উৎসবের মতো মানুষের জন্য রান্না-বান্না সত্যিই খুব ঝামেলার বিষয়।
যদিও তার খাবার তালিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় হিন্দী সিনেমার নায়িকাদের পোশাকের মতোই সংক্ষিপ্ততর, তবুও সারাদিনের দৌড়-ঝাঁপ শেষে রাত এগারোটায় ঘরে ঢুকে পরিকল্পনা করা, তারপর রান্নার জোগাড় করে তা বাস্তবায়ন করা –এ এক বিকট বিরক্তিকর বিষয় বলেই মনে করে উৎসব।
কিন্তু কীইবা করার আছে। ঝামেলা যতোই হোক, বাঁচতে হলে খেতে তো হয়ই।
প্রতিদিনের মতো আজও তার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সময়টা মধ্যরাতের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। ক্লান্ত শরীরটা সরাসরি বিছানায় এলিয়ে পড়তে চাইলেও পেটের মধ্যে চলা ইঁদুরের সংকীর্তন তাকে বাধ্য করলো রুটিনমাফিক হাত-মুখ ধুয়েই হেঁসেলে ঢুকতে। মনে মনে ঠিক করেছে, আজ আর বলিউড না, একেবারে হলিউডি মেনুতে ডিনার সারবে ও– কলা-দুধ-ভাত। গত তিন দিনের সব রান্নাই নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া এখন আর নতুন কিছু রাঁধার ইচ্ছেও করছে না। তাই ঝামেলাহীন শর্টকাট রান্নার চিন্তা।
চুলায় ভাত চাপিয়ে এসে টিভি চালু করলো ও। প্রথমেই হিস্টোরি টিভি। মানুষের মস্তিষ্ক কতো অদ্ভূত কাজ করতে পারে তা নিয়ে একটা প্রোগ্রাম চলছে টিভিতে। আমরা কতো সহজেই ভুল করি মেমোরি নামক বিষয়টাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে, কিভাবে জাতিস্মর হিসেবে দাবীকারী মানুষেরা মূলতঃ হ্যালুসিয়েশনে আক্রান্ত হয়ে শোনা অতীতের সাথে দেখা বর্তমানকে মিলিয়ে-মিশিয়ে পুনর্জন্মের মতো অবাস্তব থিওরী তৈরী করে এসব নিয়ে চমৎকার একটা সিরিয়াল। যদিও আগেই দেখা এই পর্বটা তবুও কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়েই দেখলো ও। তারপর স্বভাবমতো শুরু করলো চ্যানেল সার্ফিং। এই চ্যানেল ঐ চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে আবার শুরুতে। নাঃ। দেখার মতো তেমন কিছুই নেই কোথাও।
টিভিটা বন্ধ করে আবার রান্নাঘরে। ভাতটা বোধহয় হয়ে গেছে এতোক্ষণে।
এবার ভাত নামিয়ে দুধের হাঁড়ি চুলায় চাপানো। তারপর বসে বসে ডিম-পাড়া মুরগীর মতো ঝিমানো।
উৎসবের টিন-চালা ঘরটা একটা মন্দিরের পাশে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া। তার উপরে উদাত্ত আকাশ। গম্বুজের মতো চূড়ার উপরে আকাশের দিকে যেন সবকিছু ধ্বংস করার জান্তব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তীক্ষ্ম ত্রিশূল।
নির্মেঘ আকাশে মিটিমিটি জ্বলছে রাতের প্রহরীরা। এখনও দেখা নেই চাঁদমামার।
আজ কী অমাবশ্যা? কে জানে।
থাক্, চাঁদ না থাক্, তারারা তো আছে। আর আছে আঁধার রাতের আকাশে ছায়াশরীর নিয়ে ভেসে বেড়ানো মেঘের দল।
উৎসব একমনে দেখতে থাকে আকাশ। হঠাৎ মনের কানে বেজে ওঠে নাম-না-জানা কবিতার লাইন– “আকাশ যতো মহোত্তর, পাহাড় ততো নয়…..”।
আসলে তো তা-ই। ছোট্ট পৃথিবীকে ঘিরে থাকা নীল আকাশ যেন স্নেহবৎসল মায়ের মতোই বুক দিয়ে আগলে আছে শিশু পৃথিবীকে। জগতের সব আক্রমণ থেকে সন্তানকে বাঁচাতে চায় নিজের জীবনের বিনিময়েও।
সন্তান। মা। শব্দ দু’টি মনে পড়তেই উৎসবের মনে পড়ে অন্য কিছু।
এই আকাশের নীচে, এই মাটিরই বুকে এক মা তার দশ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে পথ চেয়ে বসে আছে স্বামীর অপেক্ষায়। হয়তো অন্ধকার কোন ঘরে বসে প্রহর গুণছে আর আকাশ-পাতাল কল্পনায় ব্যতিব্যস্ত করছে নিজেকে। হয়তো নিজেকেই দুষছে সব কিছুর জন্যে।
না, তার স্বামী “আবার আসবো ফিরে মাকে সঙ্গে করে” বলে দেশ বাঁচানোর ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ্য করে হারিয়ে যায়নি কখনো।
তাহলে কী অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে আততায়ীর হাতে (যেমনটা প্রতিদিন হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে)?
না। তা-ও নয়।
আজ আট মাস ধরে বাড়ী ফেরেনি স্বামী। একবার ফোন করেও খবর নেয়নি স্ত্রী কিংবা সন্তানের। প্রতিদিন বারবার ফোন করার পরেও ধরেনি স্ত্রী কিংবা শ্বশুড়বাড়ীর কারও ফোন। অন্য নম্বর থেকে কল্ করার পর একবার ধরলেও স্ত্রীর পরিচিত গলা শুনেই কেটে দিয়েছে লাইন। এর পর আর ধরেনি অপরিচিত কোন নম্বরও।
এদিকে বাড়ীওয়ালা নোটিশ দিয়েছে ঘর ছেড়ে দেয়ার জন্য। ভাড়াও যে বাকি তার। তাই ঘরের আসবাব সব বাড়ীওয়ালার হাতে দিয়ে খালি হাতে রাস্তায় নেমেছে স্ত্রীটি। সাথে তার দশ মাসের ছেলে।
কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোণে কালি পড়েছে স্ত্রীর। নিজের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী-ননদের পা ধরে ভিক্ষা চেয়েছে দয়া। “দয়া করে আমার স্বামীকে বলেন একবার ফিরে আসতে। আমি সবকিছু মেনে নেবো, শুধু আসতে বলেন একবার” বলেছে সে। কিন্তু কেউ শোনেনি তার আকুতি।
শেষমেশ আবার ফিরে গিয়েছে বাবা-মা’র আশ্রয়ে। কী করবে না গিয়ে? যাবার যে কোন জায়গাই নেই আর। যে বোন-দুলাভাই আর খালা-খালু ‘ধর্ম আর মান বাঁচানোর জন্যে’ তাকে ধরে-মেরে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলো মাঝবয়সী উকিলটির সাথে, সেই ‘পরম আত্মীয়’রাও যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বলেছে– “তোর সমস্যা তুই সমাধান র্ক। আমরা কী করবো এতে? আমাদের নিজেদের ঝামেলা নিয়েই পারছি না, তোর উটকো উৎপাত সইবে কে?”
সত্যিই তো, ওরা আর কী করবে? কেনইবা সইবে পরের ঝামেলা? নিজের ভালোবাসা আর স্বপ্নকে গলা টিপে ‘আত্মীয়দের’ কথামতো বিয়ের পিঁড়িতে বসলেই কী সবার মান রাখা যায় এই জগতে?
নিজের গর্ভজাত মেয়ে বলে ফেলতে পারেনি শুধু বাবা-মা। সকাল-বিকাল নিয়ম করে নানান খোটা শোনালেও অন্ততঃ থাকতে আর খেতে তো দিয়েছে!
এই অসহায় অবস্থায় স্ত্রীটির মনে পড়ে তার প্রেমিকের কথা– “সবকিছুই স্বার্থ নিয়ে চলে। পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য কিছু করে না বিনা স্বার্থে। যাদেরকে আত্মীয় বলে মনে করো, দেখো তারাই তোমার বিপদে মুখ ফিরিয়ে নেবে সবার আগে”। আরও বলেছিলো– “নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো। কতো দিন অন্যের দয়ায় চলবে জীবন?” হাতে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও করে দিয়েছিলো। অবশ্য পড়াশোনা আর হয়নি। হিন্দু ছেলের সাথে প্রেম করার অপরাধে প্রথমে গৃহবন্দী হয়েছে, তারপর সবাই মিলে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে চৌদ্দ বছরের বড় এক দুঁদে উকিলের সাথে। হয়তো ভাবনায় ছিলো, যদি পেশায় সাংবাদিক প্রেমিকটি কোন ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করে তাহলে আইনের প্যাঁচে ফেলে ঠিকই তাকে ঢিঁট করবে উকিল জামাই।
তবে ঝামেলা করেনি প্রেমিকটি। যখন জেনেছে, স্বেচ্ছায়ই বিয়ে করেছে প্রেমিকা, নিজেকে আস্তে করে গুঁটিয়ে নিয়েছে প্রেমিকপ্রবর। বুকে পাথর বেঁধে ফিরে গিয়েছে নিজের জগতে। সে এখন চলে বিপদের সাথে পাল্লা দিয়ে। সর্বহারা জীবন হয়তো সেখানেই খুঁজে ফেরে সার্থকতা; কিংবা হয়তো অন্য কিছু।
দুধ পোড়ার গন্ধে বাস্তবে ফিরে আসে উৎসব।
হাত বাড়িয়ে চুলাটা নিভিয়ে দিয়ে একটা ঢাকনি দিয়ে দেয় হাঁড়ির উপর। তারপর সযত্নে পরিষ্কার করে নেয় চুলার চারপাশ।
সদ্য বাড়া ভাতগুলো আবার হাঁড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে।
টেবিলের উপর থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া বেনসনের প্যাকেট থেকে একটা নিকোটিনের কয়েল ধরিয়ে টান দেয়।
উৎলে ওঠা দুধের মতোই কী যেন উৎলে উঠছে ওর চোখের কোণে।
সিগারেটের ধোঁয়ায় নাকি ভীষণ অভিমানে ঝাপসা ওর দৃষ্টি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:১১