ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। সাধারনত এসময়ে ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণ করে থাকে। এটি কোমলমতি শিশুদের বেশি আক্রমণ করে। ফলে এর তীব্র প্রকোপে শিশুরা মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। অনেকেই আবার মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। তবে একটু সচেতন হলেই এ ভয়াবহ জ্বর থেকে নিজেকে ও শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব।
আজ ডেঙ্গু জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, প্রতিকার এবং এর নানা প্রাসঙ্গিক দিক নিয়েই থাকছে আমাদের আলোচনা।
যেভাবে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর: ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়াই ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামক এক ধরনের মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
সময়কাল: মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রকট। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে।
যেসব জায়গায় প্রাদুর্ভাব বেশি: সাধারণত শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কারণ ওইসব অঞ্চলের অভিজাত এলাকার নালা নর্দমা ও বড় বড় দালান কোঠা ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার প্রকোপ বেশি থাকে। তবে বস্তি বা গ্রামের বাসিন্দাদের এটি কম সংক্রমণ করে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ: ডেঙ্গু জ্বর প্রধানত দুই প্রকার। এক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর। দুই. হেমোরেজিক জ্বর।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফেভার’। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ। এগুলো অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমিবমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এর দুই বা তিনদিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফেভার’ বলে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের লক্ষণ: এই অবস্থাটা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়- শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সাথে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে। মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকে। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াভহ রূপ: ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াভহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফেভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো-রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া। শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এই জ্বর হলে কী করা উচিত: আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার নেই, এতে অযথা অর্থের অপচয় হয়। এজন্য জ্বরের চার থেকে পাঁচদিন পরে সিবিসি এবং প্লাটিলেট করাই যথেষ্ট। এছাড়া প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষাগুলো যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করা যেতে পারে। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী ডিআইসি জাতীয় জটিলতায় আক্রান্ত; সেক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করতে পারেন।
চিকিৎসা: ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে এই জ্বর সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসা যথেষ্ট। তবে নিম্নক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। যেমন: শরীরের যেকোনো অংশে রক্তপাত হলে। প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে। শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি আসলে। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে। জন্ডিস দেখা দিলে। অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।
করণীয়: এ রোগ এমনি এমনি সেরে গেলেও রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। ডেঙ্গু জ্বরটা আসলে গোলমেলে রোগ। সাধারণত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। খেতে না পারলে দরকার হলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল-জাতীয় ব্যথার ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথার ওষুধ কোনোক্রমেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।
প্রতিরোধ: ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায়, বড় বড়, সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বসবাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০১