আমাদের ক্লাসমেট সমীরণকে আমরা সবসময় সমীকরণ বলে ডাকতাম। বিষয়টার সূত্রপাত ঠিক কবে, মনে করতে না পারলেও, অনুমান করা যায়, হাবীব স্যারের কোনো এক ম্যাথ ক্লাসে সমীকরণ বোঝাবার সময় আমরা এই নাম দিয়েছিলাম। এত সুন্দর একটা নামের এমন বিকৃতি সমীরণ মেনে নিতে পারে নি। সমীকরণ নামে ডাকার উদ্যোক্তা যেই ই হোক, সমীরণ এক তরফাভাবে আমাকেই সর্বদা দোষারোপ করে গিয়েছে এই ব্যাপারে। আমি তাতে অভিযোগের সুরে বলেছি, “দেখ ভাই, সবাই ডাকে তাই আমি ডাকি। আমাকেই কেন তুই সবসময় দোষ দিস?”
সমীকরণ অন্য দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “সবাই ডাকলেই তুই ডাকবি? সবাই আর তুই এক হলি?”
আমি সে কথার গূঢ় মর্মার্থ বুঝি না। আমি আর অন্য কেউ, এর মাঝে কোনো তফাৎ আমি খুঁজে পাই না। সাথে সাথে আমি সমীরণকে এও বোঝাবার চেষ্টা করি, অন্যদের যে নামগুলো দেয়া হয়েছে সে তুলনায় সমীরণকে ডাকা সমীকরণ নামটা যথেষ্ট ভদ্র। এই যেমন গরুর হাটের পাশের বাসায় থাকা সাব্বিরকে আমরা, গরু সাব্বির বলে ডাকি। ক্লাসে একাধিক সাব্বির থাকার কুফল বোধহয়, গরু সাব্বিরই বেশি ভোগ করেছে। বাকি দুই সাব্বিরের একজন কানা সাব্বির ও একজন খাটা সাব্বির নামে পরিচিত, একজন চোখে কম দেখা ও অন্যজন উচ্চতায় বেড়ে না ওঠার কারণে। সে তুলনায় সমীকরণ নামটা বেশ ভদ্রস্থ।
সমীরণ আমাদের থেকে কিছু দিকে আলাদা ছিল। আমরা যে সময় সদ্য ধান কাটা মাঠে, ক্রিকেট পিচ বানিয়ে ব্যাট বল নিয়ে নেমে যেতাম, সমীরণ তখন মাঠের পাশে বই নিয়ে বসে থাকত। আমরা টিপ্পনি কাটতাম, “কিরে, সমীকরণ মিলাস না-কি?”
সমীরণ মৃদু হাসত। কখনও জবাব দিত না। শুধু সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফেরার পথে, আমাকে বলত, “তুই অমন সবার সাথে তাল মিলালি কেন? এটা কি সমীকরণ লেখা কোনো বই? এই দেখ এটা সত্যজিৎ রায়ের একটা বই, ফেলুদার কাহিনী, নাম ‘গোরস্থানে সাবধান’, কী যে দারুণ বইটা!”
আমি বইয়ের আলোচনায় যাই না, সমীরণকে ধাক্কা দিয়ে বলি, “তোর খালি আমাকে দোষ দেয়া, সবাই যে বলল।”
“সবাই বললেই তুই বলবি?”, সমীরণ আমার হাতে বইটা ধরিয়ে দেয়, “সবার মতনই কেন তোকে হতে হবে? বইটা পড়িস।”
আমি বই নিয়ে টেবিলের উপর ফেলে রাখি। ধরি না, ছুঁই না। পড়ার বই দেখলেই কেমন লাগে, আবার গল্পের বই। ও ব্যাটা সমীরণের পড়তে ভালো লাগে, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। তাই কি আমারও ভালো লাগবে না-কি? আমি পরীক্ষার আগ দিয়ে পড়ে টড়েই ক্লাসে ১৫-১৬তম হই। সমীরণের মতন সারাদিন পড়ে আমার ফার্স্ট সেকেন্ড হবার কোনো ইচ্ছে নেই।
সমীরণ ঠিক তার পরের দিনটায় আরেকখানা বই এনে আমাদের খেলার মাঠের পাশে বসে থাকে। এলাকার মুরুব্বি গোছের লোকেরা তো আর সত্যজিৎ রায়কে চেনেন না। তারা কানাঘুষা করেন, ছেলেটা কী ভালো রে। খেলার মাঠে এসেও বই পড়ে। কয়েক জনের বাসায়, পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন খেলাধুলা সম্পর্কিত চিল্লাপাল্লায় সমীরণের উদাহরণ চলে আসে। অনেকের রাগ জমে, ক্ষোভ সঞ্চয় হয় সমীরণের প্রতি।
তার দিন কয়েক পরে, আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে। অসময়ের বৃষ্টি। খেলা যায় পণ্ড হয়ে। আমাদের দলের ব্যাটিং সবেমাত্র শেষ হয়েছে। এই বৃষ্টি বাদলায় আর বিপক্ষ দলকে ব্যাটিং করতে দেবার মতন পরিস্থিতি নেই। কিন্তু বিপক্ষ দল তা মানতে নারাজ। ওরা বৃষ্টির মধ্যেই ব্যাটিং করবে, আমাদের বৃষ্টির মধ্যেই ফিল্ডিং দিতে হবে। ছোটোখাটো ঝামেলা রকম বেধে যায়। বিপক্ষ দলের মাথা গরম গালিব, ব্যাট নিয়ে ছুটে আসে আমাদের মারতে। আমরাও এগিয়ে যাই। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ব্যাট ছুড়ে মারে আমার দিকে। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আমিও তেড়ে যাই গালিবের দিকে, আমাকে মারতে চায়, আমিও দেখে নিব। তখন মাথা গরম, গালিব শরীরে গতরে আমার চেয়ে কয়েকগুণ স্বাস্থ্যবান। আমার মাথায় তা থাকে না। ঝাপিয়ে পড়ি গালিবের উপর, গালিব সজোরে একখানা ঘুষি বসিয়ে দেয় আমার নাক বরারর। গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করে। মনে হয়, নাক বেয়ে মস্তিষ্কে একটা ব্যথার সূক্ষ্ম অনুভূতি চট করে আঘাত হানলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, চারপাশ কেবল ভন ভন করে ঘুরতে থাকে। আশেপাশের সবাই ছুটে আসে, আমি আমার মুখের উপর আবছাভাবে শুধু বই হাতে সমীরণকে দেখতে পাই। বইয়ের গায়ে লেখা, হাকলবেরি ফিন-এর দুঃসাহসিক অভিযান, মার্ক টোয়েন।
সেদিন হতে আমার মাঠে যাওয়া নিষেধ। খেলাধুলা বন্ধ। খেলা বলতে শুধু ঐ ক্লাস শেষে অল্প স্বল্প স্কুল মাঠে এক দুই ম্যাচ। এই যা। আমার কিছুই ভালো লাগে না, বিকেল বেলা কাটতে চায় না। প্রতিদিন বিকালে সমীরণ আমাদের বাসায় আসে। ওর আলাপ আলোচনা আমার ভালো লাগে না। বিরক্ত হই। আমার বাবা মায়ের পৃথিবীর সকল বন্ধু বান্ধবের বিষয়ে অত্যন্ত নাক ছিটকানো থাকলেও, সমীরণের ব্যাপারে তারা একদম গদগদ। যেন আমার একমাত্র বন্ধুই হওয়া উচিত সমীরণের। বাকি সবাই তাদের ছেলেকে খারাপ বানিয়ে ফেলবে, কুপথে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার সাথে যে সমীরণের সাথে আড্ডা জমে না, সে কথা তাদের কে বুঝাবে?
“এই তুই সেদিন, ঐ ভোটকা বই দিয়ে, ভোটকা গালিবের নাকের মধ্যে দিয়েছিলি, তাই না রে?” আমি প্রশ্ন করি সমীরণকে। সমীরণ আলতো হেসে বলে, “তোকে মেরে এমনি এমনি চলে যাবে? অন্য কেউ হলে, জীবনেও যেতাম না। খালি তুই ছিলি বলে। বইয়ের বাড়ি খেয়ে গালিব তো দৌড়েই পালাল। দাঁড়িয়ে থাকলে, ব্যাটাকে শেষ করে ফেলতাম, আমার বন্ধুকে মারে।”
আমি কথাটা চুপ করে শুনি। মনে মনে খুশি হই, এই ভেবে গালিবের একটা উচিত শিক্ষা হলো।
মাঠে কম আসা যাওয়ার ফলে আমার মাঝে এক অন্য অভ্যাস গড়ে উঠল। এরচেয়ে বরং বলা যায়, সমীরণ আমার মাঝে অন্য অভ্যাস গড়ে তুলল। আমার মাঝে গল্পের বই পড়ার নেশা সৃষ্টি করে দিলো সমীরণ। আমি সমীরণের কাছ থেকে একটা করে বই নেই, দিন তিনেকে তা শেষ করে আবার ফেরত দেই। নতুন বই চলে আসে।
কলেজ জীবনের শেষ দিকে আমি সমীরণকে জিজ্ঞেস করি, “এই তোর কাছে কত বই আছে রে? এত বই পড়তে দিস আমাকে, বই শেষ হয় না?”
সমীরণ হাসে। “চল, তোকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই, আমার বইয়ের কালেকশন দেখাব। তুই তো কখনও আমাদের বাসায় যাস নি।”
আমি অবাক হয়ে চিন্তা করলাম, আরে তাই তো। এতদিনের পরিচয়ে আমি কখনও সমীরণের বাসায় যাই নি। কেন যাই নি আসলে?
সমীরণের বাসায় গিয়ে, আমার মাথা চক্কর দেবার যোগাড়। এত বিশাল বাড়ি! তিন তলা বাড়ির পুরোটায় ওরা থাকে। বাড়ির সামনে দুই খানা গাড়ি, বাড়ির আশেপাশে ফুল ফলের বাগান। তিন তলা বাড়িতে শুধু সমীরণ, ওর মা বাবা আর গোটা কয়েক কাজের লোকের বাস। ওদের এক রুমের অর্ধেক সমান রুমে কি-না আমরা তিন জন থাকি, বাবা মা আর আমি। তার উপরে টিনের ফুটো দিয়ে বর্ষাকালে জলের ধারা নেমে আসে।
আমি সমীরণের বইয়ের সংগ্রহ দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। চারটা বিশাল বুকশেলফ ভর্তি বই। একটা মানুষের পক্ষে এক জীবনে এত বই পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়। সমীরণের বাবা যখন যেখানে যান, বই কিনে নিয়ে আসেন। ওনার বইয়ের নেশা। বই গুলো সব উনি বেশ সুন্দর করে ক্যাটাগরি করে সাজিয়ে রেখেছেন। কিশোর, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা, রহস্য, থ্রিলার, সামাজিক, ইতিহাস, ভৌতিক, রোমান্টিক। কিছু বই অবশ্য এর বাইরে ক্যাটাগরি ছাড়াও আছে। আমি চট করে সমীরণকে বলে ফেলি, “তুই আমাকে সারাজীবন বই পড়তে দিস, হ্যাঁ?”
সমীরণ আবার আমার কথা শুনে হাসে। বলে, “আচ্ছা দিব।”
আমাদের কলেজ জীবন শেষে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়, তখন ভেবেছিলাম সমীরণের সাথে আমার বোধহয় আর দেখা সাক্ষাৎ হবে না। সমীরণ যে ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তি হলো, আমি সেখানে পরীক্ষা দেবার জন্য বসারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারলাম না। কিন্তু ব্যাপারখানা তেমন হলো না। আমার ভার্সিটি থেকে সমীরণের ভার্সিটির দূরত্ব বাসে করে ১০ টাকার। সমীরণ প্রতি সপ্তাহে আমার হলে দু চারবার আসত। আমি কখনও সমীরণের হলে যেতাম না। আমার হলে এসেও সমীরণ কিছু বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে ফেলল, যাদের সমীরণের কথা ভালো লাগে, সমমনা যাকে বলে। আমি সমীরণের সমমনা কখনই ছিলাম না। সমীরণ যেমন দেশ নিয়ে ভাবে, বিশ্ব নিয়ে ভাবে, রাজনীতি কিংবা ধর্মীয় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে ভাবে, আমার সেসব নিয়ে ঠিক কোনো চিন্তাই আসে না। কিংবা সবাই যেভাবে ভাবে, আশেপাশের মানুষ কিংবা মেজোরিটির মতনই আমার চিন্তাধারা।
আমি সমীরণের দেয়া বই পড়তে পড়তে টুকটাক লেখালেখি শুরু করলাম, সে সময়টায় ফেসবুকে ছদ্ম নামে লিখতাম। মানুষ গল্প পড়ত, ইনবক্সে নানা আলাপে নানা কিছু জিজ্ঞেস করত, আমার তা ভালো লাগত। আমার লেখা প্রেমের গল্পগুলো তখন ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয়। আমি একবার সমীরণকে আমার একটা লেখা দেখিয়ে বলি, “এই দ্যাখ কী পরিমাণ লাইক পড়েছে, সবাই কত পছন্দ করেছে লেখা।”
সমীরণ মনযোগ সহকারে কিছু সময় নিয়ে আমার লেখা পড়ে। লেখা পড়ে মুখের উপর বলে দেয়, “খুবই সস্তা লেখা হয়েছে। দুই বছর পর তুই পড়লে, তোর কাছেই এই লেখা ভালো লাগবে না আর। লেখার টপিকে ভিন্নতা নিয়ে আয়, অন্যরকম চিন্তা ধারার লেখা লেখ। লিখলে দেখবি, তোর নিজের কাছেও বেশ ভালো লাগছে।”
আমি মুখ গোমড়া করে সমীরণের দিকে তাকিয়ে থাকি। সমীরণ বলে, “মন খারাপ করিস না। লেখালেখি যদি করতে চাস নিয়মিত, আরও পড়তে হবে তোর। লিখতে লিখতে দেখবি, লেখা কেমন ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে।”
আমি সমীরণের উপদেশে, অনেক ভেবে চিন্তে একখানা গল্প লিখলাম, সে গল্পের ভালোবাসা মোমবাতির আলো এবং অন্ধকারের। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, সে লেখা ফেসবুকের মানুষজন খুব একটা পছন্দ করছে না। সমীরণের উপর আমার রাগ হয়। আমি যা আমাকে তা থেকে সমীরণ কেন যেন পাল্টাতে চায়। আমার তা পছন্দ না।
যেমন ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে থাকতে, খবর পেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পহেলা বৈশাখের মেলায়, এক মেয়েকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। একদল উগ্র ছেলেপেলে, জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। মাথা গরম হলো, কেন যেন খবরটা দেখে। মনে মনে ঠিক করলাম, একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়ে দিব ফেসবুকে। লিখতে লিখতে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, পক্ষে বিপক্ষে নানা মত। কেউ বলছে অনুচিত হয়েছে, কেউ বলছে অনুচিত হয়েছে অবশ্যই কিন্তু মেয়েরা কেন মেলায় যাবে? আমার কাছে দ্বিতীয় পক্ষের কথা বেশি ঝোরালো মনে হয়। আমার সাথে সেদিনটায় সমীরণের দেখা। সমীরণকে বললাম ব্যাপারটা নিয়ে, মেয়েটার এতো ছেলের মাঝে মেলায় যাওয়া উচিত হয় নি। সমীরণ শান্ত স্বরে আমাকে বলে, “উচিত, অনুচিত বিষয় পরে, কথা হচ্ছে ক্রাইম ইজ ক্রাইম। যা অপরাধ তাকে অপরাধ বলার সৎসাহস থাকা উচিত সবার। সবাই একটা কথা বলল, আর তুই তা মেনে নিলি? তোর নিজের চিন্তা বুদ্ধি নাই? একটা মেয়ে মেলায় গেলেই আমার তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করবে? বুকে পিছনে শরীর লাগাতে ইচ্ছা করবে? সু্যোগ পেলেই শরীরের কাপড় টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে? এটা পুরুষত্ব? এটা পুরুষত্ব হলে, এমন পুরুষত্বের উপর আমি মুতি।”
হঠাৎ করে রেগে যায় সমীরণ, আমার মাঝেও কী যেন হয়ে যায়। যার সাথেই দেখা হয়, পহেলা বৈশাখের ঐ ঘটনা নিয়ে আলাপ করি। যুক্তি দেই, সেদিনের ঘটনায় শতভাগ অপরাধ সেই ছেলেগুলোর। এর মাঝামাঝি কোনো সম্ভাবনা নেই।
সমীরণের কী যেন হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই সমীরণ উদাস থাকে। সমীরণ বুঝতে পারে, যে কোনো সময় পুলিশ ওকে ধরতে পারে। যে কোনো সময় ওর উপর হামলা হতে পারে। পত্র পত্রিকায় ভীষণ লেখালেখি হচ্ছে, বর্তমান সময়ের শহরের দেয়াল গুলোতে লেখা দেয়াল লিখন নিয়ে। সেখানে সরকারের অপারগতা, বিরোধী দলের স্বার্থান্বেষী আচরণ, দেশে চলমান ধর্ষণ, খুন, গুম, ভারত কিংবা বাংলাদেশের উগ্র ধর্মান্ধ, উগ্র নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লেখা। আমি জানি এসবের পিছনে সমীরণ। সমীরণ একা সব কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সবার চোখের বিষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে শুধু বলে, “তুই অন্তত সবার মতন হয়ে যাস না”।
এর মাঝে আমার পড়ালেখা শেষ হয়, চাকরিতে ঢুকি, যার সাথে প্রেম তার সাথে বিয়ের আয়োজন চলে। সমীরণের সাথে বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। মাঝে মাঝে ফেসবুকে নক দেয়, কথা বলে, এই যা। আমার বিয়ের খবর আমি সমীরণকে দেই। বিয়ের দিন সকাল বেলা, সমীরণ এসে হাজির আমার বাসার সামনে। বাসায় আসতে বলি, আসে না। আমাকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সমীরণ বলে, “কেমন আছিস?”
আমি উত্তর করি, “ভালো। তোর কী খবর?”
আমি সমীরণের দিকে তাকাই, সমীরণ আগের চেয়ে বেশ শুকিয়ে গেছে। মনে হয় অনেক ধকলের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। সমীরণ আমার কথার উত্তর দেয় না। আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা রাখ। তোর আর ভাবীর জন্য শুভ কামনা রইল। আমার কাজ আছে, আসি।”
সমীরণকে আমি আটকে রাখতে পারি না। সমীরণ চলে যায়। কাগজটা আমি খুলি। সমীরণের স্পষ্ট হাতের লেখায় সেখানে লেখা,
বন্ধু,
আমার সাথে এই বোধহয় তোর শেষ দেখা। আমি তোকে সবসময় আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভাবতাম। তুই কী ভাবতি, আমি জানি না। তোর অনেক কাছের বন্ধু বান্ধব ছিল, কিন্তু তাদের নিয়ে আমার কোনো, অনুযোগ বা অভিযোগ নেই। তুই কি জানিস, সমীরণ মানে কী? সমীরণ অর্থ বায়ু, আমাদের চারপাশে থাকা বাতাস আর কি। আমাকে তোরা সমীকরণ বলে ডাকতি। আমি শুধু সারাটা জীবন একটা জিনিস চেয়েছি, তোর পাশে সমীরণ হয়ে থেকে, তোর চিন্তার সমীকরণটাকে সাজাতে। আমি জানি, আমি এখানে সফল। তুই ঠিক আমার মতন না, তুই তোর মতনই। কিন্তু তুই এখন বই পড়িস, কোনো কিছু নিয়ে সবার সাথে গা ভাসাস না। নিজের মতন চিন্তা করিস। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে তা নিয়ে ভাবিস। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত তা বিচার করতে পারিস। আমি শুধু এতোটুকুই চেয়েছিলাম। আমার কাজ তো শেষ হলো, এবার তোর জীবনে একজন আসছে, সে কেমন আমি জানি না। শুধু তুই তোর কাজটা করে যা। তার পাশে সমীরণ হয়ে, চিন্তার সমীকরণটাকে সাজিয়ে দে।
আমি চুপচাপ চিরকুটটা পড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। সত্যি সেদিনের পর আর আমার সাথে সমীরণের দেখা হয় নি। সমীরণ কোথায় আছে, কেমন আছে, আমি জানি না। যোগাযোগের কোনো উপায়ও রাখে নি।
সমীরণকে নিয়ে বলার মতন, অনেক ঘটনাই আছে। সব হয়ত বলে শেষ করা সম্ভব নয়। আমি সমীরণ হতে পারি নি, আমি সমীরণের মতন সবকিছু নিয়ে ভাবিও নি কখনও। আমাদের অনেক অমিল আমি জানি। তবু সমীরণ আমার জীবনে অন্য একটা জায়গায় আছে, ঠিক ওখানেই থাকবে সবসময়।
আজ আমার বিয়ের ৪৫ মাস পূর্ণ হলো, আর সমীরণের সাথে শেষ সাক্ষাতেরও ৪৫ মাস।
আমি এখন আমার পাশের মানুষটার চারপাশের সমীরণ, যার চিন্তার সমীকরণ বদলে দেবার কাজ করে যাচ্ছি ৪৫টা মাস ধরে।
রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৪৪