিদ এলাহীকে। ভাইয়ের মৃত্যু যে প্রফেসর সাহেবের কারণেই হয়েছে, সে ব্যাপার তিনিও বিশ্বাস করেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য: তিনি যে সেদিন বাসায় ছিলেন সে ব্যাপারে তার অ্যালিবাই, তার মা।
দীপ্ত। খুনের কারণ: নাহিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু দীপ্ত। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর জন্য তিনি বার বার প্রফেসর সাহেবকে দোষারোপ করেছেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য: খুনের দিন তিনি মোতালেব প্লাজার দিকে আসার কথা স্বীকার করেছেন। খুনের পরের দিন তিনি মানিকগঞ্জ চলে গিয়েছেন। খুনের দিন সন্ধ্যার পর তিনি কোথায় ছিলেন, সে ব্যাপারে তার কোনো অ্যালিবাই নেই।
আরিফ, মিশু। খুনের কারণ: এই দুজনেই নাহিনের লাশ জীবিত দেখার কথা বলেছেন। দুজনেরও ভালো বন্ধু ছিল নাহিন। তারাও মনে করে নাহিনের মৃত্যু হয়েছে প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কারণে। বিশেষ দ্রষ্টব্য: তারা একজন অন্যজনের অ্যালিবাই, তাদের ভাষ্যমতে তারা সন্ধ্যার পর হলে ছিলেন। দুজন একসাথেও এ ঘটনা ঘটাতে পারেন।
নাহিন। খুনের কারণ: তাকে ফেল করিয়ে দেয়া একদম শেষ পরীক্ষায় এসে। বিশেষ দ্রষ্টব্য: আপাতত তার লাশ কোথায় আছে সেটাই চিন্তার বিষয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সব বিবেচনা করে নাহিন মারা গিয়েছে এবং যারা তার লাশকে দেখেছে সেটাকে দৃষ্টি ভ্রম হিসাবেই ধরা যায়।"
অদিত সব গুলো সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও তাদের খুনের কারণ বলে কায়েস ও রাদিবের দিকে তাকাল। কায়েস কিছুটা ইতস্তত করে বলল, "স্যার আর একজন মনে হয় বাদ গেল, আমরা যাদের তালিকা করেছিলাম তাদের মধ্য থেকে।"
অদিত কঠিন চোখে তাকাল কায়েসের দিকে। অদিত জানে ভালো করে কায়েস ইঙ্গিত করছে রাদিবের দিকে। কায়েস আবার চুপ হয়ে গেল। অদিত বলে,"আমাদের হাতে ফরেনসিক রিপোর্ট চলে এসেছে। আসল খুনি কে, সেটা বুঝতে কিংবা খুঁজতে এই রিপোর্ট আমাদের সাহায্য করবে। তাছাড়া প্রফেসর সাহেব কিছু ক্লু রেখে গিয়েছেন। তার লাশের পাশে পড়ে থাকা বইয়ের নামের উপর রক্ত দিয়ে কিছু লিখতে চেষ্টা করা, খুন করা ছুরি, আঘাত করার ধরণ, সিগারেটের ফিল্টার। এগুলাও আমাদের সাহায্য করবে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যে চিন্তা করার ব্যাপার সেটা হলো তার লেখা TOTAL PAID এর উপর রক্তের ছাপে লেখার চেষ্টা। এখানে টাকা পয়সা বিষয়ক কোনো বিষয় বুঝাতে পারেন, বুঝাতে পারেন কারও সাথে পুরনো কোন হিসাবের পুরোটাই মিটে গেছে। তিনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন? সেটা আমাদের বুঝতে হবে, খুঁজতে হবে। আমার মোটামুটি ধারণা অনুসারে মনে হচ্ছে খুনিকে খুঁজে পেয়েছি। তবে এখনি আপনাদের আমি বলছি না। আর একটু সময় নিচ্ছি। ডাক্তার সাহেব, আপনার কী মনে হয় এদের মধ্যে কে খুনি?"
রাদিব একটু ভেবে বলল, "আপাতত আমি বুঝতে পারছি না। আপনার মত করে তো ভাবতেও পারি না।"
"কায়েস, তোমার?"
কায়েস কিছুক্ষণ অদিতের দিকে তাকিয়ে রইল, ভেবে চিন্তে বলল, "বুঝতে পারছি না স্যার।"
অদিতের মুখটা চিকচিক করে উঠল। অদিত বলল, "আমরা কাল আমার অফিসে ব্যাপারটা নিয়ে বসব। তখন জানাব, কে খুনি। এর মাঝে আপনারাও ভেবে নিন, দেখেন বুঝতে পারেন কিনা।"
তিনজন একসাথে বেরিয়ে গেল প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বাসা থেকে। অদিত তালাটা লাগিয়ে চাবিটা পকেটে রেখে রাদিবের দিকে তাকিয়ে বলল, "মধুমিতা কিন্তু আপনার ভালো ভক্ত হয়ে গিয়েছে। আর একদিন সময় করে অবশ্যই বাসায় যাবেন"
রাদিব হেসে হেসে বলল, "আর আমি আপনার ভক্ত হয়ে গিয়েছি। ভালো মাত্রায় ভক্ত।"
অদিতও হাসল। তিনজন হাঁটতে লাগল। কাজের অনেকটা গুছিয়ে এসেছে, এখন শুধু শেষ দৃশ্যের অপেক্ষা। অদিত আর কায়েস গাড়িতে উঠে বসল। রাদিব উঠল না। "কাজ আছে", বলে হাঁটতে লাগল। অভিনয় থেকে বেরিয়ে এসেছে রাদিব। এখন রাদিব হয়ে উঠতে হবে, কাজের বাকিটা শেষ করতে হবে। মনে মনে হিসাব করে নিলো, কোথায় কোথায় যাবে, কী কী কাজ আছে। অদিত খুঁজে পেয়েছে খুনি, খুঁজে পেয়েছে রাদিবও। কাল শুধু মিলিয়ে দেখার পালা।
(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত। )
৮ম পর্ব
রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫