মাত্র পাঁচজন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের হয়ে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়! পাঁচজনেই সামাল দিয়েছেন বিশাল এক যুদ্ধ!
যতদূর জানা যায়, ১৯৭১ সালে বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা এই পাঁচজন বাঙালিই ছিলেন এই প্রশান্তপাড়ের দেশটায়। কিন্তু মাত্র এই পাঁচ বাঙালির আন্দোলন অস্ট্রেলিয়ার সমাজে এত সাড়া ফেলেছিল যে, দেশটার গোটা সিভিল সোসাইটি, মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বক্তৃতাসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ব্যানার টানানো হয় অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রেল স্টেশন, বাস টার্মিনালে।
এসবের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড।
নজরুল ইসলামকে বলা হয় এই পাঁচ বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার অঘোষিত লিডার অথবা সেক্টর কমান্ডার। এদেশের বাঙালি সমাজে নজরুল ইসলামের আরেক নাম আছে, ‘অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালির ক্যাপ্টেন কুক’!
সাগরে ভাসতে ভাসতে একদিন সভ্য পৃথিবীর কাছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন কুক। পেশায় জুওলজিস্ট নজরুল ইসলামও অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নিয়ে আসা প্রথম বাঙালি। ১৯৭০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি এসে পৌঁছেন মেলবোর্ন।
স্ত্রী ইয়াসিন ইসলাম, দুই শিশু সন্তান অমিতাভ ইসলাম, মেয়ে নাদিয়া ইসলামকে নিয়ে সেখান থেকে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসেন সিডনিতে। নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চার জন বাঙালি ছাত্র পড়তেন। এরা সবাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে এসেছিলেন। সে কারণে সিডনি এসে প্রথম কেনজিংটনে বাসা নিলেও এই বাঙালি সান্নিধ্যের জন্য বাসা বদল করে বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া র্র্যান্ডউইকে চলে আসেন। এই প্রবাসী ছাত্রদের আসা-যাওয়ায় নজরুল ইসলামের ভাড়া বাড়িটিই হয় সিডনির প্রথম বাঙালি ভূবন।
দেশের অবস্থা তখন ভালো যাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃ্ত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছিল সামরিক জান্তা। এর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে বাঙালি। দেশজুড়ে চলছে উত্তাল আন্দোলন। কিন্তু প্রতিদিন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন।
আজকের মতো টেলিযোগাযোগ তখন স্বপ্নের বিষয়। দেশের আপডেট খবরের জন্য তখন এবিসি রেডিও আর অস্টেলিয়ার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াই ভরসা। বিশেষ একটি কারণে ঢাকার প্রতিদিনের তাজা খবর চলে আসছিল অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় প্রতিদিন।
জিম অ্যালেন তখন ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার। হোটেল পূর্বানিতে তার অফিস। ভদ্রলোক বাংলা জানতেন। তাই স্থানীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতির খবর বুঝতে পারতেন ভালো। অস্ট্রেলিয়ান একজন সাংবাদিক ওই সময় অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। স্বদেশি জিম অ্যালেনের বাংলার ওপর দখল থাকায় সর্বশেষ পরিস্থিতির আপডেট জানতে-বুঝতে তার সুবিধা হচ্ছিল।
২৫ মার্চের গণহত্যার পরপর পাকিস্তানি জান্তা বিদেশি সব সাংবাদিককে বের করে দেবার সময় জিম অ্যালেন সাহস করে বিশেষ একটি কাজ করেন। কৌশলে ওই সাংবাদিককে হোটেল থেকে বের করে তার বাসায় নিয়ে যান। এ কারণে অবরুদ্ধ সেই সাংবাদিক বাংলাদেশের ভিতরে থাকায় সর্বশেষ পরিস্থিতির তাজা খবরা-খবর পেতে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া’র বিশেষ সুবিধা হয়।
দুটি কারণে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া ও জনমত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সিরিয়াসলি নেয়। প্রথমে নির্বাচনে একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও তাকে ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে না, এটি তাদের কাছে অস্বাভাবিক, অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়। এরপর ২৫ মার্চের গণহত্যার বীভৎস বৃত্তান্ত জানার পর বিস্ফোরিত হয় অস্ট্রেলিয়ার জনমত।
ঢাকায় গণহত্যার খবর জানার পর নজরুল ইসলামদের মন খারাপ হয়ে যায়। প্রবাসী ছাত্ররা বাসায় এসে কান্নাকাটি করেন। কারণ, কেউ কারো স্বজনের কোনো খবর জানেন না। দেশের সঙ্গে চিঠিপত্রের যোগাযোগও বন্ধ।
কয়েক দিনের মধ্যে প্রবাসী ছাত্ররা টের পান, বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করে কিছু পাকিস্তানি ছাত্র। বুঝতে পারেন, এগুলো পাকিস্তানি হাইকমিশন’র লাগানো টিকটিকি। তাদের বাসায় কে আসছে না আসছে খোঁজ রাখছে। এসব টিকটিকির তৎপরতায় ভয় পান প্রবাসী একাধিক বাঙালি ছাত্র। কারণ, তারা সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে এসেছেন। পাছে না আবার হাইকমিশন স্কলারশিপ বাতিল করে দেশে ফেরত পাঠায়!
অভিবাসন নিয়ে আসা নজরুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়া সরকারের চাকরি করেন। হাইকমিশন’র এসব টিকটিকিকে তাই পরোয়া করেন না। একটাই তখন চিন্তা, দেশের জন্য কী করা যায়।
পিএইচডি’র ছাত্র আজিজসহ তারা পাঁচজন বৈঠকে বসেছেন। ‘কিছু একটা করতে হবে। উই নিড টু ডু সামথিং। এমন অন্যায় এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না।’
ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ছাত্র সংগঠনগুলো তখন বেশ সরব-সক্রিয়। নিউসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র নেতার কাছে গিয়ে নিজেদের কথা খুলে বললে তারা বেশ সহানুভূতি দেখান। তারা বলেন, ‘তোমরা একটা প্রটেস্টের ব্যবস্থা করো আমরা সাপোর্ট দেবো। তাদের বলা হয়, ‘আমাদের কমিউনিটি খুব ছোট এখানে। আমরা মাত্র পাঁচজন। বেশিরভাগই ছাত্র।
সবশুনে ছাত্র নেতারা বলেন, ‘ঠিক আছে তোমরা ভেবে ঠিক করো আমরা কীভাবে একটা প্রটেস্টের ব্যবস্থা করতে পারি।’ প্রবাসী ছাত্র আজিজ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি পিটার’র কাছে নজরুল ইসলামকে নিয়ে যান। কিন্তু তাকে বিশেষ কিছু বলতে হয় না। মিডিয়ার কারণে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি জানতেন। তিনি তাদের বলেন, ‘তোমরা আসায় ভালো হলো। আমি নিজেই একটা প্রটেস্টের কথা ভাবছিলাম। এটা কী করে সম্ভব? ভোট দেবার অপরাধে রাতের বেলা হামলা চালিয়ে এতগুলো ঘুমন্ত মানুষকে তারা মেরে ফেলবে?’
একথা বলে চোখ মোছেন ভদ্রলোক। এরপর বলেন, ‘জানো ঘটনা জানার পর থেকে আমি ঘুমাতে পারি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে একটি প্রতিবাদ সভার ব্যবস্থা করে দেন পিটার। সিডনিভিত্তিক সব প্রধান মিডিয়া এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট একামেডিশিয়ানদেরও সেখানে ডাকা হয়।
সভার শুরুতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন পরিস্থিতির পূর্বাপর ঘটনাক্রম,২৫ মার্চের গণহত্যা, শরণার্থীদের দেশত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিসহ সর্বশেষ যা যা জানেন সব বিস্তারিত বলার তিনি চেষ্টা করেন।
পুরো মিলনায়তন জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা। সব শুনে রাগে কাঁপছিলেন অনেকে। কাঁদছিলেন কেউ কেউ। নজরুল ইসলামের বক্তব্যের পর অনেকক্ষণ ধরে হাততালি চলে। অনেক আসন থেকে উঠে তাদের সমর্থন জানাতে আসেন।
এরপর বক্তব্য দেন ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকে। সবার বক্তব্যের একটাই সুর। এ ধরনের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে। সেখানেই ড. লেসিকে আহবায়ক করে একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘টু সাপোর্ট ইস্ট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট।’ নজরুল ইসলাম ছাড়াও পিএইচডি’র ছাত্র আজিজকে কমিটির সদস্য করা হয়। নিরাপত্তার কারণে অন্য ছাত্ররা অবশ্য তখনও প্রকাশ্যে আসতে রাজি ছিলেন না।
এই কমিটি আর সভার খবর অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় বিপুল প্রচার হলে তাদের সঙ্গে আসেন আরেক প্রবাসী বাঙালি। অস্ট্রেলীয় স্ত্রীর সূত্রে আলমগীর চৌধুরী নামের এই প্রবাসী বাঙালি এখানে বসবাস করছিলেন।
এরপর নতুন কমিটির ব্যানারে চলতে থাকে পাকিস্তানিদের নৃশংস আচরণের প্রতিবাদ, বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা। অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্ট একাডেমিশিয়ান কলামিস্টরা তখন সিডনি’র মর্নিং হেরাল্ডসহ স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় নিয়মিত লিখছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে লিখতেন শুধু একজন পাকিস্তানি অধ্যাপক।
বাঙালিদের পক্ষে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে শুধু বাঙালিদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ার প্রস্তাব আসে। কিন্তু সংগঠন গড়া ও চালানোর মতো এতো বাঙালি অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন না। নিউজিল্যান্ডে ছিল মাত্র দুটি বাঙ্গালি পরিবার।
ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুরে থাকা বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ অস্ট্রেলেশিয়া অ্যাসোসিয়েশন নামের নতুন একটি সংগঠন। সিডনিতে এর পাঁচ সদস্য হন নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী, আজিজুল হক, মোখলেসুর রহমান ও আনোয়ার হোসেন। এদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ছাড়া সবাই ছাত্র। পিএইচডি করছিলেন আজিজুল হক, মোখলেসুর রহমান ও আনোয়ার হোসেন। তৌফিক আহমদ চৌধুরীকে পরে কমিটিতে কোঅপ্ট করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এই সংগঠনই পে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়ায় রূপান্তর হলে ফখরুদ্দিন চৌধুরী, ড ফজলুল হক প্রমুখ এতে যোগ দেন।
নজরুল ইসলামের কর্মস্থল ছিল অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীশহর ক্যানবেরায়। সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সেখানে থাকার কারণে সেখানকার নানা দেশের দূতাবাস, সরকারি লোকজনকে বাংলাদেশ ইস্যুতে চিঠিপত্র লেখালেখি, যোগাযোগের সুবিধা হয়।
শুক্রবার বিকেলের ফ্লাইটে সিডনি ফিরে এসব সারা সপ্তাহের কার্যক্রম পর্যালোচনায় সহকর্মীদের সঙ্গে বসতেন নজরুল। অফিসের কাজে তাকে মাঝে মাঝে অ্যাডিলেইড,পার্থ সহ অস্ট্রেলিয়ার নানা শহরে যেতে হতো। ক্যানবেরায় অবস্থানরত পিএইচডি’র ছাত্র মশিউর রহমান অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজনসহ নানা কিছুতে তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সিদ্ধান্ত হয়, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর। ঠিক হয় পনের দিন পর তারা যা কিছু সম্ভব সাহায্য পাঠাবেন।
কিন্তু কমিটির সব সদস্যের সামর্থ্য সীমিত। এ সাহায্য পাঠানোর জন্য অতিরিক্ত কাজ করতেন মোসলেহউদ্দিন মল্লিক নামের একজন ছাত্র। সাহায্যের টাকা তারা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলাদেশ ফান্ড’র কাছে পাঠাতেন।
এক পর্যায়ে স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে অস্ট্রলিয়া আনার ব্যবস্থার পরামর্শ দেন। এতে করে অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে অফিসিয়াল আলোচনা শুরুর পথ সুগম হবে।
কলকাতায় এ ব্যাপারে লিখলে অনুকূল সাড়া আসে। বাংলাদেশ সরকারের দূত হিসাবে খুররম খান পন্নীকে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক আগে ফিলিপিন্সে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেখান থেকে ডিফেক্ট (পক্ষত্যাগ) করে আসার পর তাকে নিয়োগ করা হয় বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে।
কিন্তু খুররম খানকে নিয়ে এখানে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কারণ, তাকে রিসিভ করার মতো কোন ভালো গাড়ি প্রবাসী বাঙ্গালিদের কারো ছিল না। আলমগীর চৌধুরীর ছোটভাই আজম চৌধুরী পুরনো একটি ভক্স ওয়াগন নিয়ে পন্নীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যান। কিন্তু সেখানে গাড়ির চেহারা দেখে তাকে অসুখী দেখায়। নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এখানে কতদিন ধরে আছেন, আপনার গাড়ি আনেননি?’ তাদের আর কারো গাড়ি নেই বললে অসন্তুষ্টি নিয়েই গাড়িতে গিয়ে বসেন।
প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমিত সামর্থ্যে একটি থ্রি স্টার হোটেলে পন্নীর থাকার ব্যবস্থা করেন। তিনি রাষ্ট্রদূত মানুষ। সারাজীবন ফাইভ স্টার’র নিচে কোথাও ছিলেন না। যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রদূতকে হোটেল দেখেও বেশ অসুখী দেখায়। খবর পেয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তার জন্য ভালো হোটেল-গাড়ির ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। কিন্তু পাকিস্তানি প্রপাগান্ডার ভয়ে নজরুল ইসলামরা সে প্রস্তাবে সায় দেননি। কারণ, এমনিতে পাকিস্তানিরা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিল, বাংলাদেশের বিষয়টি ভারতীয় অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।
নিউসাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে পন্নীকে নিয়ে আয়োজিত সেমিনারটি খুবই সফল হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া সিডনিভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মিডিয়ার লোকজন এতে অংশ নেন। বাংলাদেশের পূর্বাপর পরিস্থিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য, শরণার্থীদের দুর্ভোগ, প্রবাসী সরকারের ভূমিকা এসব নিয়ে বিস্তারিত পন্নী তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। নানা বিষয়ে মিডিয়া’র লোকজন নানা প্রশ্ন করেন। এর একটি প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তা একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে কি না।
অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় পন্নীর বক্তব্য। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। সব মিলিয়ে পন্নীর সফরটি ছিল সম্পূর্ণ সফল। ওই সফরের পর অস্ট্রেলিয়ার আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে সেমিনারের আগ্রহ দেখায়। অ্যাডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ও বাংলাদেশের পক্ষে নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রথমে সম্মতি দিলেও পাকিস্তানি হাইকমিশনার পরে আর সেখানে যাননি। তখন প্রায় দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের বিজয়ও।
একাত্তরের নভেম্বর থেকে প্রতিদিন বাংলাদেশের অগ্রগতির আপডেট দিতে থাকে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া। নজরুল ইসলামের বাসায় শুধু ছোট একটি সাদাকালো টিভি। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ছাত্ররা চলে আসেন বাসায়। সাদাকালোর স্ক্রিনের সামনে বসে চার পাঁচজন বাঙ্গালি নিজের দেশের মানুষের অগ্রগতির দেখেন আর আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।
বিজয়ের খবর শুনেও তারা আনন্দে শুধু কেঁদেছেন। আর অনুভব করেছেন নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। বিজয়ের খবর আসার পর বিরতিহীন বাজে টেলিফোন। অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুরা তাদের উইশ করতে থাকেন। বারবার চেষ্টা করে ফোন এনগেজড পাচ্ছেন দেখে তাদের কেউ কেউ সরাসরি চলে আসেন বাসায়।
যুদ্ধের সারা নয় মাস বাংলাদেশকে তারা এমনিভাবে সমর্থন করে গেছেন।
লিংক