দৃশ্য-১
স্থান: বৌদ্ধ মন্দিরের সামনের বাড়ী
সময়: সকাল ০৯:৩৫
প্রতিদিনই বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে হাসির।
ঘুমায়ও বেশ রাতে। অগোছালো ব্যাচেলার জীবনের মূর্ত প্রতীক হয়ে রাত জাগে নানান স্বপ্নের আলোড়নে। ভাইটা সকালে বেরিয়ে যায় কাজে, তারপর কোনরকমে দরজা লাগিয়েই এসে আবার কাৎ।
আজ কিন্তু সাত-সকালেই ঘুম ভাঙলো হাসির। দরজা ধাক্কানোর বিকট ধুম্ ধুম্ শব্দে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলেই হকচকিয়ে যায় সে। তার সামনে ইউনিফর্মধারী ৬/৭ জন পুলিশ। হাতে তাদের ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র।
পুলিশদের একজন “আমরা রেকি করতে এসেছি” বলেই ঘরের মালিকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘরের ভেতর সবুট ঢুকে পড়ে পুলিশটা। একে একে ঘর-রান্নাঘর-বাথরুম ঢুঁড়ে দুইজন পুলিশকে অবস্থান নিতে বলে বেরিয়ে যায়। একজন বুট পায়েই উঠে যায় খাটের ওপর। খাটের ওপর এলোমেলো কাঁথা-বালিশ-মশারি সরিয়ে অবস্থান নেয় জানালার ধারে। আরেক পুলিশ তখন চলে গেছে বারান্দায়।
আর এদিকে ঘরের মাঝখানে তখনও দাঁড়িয়ে হাসি।
কিংকতব্যবিমূঢ়।
*
দৃশ্য-২
স্থান: বৌদ্ধ মন্দিরের পিছনের বাড়ী
সময়: সকাল ০৯:৪০
অনেক দেরী হয়ে গেছে হাসানের।
অনেক দেরী।
সকাল ৯টায় দেখা করার কথা মিতা’র সাথে, আর এখন ন’টা চল্লিশ!
নিশ্চয়ই রেগে একেবারে বোম হয়ে আছে --ভাবছে হাসান। কিভাবে ম্যানেজ করা যায় প্রিয়তমাকে তারই কিছু ফন্দি ভাবতে ভাবতে দ্রুতহাতে শেভ্-টেভ্ শেষ করতে থাকে।
নিজেই নিজেকে গালি দেয়-- ব্যাটা হারামজাদা, কেন রাতে জেগে জেগে সিনেমা দেখতে গেলি? জানিস, সকালে ডেটিং আছে। দেরী হলে কেমন ক্ষেপে যায়, জানিস না? ব্যাটা উল্লুক!
হঠাৎ ধিম্ ধিম শব্দে চমকে বাস্তবে ফিরে আসে হাসান। টিনের দরজায় কে যেন বাড়ি দিচ্ছে ভারী কোন কিছু দিয়ে। মনে মনে আগন্তুকের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে দরজা খোলে হাসান। আর খুলেই থমকে যায় বিস্ময়ে।
তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ৬/৭ জন পোশাকধারী পুলিশ। তাদের পেছনে আবার দুইটা কালো পোশাকও দেখা যাচ্ছে! মানে র্যাবও আছে।
হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন ভীষণ দুর্বল মনে হয় হাসানের।
মাথা ঘুরে ওঠে।
মাত্র রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে সে, সপ্তাহখানেকও হয়নি। আর এরইমধ্যে পুলিশ হাজির! কিন্তু সে তো কোনও খারাপ দলের যোগ দেয়নি। যোগ দেয়নি কোন ধর্মব্যবসায়ী বা ঘাতক-দালালের নিষিদ্ধ দলে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র সে। অনেক ভেবে-বুঝে তবেই না যোগ দিয়েছে বাম মোর্চায়। আর তাছাড়া কোন অঘটনও ঘটায়নি সে এখনও।
তাহলে?
হঠাৎ তার মনে পড়ে, গত ২০০১ সালে তার এক বড় ভাইকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিলো ঘরে খেলনা পিস্তল রাখার অপরাধে। দুই দিন পর ‘ক্রসফায়ার’ -এ মারা যায় সে। মাঝ রাস্তায় গুলি খেয়ে পড়ে ছিলো ছেলেটি। আর তার হাতের পাশে, রাস্তায়, পড়ে ছিলো সেই ভয়ঙ্কর(!) পিস্তলটি। দেশের সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় তোলে ঘটনাটা। আলোচনার ঝড়ও ওঠে। কিন্তু শেষমেশ দিন সাতেকের মধ্যেই সবাই ভুলে যায় এক্কেবারে। মনে পড়ে তার লিমনের কথা। র্যাবের বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় ক্রসফায়ারের শিকার হয় কলেজছাত্রটি। পা হারিয়ে যখন চিকিৎসার জন্য দোরে দোরে ঘুরছে ঠিক তখনই আবার শিকার হয় পুলিশের সোর্স অর্থাৎ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী-মাদক ব্যবসায়ীদের আক্রমণের। তার নিজের ঘরে ডাকাতি হলেও ডাকাতির মামলায় আসামী করা হয় পঙ্গু লিমনকেই। সংবাদকর্মীরা যখন প্রতিবাদের চেষ্টা করে, নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায় না তারাও। বাতাসে কথা ভাসে-- প্রশাসনের দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করার শাস্তি হিসেবেই খুন হয়েছেন এক সাংবাদিক দম্পতি; বছর ঘুরলেও কিনারা হয়নি যে কেসের, পুলিশ ‘চোরতত্ত্ব’ বানিয়ে যেখানে ‘আসামী’ খুঁজে চলেছে হাওয়ার দুনিয়ায়।
হঠাৎ খেয়াল করে হাসান, তার এই ভাবনা-চিন্তার ফাঁকে কখন যেন বেদখল হয়ে গেছে তার ঘরখানা। দুই পুলিশ অবস্থান নিয়েছে শোবার ঘর আর রান্নাঘরের জানালায়। কেমন যেন সন্দেহভরা চোখে হাসানকে দেখছে এক পুলিশ। এস.আই বা এরকম কিছু হবে বোধহয় লোকটা। অবরুদ্ধ দালানের ফাঁকে এক চিলতে আকাশ দেখার ছোট্ট আঙ্গিনাটায় দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে হাসানের দিকে।
ক্রিং ক্রিং। হ্যালো।
মোবাইল বাজছে হাসানের। ফোন দিয়েছে মিতা।
কী বলবে সে এখন তাকে?
*
দৃশ্য-৩
স্থান: বৌদ্ধ মন্দিরের পাশের বাড়ী
সময়: সকাল ১০:৫৫
কম্পিউটারের সামনে বসে আছে রুদ্র।
রুদ্র পেশায় সাংবাদিক।
নিজের পেশাকে নিয়ে বেশ গর্ব করে রুদ্র। জনসেবার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্য্যকরী মাধ্যম সংবাদমাধ্যমের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে গর্ব হতেই পারে তার। বিশেষ করে যেখানে লোভ আর ভীতিকে জয় করে টিকে আছে এতোদিন --গর্ব তো তার সাজেই।
পাশে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে বসে আছে সোনিয়া। ভয় আর অজানা শঙ্কায় পাংশু সোনিয়ার গোল মুখ। মৃদু গলায় প্রেয়সীর ভয়টাকে ভুলিয়ে রাখতে আশপাশের যন্ত্র-প্রটোকল-সান্ত্রী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছে রুদ্র।
সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর মাথায় সান্তনার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এলোমেলো ভাবনায় হারিয়ে যায় রুদ্র।
সকালবেলা ওদের দুই রুমের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা বেদখল হয়ে গেছে। পুলিশ আর এস.এস.এফ’র কয়েকজন অপারেটর বসে আছে তাদের ফ্ল্যাটে।
প্রায় এক ঘন্টা আগে এসেছে ওরা। খুব ভদ্রভাবে স্পেশাল ফোর্সের তরুণ ডেপুটি ওদের জানিয়েছে-- “অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার আসবেন বৌদ্ধ মন্দিরে, বুদ্ধমূর্তি উদ্বোধন করতে। তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে আশপাশের ভবনগুলোতে অবস্থান নিচ্ছি আমরা। যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ফ্ল্যাটটাকে আমরা ব্যবহার করবো ঘন্টা খানেকের জন্য।”
না, কিছু মনে করেনি রুদ্র। আসলে মনে করলেও তা প্রকাশ করার উপায় কী আছে তার? না, নেই। শত হোক, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলে কথা। ‘মনে করলে’ যদি বিরোধী পক্ষ ঠাউরে বসে তাহলে তো বে-দম হতে হবে নির্ঘাৎ। তাই কোনও কথা না বলে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদের হাতে। কিছুক্ষণ তরুণ ডেপুটির সাথে সৌজন্যমূলক আলাপ শেষে নিজেরা ঠাঁই নিয়েছে ভিতরঘরে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে, মাত্র পরশু দিন এক সংবাদ সম্মেলনে দেয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য-- “বাংলাদেশে এখন আর কোন জঙ্গী নেই। দেশের আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দল কিছু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলেও আইন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছে। মানুষজন নিশ্চিন্তে এখন ঘরের বাইরে যেতে পারছে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটা প্রশ্ন জাগে রুদ্র’র অপরিপক্ক মনে-- আচ্ছা, যদি দেশের সবাই নিশ্চিন্তে ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারে, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর এতো দুঃশ্চিন্তা কিসের নিজের নিরাপত্তা নিয়ে? কিসের এতো ভয় তার? তিনি কী বিশ্বাস করেন না তাঁর নিজেরই মন্ত্রীকে?
এদিকে মনে মনে তার ছোট্ট বাসায় বসানো নিরাপত্তা-ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে সোনিয়া। প্রায় সবকিছুই নতুন ওর কাছে। জীবনে সে দেখেনি এসব জিনিষ। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে রুদ্র তাকে পরিচিতি দিয়েছে সব কিছুর। জানিয়েছে, প্রায় দেড় শ’ পোশাকী সদস্যবিশিষ্ট একটা দল কাজ করছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে। এছাড়াও আছে গোয়েন্দা বিভাগের শ’ খানেক সদস্য। আরও জানিয়েছে, ঐ যে সদ্য-যুবক ডেপুটিটি বসে আছে ওঘরে, ওর এক মাসের সরকারী রেশন দিয়ে সোনিয়াদের মতো তিনটি পরিবার চলতে পারে অনায়াসে। আর যে অস্ত্রগুলো নাক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, ওগুলোর দাম দিয়ে সারা বছর বিনামূল্যে শিক্ষাদান করা যায় দেশের সব অশিক্ষিত ছেলে-মেয়েকে।
ওদের বসার ঘরে একটা ফ্রিকোয়েন্সি মনিটরিং সেকশন বসিয়েছে এস.এস.এফ। ওখানে বসে ওরা পর্যবেক্ষণ করছে আশপাশের সব কল্। কোন সন্দেহজনক ফোনকল্ হয় কিনা দেখছে তারা। তাই ওঘরে ঢোকা বারণ ওদের।
এদিকে তাদের শোবার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক র্যাব সদস্য। কালো চশমার ভেতর দিয়ে দেখছে বাইরের পরিস্থিতি।
আচ্ছা, আসলেই কী বাইরেটা দেখছে? তাহলে কেন এরকম অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে সোনিয়ার? কেন মনে হচ্ছে, তার শরীরের অনাবৃত অংশটুকু চোখ দিয়েই চেটে চেটে পরখ করছে কেউ? আরও জড়সর হয়ে স্বামীর কোল ঘেঁষে বসে সোনিয়া। জীবনসঙ্গীর শরীর দিয়েই আড়াল করতে চায় নিজেকে।
হঠাৎ মুহুর্মুহু বাঁশির আওয়াজে সরব হয়ে ওঠে চারপাশ। জানালার সামনে দাঁড়ানো র্যাব সদস্যও নড়েচড়ে দাঁড়ায়।
প্রধানমন্ত্রী এসেছেন।
সরকার-প্রধান এসেছেন।
রুদ্র আর সোনিয়া যেখানে বসে আছে সেখান থেকেই বেশ দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বাইরে তাকাতেই মনটা দারুণ বিষন্ন হয়ে যায় রুদ্র’র। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার এক সরকার-প্রধান এসেছিলেন তাদের এলাকায়। তাঁর চলার পথে, চারপাশের বিল্ডিংগুলোতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আর জয়ধ্বনি করে অভিনন্দন জানিয়েছিলো সাধারণ জনগণ। আর আজ? যতোদূর চোখ যায় কোন বাড়ীতে, কোন ছাদে একটা মানুষও নেই। তার বদলে মাঝেমাঝেই ঝলসে উঠছে হেলমেট আর বন্দুকের নল।
মনে পড়ে মাত্র সপ্তাহ আগে শেষ হওয়া আন্তর্জাতিক নাগরিক সম্মেলনের কথা। সেখানে অংশগ্রহণ করা ব্রাজিলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ল্যুলা ডি সিলভা’র কথা। প্রটোকল ছাড়াই যিনি ঘুরে বেড়ান তার দেশের আনাচে কানাচে। প্রশ্ন জাগে রুদ্র’র মনে-- আচ্ছা, তাঁর কী কোন শত্রু নেই? মৃত্যুভয় কী কম্পিত করে না ল্যুলা’র হৃদয়কে? তিনি কী ‘অমর’ ধরনের কিছু? যদি তা না হবে তাহলে কোন্ সাহসে তিনি সান্ত্রী-যন্ত্রীময় প্রটোকল ছাড়াই ঘুরে বেড়ান গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ব্রাজিলের পথে পথে? তাহলে একেই কী বলে দেশপ্রেমের জোর? এরকমই কী হয় জনগণের নেতা?
হঠাৎ কেন যেন ভীষণ আতঙ্ক ভর করে রুদ্র’র উপর।
ভীষণ আতঙ্ক!
ঘড়িতে তখন দুপুর ০১:৫৬।
------------------------------
মূল রচনাকাল: ২৩/০২/২০১১; ১৭:০৫।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:০২