ভয় পেয়েছে নিশান। অনেক বেশি ভয়। ভয়ে হাত পা কাঁপছে। এমন হবার কথা না, তবুও এমন হল। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।দেয়ালে কারও ছায়া দেখেছে ও। ছোট একটা ছায়া। ঠিক নিমির সমান একটা ছায়া।নিমি কি তাহলে উঠে আসল? নিমি কি করে উঠবে? নিমি তো নেই। আর কখনও থাকবেও না। হাঁটবেও না, বসবেও না।গলা ধরে বলবে না, আব্বু মুখ থেকে পচা গন্ধ আসে।শায়লাকে মারার সময় বলবে না, আব্বু আম্মুকে মার কেন?শায়লার গয়না নিয়ে যাবার সময় বলবে না, আম্মু দেখলে রাগ করবে। রাতের শেষে ঘরে এসে আর দেখবে না, মেয়েটা জেগে আছে। মেয়েটা আর বলবে না, আব্বু আগের মত হয়ে যাও।
আগে যা করত তাও করবে না।
নানা আবদারে নানা কথা বলবেও না। বাবা বাবা বলে গলা জড়িয়ে ধরবে না।আঙ্গুলের সাথে আঙ্গুল মিশিয়ে বলবেও না, যাও তোমার সাথে আড়ি। মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়ে বলবে না, আব্বু কান গরম থাকলে আর ঠাণ্ডা লাগে না। কুট কুট করে কামড় দিয়ে, নিশানের জামার বোতাম ছিঁড়ে বলবেও না, বাবা ভাল লাগছে অনেক। খেতে বসে মুখে মাংসের টুকরা দিয়ে বলবে না, আব্বু খাও খাও। গোসল করে এসে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলবে না, ঠাণ্ডা লাগে আব্বু।তোমার সোয়েটারের ভিতরে যাব।খাতায় গোল গোল কয়েকটা, দাগ দিয়ে এসে বলবে না, আব্বু এইটা তুমি। আমি আঁকছি। জ্বর আসলে, ছোট হাতগুলো দিয়ে মাথায় হাত রেখে বলবে না, আব্বু আমার কষ্ট হয়, কান্না পায়। কখনও আর বলবে না, আমার আব্বু সবার চেয়ে ভাল।
সবচেয়ে বড় কথা আর কখনও বলবে না, তুমি আমার আম্মুকে মারলে কেন?
শায়লাকে মেরে ফেলেছে নিশান। নিজ হাতে।নিমির সামনে। নেশা করে এসে, কাঁপতে কাঁপতে সেদিন শায়লার গায়ে হাত তুলল।শায়লা বলে, তুমি আমাকে মারছ কেন? আমি কি করেছি?
কয়েকটা নোংরা বকা দিয়ে, নিশান আবার মারতে শুরু করে। জ্ঞান নেই কোন। কি করছে জানে না। তবে রাগ আছে। পেটে একটা লাথি দিয়ে, মাথাটা দেয়ালের সাথে অনেকক্ষণ আঘাত করে।একসময় নিঃশেষ করে যায় শায়লা। মৃত হয়ে যায় শায়লা।পিছনে দাড়িয়ে মেয়েটা কাঁদে। সে কান্নার শব্দ নিশানের কানে আসে না।নিশান তখন নেশার ঘোরে। অন্য ভুবনে। এই ভুবনে শুধুই সুখ। কোন দুঃখ নেই। পরদিন সকালে উঠে নিশান নিজেই কাঁদে, বউয়ের লাশ জড়িয়ে। বাড়ির পিছনে কবর খুঁড়ে পুতে দিয়ে আসে।মেয়েটা আর কথা বলে না নিশানের সাথে। শুধু বলে, তুমি আমার আম্মুকে মারলে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর নিশান জানে না। তবে বুকের ভিতর খুব কষ্ট হয়। নিজেকে বড় অপরাধী লাগে।খুব অসহায় লাগে। কষ্ট এতো কষ্ট। এই কষ্ট থেকে রেহাই দিতে শুধু একটা জিনিসই। আবার সন্ধ্যায় মেয়েটাকে একা বাসায় রেখে, চলে যায় নিশান। কষ্ট থেকে রেহাই খুঁজতে। সুখের ভুবনে। অন্য ভুবনের সন্ধানে।
রাতে ফিরে আসে, সুখী মানুষ হয়ে। নেশা করে। কত সুখ। এই সুখের দুনিয়ায় শুধু নিশান একাই রাজা। সব নিশানের। সব সুখ নিশানের। মেয়েটা আবার এসে বলে, তুমি আমার আম্মুকে মারলে কেন?
বাম হাতে ডান গালে একটা থাপ্পড় মারে নিশান। মেয়েটা পড়ে যায়। খুব বেশি বুঝে? রাগ চেপে যায় মাথায়। একই ভাবে দেয়ালের সাথে, মাথা আঘাত করে নিশান মেয়েটার। নিমি কাঁদে, চিৎকার করে। শেষ বার শুধু বলে, বাবা।
নিশান তখন অন্য ভুবনে। সুখের ভুবনে। এই সুখের দুনিয়ায় বউ লাগে না, মেয়ে লাগে না। বাবা ডাক শুনতে হয় না। তাই কানে যায় না। নিমিও লুটিয়ে পড়ে। নিশান ঢলে পড়া চোখে, মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ির পিছনে পুতে রেখে আসে।
এসে বসে থাকে চুপচাপ।আর হঠাৎ ই ছায়াটা দেখে নিশান। নিমি কি করে উঠে আসবে? নিমি মৃত। তবে নিমির সমান ছায়া দেখল যে নিশান? তা কি মিথ্যা? হবার কথা না। স্পষ্ট দেখেছে নিশান। পিছন ফিরে তাকাতে ভয় করছে। হয়ত দেখবে, রক্তাক্ত নিমি দাড়িয়ে আছে পিছনে। আস্তে আস্তে নিশানের দিকে এগিয়ে এসে বলছে, তুমি আমার আম্মুকে মারলে কেন?আমাকে মেরেছ কেন?
আবার এমনও তো হতে পারে, নিমি এসে নিশানের গলা জড়িয়ে ধরবে। আজ বড় ঠাণ্ডা। এসে কান টুপি পরিয়ে দিবে। বা জড়িয়ে ধরে বলবে, আমার বাবা সবার চেয়ে ভাল।
নিমি এসব বলবে না, নিশান জানে। নিশান ভাল না।অনেক খারাপ। নিমির কাছে মাফ চাইতে হবে। নিশান মাফ চাইবে।শায়লার কাছেও মাফ চাইতে হবে। নিশান ভাল হতে চায়। এই সুখ নিশান চায় না। নিমি আর শায়লাকে নিয়ে সুখ চায়। পিছন ফিরে তাকাল নিশান। একটু আগে ছায়া দেখেছে নিমির। এখন নিমিকে দেখবে। মাফ চাইবে। কিন্তু পিছনে কিছু নেই। নিমি কোথায় তাহলে? ছায়াই বা আসল কোথা থেকে? একটু নিচে চোখ পড়তেই দেখল, একটা পিচ্চি পুতুল। তার ছায়া নিমির সমান হয়ে গিয়েছে। এতো ছোট পুতুলের এতো বড় ছায়া।
ছোট জিনিসের ছায়া অনেক বড়। খুব চোখে বাধে। বড় জিনিসের ছায়া অসীম। শুধুই অন্ধকারে আলাদা করে ছায়া দেখা যায় না। ভেবে নেই, ছায়া নেই কোন ছায়া নেই। এই অন্ধকারের ভুবন হয়ত অনেক সুখের। ছোট জিনিসে বড় ছায়া দেখে, ঘাবড়ে গিয়ে, অসীম অন্ধকারে হারাই আমরা। বড় ছায়া যে কেবল, অনেক আলোতেই হতে পারে ভাবি না। আলো খুঁজি না। শুধু ছায়া দেখি। নিমি, শায়লার একটু খারাপ কথা বড় করে লাগল, নিশানের। ভালবাসা বড় লাগে না। এই খারাপ কিছু থেকে বাঁচতে, নেশার অন্ধকারে ডুব দেয় নিশান। সেখানে ছায়া নেই। তবে সবটুকু যে অন্ধকার, নিশান তা বুঝে না। সব হারিয়ে আলো খুঁজে নিশান। আলো যে আর পাবে না।
ভেবে দেখা উচিৎ, ছায়া হতে আলো লাগে। ছায়ার চারপাশে আলো থাকে। ঠিক তেমনি, একটু কষ্টের কারণে পুরো জীবন কষ্টের ভাবতে নেই।আশেপাশেই সুখ। সুখ খুঁজতে হয়। কষ্ট থেকে বাঁচতে, অন্ধকারে ডুব দিতে নেই। তবে সব হারিয়ে যায়। আলো নিভিয়ে দিতে নেই। নিজেকে সুখী ভাবতে হয়। জীবনে এই ভাবনাটুকুই আলো। এই আলো সব আঁধার ঘুচিয়ে দিতে পারে।