- এই সহজ সরল হয়ে যাওয়া জীবনেরও কিছু জটিলতা আছে জানো?
- যেমন?
- যেমন এই ধরো, চাইলেই আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি, যখন খুশি অভিমান জমাতে পারি, কিংবা রাগ করে তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ রাখতে পারো, বন্ধ করে রাখতে পারো তোমার কানে থাকা সেল ফোনটা।
- এর মাঝে জটিলতার কী আছে?
- ধরে নাও, সেই বহু যুগ আগে যখন পত্র বিনিময় হতো, তখন চাইলেই কি এমন রাগ করে পত্র না পড়ে রেখে দিতো কোনো প্রেমিকা?
- কী করে বলব? রাখতেও পারত।
- একদম না। মানুষ রাগ করলে, অভিমান করলে চায় যে মানুষটার সাথে রাগ, অভিমান জমিয়েছে সে জানুক, সে বুঝুক, ঐ জমে থাকা ক্ষোভের ব্যথার পুরোটা কিংবা কিছুটা সেও অনুভব করুক। ঐ পত্রের যুগে একখানা পত্র না পড়ে, মিছেমিছে না দেখানো রাগ কেউ জমাতো না। তার চেয়ে বরং পত্রে কী লেখা আছে, সে আগ্রহ না দমিয়ে পত্র পড়ে ফেলাই শ্রেয় ছিলো।
- তুমি বেশ কঠিন করে কথা বলো মাঝে মাঝে, কিছুই বুঝতে পারি না।
- আমি মাঝে মাঝেই চাই পৃথিবীর কেউ আমাকে না বুঝুক। আমি চরম দুর্বোধ্য থেকে যাই। কিন্তু বেশিরাভাগ ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটে, আমিই বরং কাউকে বুঝি না, আশেপাশের কাউকেই না।
- কী বুঝতে চাও?
- আমার মনে হয় আশেপাশের সবাই আমার সাথে মিথ্যে বলছে, আমি সত্য মিথ্যের ফারাক ধরতে পারি না।
- সবাই কেন মিথ্যে বলবে তোমার সাথে?
- সে কথা বাদ দাও, আমাদের দেখা হবে না কখনও? নাকি এই রাতের আঁধারে আমি শুধু আওড়াতে থাকব,
“যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনাদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।”
- দেখা তুমি যখন করতে চাও হবে। কিন্তু এত কঠিন কথা বার্তা বলা বাদ দাও। তোমার কবিতা আমি বুঝি না।
- এ কবিতা আমি লিখিনি। জীবনানন্দ দাশের লেখা। অথচ এই ভদ্রলোকের জীবনে মনে হয় না কোনো আনন্দ ছিলো। সারাটা জীবন বিষণ্ণতার কবিতা লিখে গেলেন, আমাদের বিষণ্ণ করার রশদ জুগিয়ে, নিজে ট্রামের নিচে পড়ে মরে গেলেন। কী অদ্ভুত জীবন!
- তুমি কি এখনও রাস্তা ঘাটে হেঁটে বেড়াচ্ছ? এত রাতেও? কোথায় আছ এখন?
- হ্যাঁ, রাতের ঢাকা আর দিনের ঢাকায় আকাশ পাতাল তফাৎ। জানো তুমি জীবনানন্দ সাহেব আমার জন্য আরও একটা কবিতা লিখেছেন, আজকের এই দিনের কথা ভেবে। শুনবে?
- শুনাও।
- “তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?”
শুধু কলকাতার জায়গায় ঢাকা হবে।
- সুন্দর কবিতা। এখন নিজের বাসার দিকে যাও।
- সে যাওয়া যাবে। আচ্ছা তোমার মনে আছে, প্রথম তোমাকে কী কারণে কে কষ্ট দিয়েছিল?
- না, মনে নেই।
- আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, বন্ধুত্ব জিনিসটা মাত্র বুঝতে শিখছি। শ্রেণিকক্ষে আমার পাশে বসা ছেলেটাকে আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বানিয়ে নিলাম। সে বন্ধুর জন্মদিনে আমি দাওয়াতও পেলাম, কাছের বন্ধু বলে কথা। বাবাকে বললাম, উপহার লাগবে। বাবা কোথা থেকে এক গল্পের বই যোগাড় করে আনলেন। বাবার হাতে তখন টাকা ছিলো না তবু। আমি আমার বন্ধুর বাড়ি চিনি না, যাই নি কখনও। কথা ছিলো আমার বন্ধু আমাকে দুপুরবেলার পর এসে নিয়ে যাবে, আমি বাড়ির সামনের মাঠে রাত অবধি অপেক্ষা করি, আমার বন্ধু আসে না। আমি চোখ ফুলিয়ে কাঁদি একা একা। প্রথম কষ্ট ব্যথা বোধহয় সেদিন বুঝেছিলাম। বাবা এসে আমাকে ঘরে নিয়ে যান। হাত মুখ ধুইয়ে ভাত খাইয়ে দেন। বলেন, হয়ত আমার বন্ধুটার কোনো ব্যস্ততা ছিলো তাই আসে নি। পরদিন যেন আমি উপহার দিয়ে দেই।
- তারপর?
- আমার বাবা সহজ সরল মানুষ ছিলেন, তিনি সরল করে ব্যাপারটা দেখেছেন। ব্যাপারটা সরল নয়। পরদিন স্কুলে এসে আমার সে বন্ধু ও ব্যাপারে কোনো টু শব্দ পর্যন্ত করে না। বেমালুম ভুলে বসে আছে, আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা। সবাইকে ওর জন্মদিনের উপহার দেখায় এক এক করে। আমি যে ওর জন্মদিনে যাই নি, এই ব্যাপারটা ওর কাছে কোনো গুরুত্বই বহন করে না।
- কী যে বলো তুমি। মাত্র ক্লাস টু’এর এক বাচ্চা, কী এমন বুঝে?
- ও হয়ত সঠিকটাই বুঝেছিলো, আমিই ভুল ভেবেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমি ওর পাশে বসি বলে ক্লাসে, আমিই ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আসলে আমাকে কিছুই ভাবত না, কিছুই না।
- বইটা দাও নি ওকে?
- দিয়েছিলাম। ও হাতে নিয়ে আমাকে শুধু ধন্যবাদ দিয়েই শেষ। আর কিছুই বলে নি।
- বুঝলাম, খুব দুঃখ পাবার মতন ঘটনা। তবে আমি বেশ আনন্দ অনুভব করতেছি, তুমি সহজ সরলভাবে কথা বলছ তাই। এই কাহিনীও আমাকে কবিতার ভাষায় বললে, তবে হয়েছিলোই।
- মানুষের কষ্ট গুলো আসলে সহজ সরলই। কবিতা মিছে মিছে কষ্টকে কঠিন ভাষায় প্রকাশ করে। সুখ জিনিসটাকে জটিল বলতে পারো এদিক থেকে। অনেক হিসাব নিকাশ কষতে হয়, কোন কারণে আনন্দ-সুখ পাওয়া উচিৎ। তাছাড়া সুখ জিনিসটা সবসময়ই ব্যয়বহুল। কোনো না কোনোভাবে অর্থের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু কষ্ট ব্যাপরটা একদম বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
- আসলেই। তাইতো চাইলেই মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়।
- তুমিও তো কষ্ট পাও। প্রথম তুমি কবে কষ্ট পেয়েছ কারও কাছ থেকে সে কথা মনে নেই, শেষবারেরটা মনে আছে?
- জানি না।
- সিন্থিয়া?
- বলো।
- আমি চাইনি তুমি মরে যাও। তুমি অভিমান জমাও, রাগ করো, আমি কিছুই চাই নি। কিন্তু এসব কিছু কেনো হলো?
ওপাশ থেকে উত্তর আসে না।
- আমি তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে এখন। কানে সেল ফোনটা নিয়ে। তোমার নাম্বার এখনও বন্ধ। তোমার বাসার ঠিকানা আমি জানতাম, মাঝে মাঝেই ঘুরে যেতাম, কখনও দেখা হয়েছিলো কি না, কিংবা চোখাচোখি আমি জানি না।
ওপাশের নীরবতা ভাঙে না। মৃত মানুষ কথা বলে না।
- তোমার সাথে কথা বলার সময় আমি বুঝতাম, তুমিও আমার মতন এ পৃথিবীতে প্রচণ্ড একা। যার আনন্দ বেদনার কথা বলার মতন কেউ নেই। শোনার মতন কেউ নেই। হয়ত আহামরি সুন্দরিও নও, তাই দেখা করতে চাও নি কখনও। আমিও আমার জীবনে অনেকবার মরে যেতে চেয়েছি, পারি নি। মরে যেতে সাহস লাগে, আমার সে সাহস কোনোকালে ছিলো না। তুমি রাগ করলে, কথা না বললে সোজা ছাদে চলে যেতাম। মরে যেতে চাইতাম, পারতাম না। আমি বুঝতাম, মরে যাবার ঠিক কিছু হয় নি। তবু আমার ইচ্ছে করতো। আবার আমি পিছিয়েও আসতাম।
সিন্থিয়ার নাম্বারটা এখনও বন্ধ।
- তোমার বান্ধবি যখন আমাকে তোমার মৃত্যু খবর দেয়, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি রাগের মাথায় বলেছিলাম, ইচ্ছে হলে মরে যাও। তাই বলে তুমি মরে যাও সত্যি, তা কখনও চাই নি। আমার মা তো ছেলেবেলা মরে গেলো, বাবাও চলে গেলেন আমার ঠিক এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে। এরপর থেকে আমাকে তিন চাচা ভাগে ভাগে রাখেন। এক বছর এই চাচা খরচ চালান, আরেক বছর ঐ চাচা। কী কথাগুলো আমাকে শুনতে হয়, তোমাকে বুঝাতে পারব না। বাবা নাম রেখেছিলেন দুরন্ত, মাথা উঁচু করে দুরন্তপানা করব তাই। কিন্তু মাথা নিচু করেই আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলাম। দিনে কয়েকবার করে মনে হয়, এই কথা গুলো শুনবার চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভালো। সিন্থিয়া আমার প্রিয় কবির একটা কবিতার কিছু লাইন শুনবে শেষ বারের মতন?
“ কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।”
একটা ট্রাক এসে চলে গেলো দুরন্তর উপর দিয়ে। চারপাশে ভীষণ হইচই জমেছে। দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
সিন্থিয়া এসে জানালার পাশে দাঁড়াল। জানালা সোজা বাহিরে প্রচণ্ড মানুষের ভিড়। কী হয়েছে জানে না ঠিক। মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছে, অনেকটা সময়। দুরন্তর উপর রাগ কমেছে। দুরন্তর নাম্বারটায় কল করে যায়, বন্ধ। একবার দুইবার নয়, অনেকবার। কোনো উত্তর আসে না।
রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসে আছে রিনি, কফির অর্ডার করেছে, চলে আসবে। সামনে বসা ছেলেটার সাথে অতি সত্বর বিয়ে। মোবাইলটা বেজে উঠল। সিন্থিয়া কল করেছে। বেজে চলল, ধরল না রিনি। সামনে বসা আহনাফ বলল, কে? রিসিভ করো।
- আরে না। আমার পাগলী এক বান্ধবি আছে। আর ওর একটা পাগলা বয়ফ্রেন্ড আছে। এদের যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ট। কিছু হলেই আমাকে জ্বালায়।
- ইমার্জেন্সি হতে পারে, রিসিভ করো।
- বাদ দাও। ওর বয়ফ্রেন্ডও কাল থেকে আমাকে জ্বালাচ্ছে। আমার পাগলী বান্ধবি না-কি ফোন অফ করে রেখে দিছে, ওকে না-কি মরে যেতে বলছে, মরে যাবে হ্যানত্যান। আমি মন খারাপের ভাব ধরে বলে দিছি, অলরেডি মরে গেছে, গলায় ফাঁস নিয়ে। বিশ্বাসও বোধহয় করছে, ওগুলা। এসব পাগল ছাগলদের সাথে চলাচল করা বিরাট মুশকিল। আমি তো কবেই এই মেয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতাম। কথা না বললেই হাত কাটে, হ্যান করে ত্যান করে। বিশাল ঝামেলা।
টেবিলের উপর কফি চলে এসেছে। ফেনা ওঠা গাঢ় খয়েরি রঙের কফি। অমন খয়েরি রঙের রক্ত শুকিয়ে আছে রাস্তার উপর। খয়েরি রঙের জানালার পর্দা সরিয়ে সে দৃশ্য দেখে যাচ্ছে এক নীরব দর্শক।
আঁধার জমাট বাধছে আকাশে, তারাদের ঢেকে দিচ্ছে মেঘের প্রলেপ। উঁকি দেয়া চাঁদ জানে না, এ শহরে কত রকম, কত ঢঙের কষ্ট নিয়ে মানুষ বেঁচে রয়। সে কষ্টগুলো চাঁদের আলোর প্রলেপে কখনও মলিন হয় না, বরং আরও জ্বল জ্বল করে। তবু সে জ্বল জ্বল করা ব্যথাদের খবর কেউ কখনও রাখে না।
- রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ২:৪৩