somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিভারের যত অসুখ এবং প্রতিরোধে করণীয়

২৯ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিভার শরীরের সর্ববৃহৎ অঙ্গ। আকৃতিতে যেমন বৃহৎ, প্রয়োজনীয়তার দিক থেকেও এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকেসুখে রাখতে দরকার সুস্থ লিভার। অসুস্থ বা রোগাক্রান- লিভার আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে দুঃখ, কষ্ট এমনকি অকালে প্রস্থান। অন্য যে কোন যন্ত্র বা মেশিনের মত আমাদের দেহ যন্ত্রও চলে শক্তির সাহায্যে। এ শক্তি আসে খাদ্য থেকে। আমরা যেরূপে খাবার খাই তা থেকে সরাসরি শক্তি উৎপন্ন হতে পারে না। জটিল খাবার লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে শক্তি উৎপাদনের উপযোগী হয়ে জমা থাকে এবং প্রয়োজন মাফিক শরীরের কোষে কোষে পৌছে শক্তি উৎপাদন করে। তাই লিভারকে বলা হয় শরীরের পাওয়ার হাউজ। শুধু তাই নয়, শরীরে উৎপন্ন বিভিন্ন দুষিত পদার্থ লিভার বিশুদ্ধ করে এবং পরবর্তীতে শরীর থেকে বের করার ব্যবস্থা করে। অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ভাবে শরীরে কোন বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করলে লিভার সেটিকে বিষমুক্ত করে। বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন জাতীয় পদার্থ তৈরী করে যা শরীরের জন্য অপরিহার্য।

লিভারের যত রোগ:

গুরুত্বপূর্ন এই অঙ্গটি নানা ধরনের রোগে আক্রান- হতে পারে। কিছু রোগ বংশগত (ওহযবৎরঃবফ), কিছু রোগ অর্জিত (অপয়ঁরৎবফ)। কিছু রোগ স্বল্পস্থায়ী এবং পুরোপুরি ভাল হয়ে যায়; কিছু রোগ দীর্ঘস্থায়ী, যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে কেড়ে নেয় জীবন-এমনকি চিকিৎসা করা সত্ত্বেও। হেপাটাইটিস বা লিভারে প্রদাহ বিশ্ব জুড়ে লিভারের প্রধান রোগ। নানা কারনে এই প্রদাহ হতে পারে। যার অন্যতম কার এ,বি,সি,ডি,ই, নামক হেপাটাইটিস ভাইরাস। পানি ও খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস লিভারে একিউট হেপাটাইটিস বা স্বল্প স্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সেরে যায়। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস। অনেক কারনেই লিভারের প্রদাহ হতে পারে। ভাইরাস ছাড়া ও অতিরিক্ত এলকোহল পান, লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া, বিভিন্ন ড্রাগ ও কেমিক্যালস হেপাটাইটিস করে থাকে। অটোইমিউন হেপাটাইটিস, উইলসন্স ডিজিজ সহ বিভিন্ন অজানা কারণ জনিত রোগ ও বংশগত রোগে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

যে কারণেই প্রদাহ সৃষ্টি হউক না কেন, দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক হেপাটাইটিস বছরের পর বছর চলতে থাকলে লিভারের কোষগুলো মরে যায়। অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় ফাইব্রাস টিসু সেস্থান দখল করে জন্ম দেয় সিরোসিস নামক মারাত্মক রোগ। সিরোসিস হলে লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমনই লিভার সিরোসিসের প্রধান কারন। উন্নত বিশ্বে এ স্থান দখল করে আছে অতিরিক্ত মদ বা এলকোহল পান জনিত হেপাটাইটিস। এছাড়া সামপ্রতিক কালের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসা ফ্যাটি লিভার, লিভারের সিরোসিসের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের দেশে সিরোসিসের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসাবে এটি দায়ী বলে ধারনা করা হচ্ছে। ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বির উচ্চমাত্রা প্রভৃতি কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মত লিভারেও ফ্যাট জমে ফ্যাটি লিভার হয়।

এছাড়া ব্যাকটেরিয়া এবং প্যারাসাইট লিভারে এ্যাবসেস বা ফোঁড়া তৈরী করতে পারে। সর্বোপুরি প্রাণঘাতি ক্যান্সার ও ভর করতে পারে লিভারে। সিরোসিস যাদের হয় তাদের এ ক্যান্সার হওয়ার প্রবনতা সবচেয়ে বেশি।

হেপাটাইটিস ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়:

দুষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ ও ই ছড়ায়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও বড়দের জন্ডিস এর প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ই ভাইরাস। ঘরের বাহিরে-আমরা যখন থাকি, তখন খোলা খাবার, পানি, ফলের রস ইত্যাদির উৎস ও বিশুদ্ধতা যাচাই না করে ক্ষেতে অভ্যস- অনেকেই। এতে আক্তান- হই জন্ডিসে। তাছাড়া শহরে পানি সরবরাহ লাইনে ভাইরাসের সংক্রমন হয়ে জন্ডিস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও নতুন কিছু নয়। তাই ফুটিয়ে পানি খাওয়া আর বেছে বুঝে খাবার খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। এতে শুধু হেপাটাইটিস এ এবং ই নয় টাইফয়েড আর ডায়ারিয়ার মত আরো অনেক পানি বাহিত রোগ থেকে বাঁচা যাবে।

রক্ত ও ব্যক্তিগত অনৈতিক আচরনের মাধ্যমে ছড়ায় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। দুষিত রক্ত গ্রহণ বা দুষিত সিরিজ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকেই নিজের অজানে- এ রোগে আক্রান- হয়ে পড়েন। একই শেভিং রেজার, ব্লেড কিংবা খুর ব্যবহারের মাধ্যমে এ দুটি ভাইরাস ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস বি আক্রান- মায়ের সন-ানের জন্মের পর পর বি ভাইরাসে আক্রান- হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেখ বা কোলাকোলি এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন গ্লাস জামা কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না।

কিভাবে বুঝবেন আপনার হেপাটাইটিস হয়েছে কি না?

একিউট হেপাটাইটিসে ক্ষুধামন্দা, শরীর ব্যাথা, বমির ভাব কিংবা বমি এবং কিছু দিনের মধ্যে প্রস্রাবের রং ও চোখ হলুদ বর্ন ধারন করে। এ সময় শরীরে চুলকানী দেখা দিতে পারে। জন্ডিস ক্রমে বেড়ে যেয়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বা সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশির ভাগ রোগীর উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। কেউ কেউ দুর্বলতা, অবসন্নতা বা ক্ষুধামন্দা অনুভব করতে পারে। হেপটাইটিস বি ও সি অনেকাংশই নিরাময় যোগ্য রোগ হলেও অ্যাডভ্যান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান- না হওয়া পর্যন- রোগী প্রায়ই কোন শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। এসব রোগিদের পেটে পানি জমে পেট ফুলে যেতে পারে, রক্ত বমি বা কাল পায়খানা কিংবা অজ্ঞান হয়ে জীবন ঝুকির সম্মখিন হতে পারে। এ সময় শরীর জীর্ন শির্ন হয়ে যায়। আমাদের দেশে অনেকে বিদেশে যাওয়ার প্রক্কালে রক্ত পরীক্ষার সময়, কিংবা রক্ত দিতে গিয়ে বা ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে অনেকেই হেপাটাইটিস বি ইনফ্যাকশনের কথা প্রথম জানতে পারেন।

লিভারের রোগ হলে কি করবেন:

লিভারের রোগীর কোন উপসর্গ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে অথবা আপনার শরিরে ভাইরাসের সংক্রমন নিশ্চিত হলে দেরী না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে সব চেয়ে ভাল হয় লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। তিনি আপনার রোগ নির্ণয় করে এর কারণ, রোগের জন্য সৃষ্ট জটিলতা এবং রোগের বর্তমান অবস্থা জেনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও উপদেশ দিবেন। হেপাটাইটিস এ ও ই জনিত রোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাল হয়ে যায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। হেপাটাইটিস ই ভাইরাসে আক্রান- হয়ে ২৮% গর্ভবতী মা মারা যায়। যখন শেষ তিনমাসের সময় মা তীব্রভাবে হেপাটাইটিস ই প্রদাহে ভোগেন। অন্যদের ক্ষেত্রে জীবন সংহারী একিউট হেপাটিক ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই জন্ডিস কে কখনও অবহেলা করবেন না। ক্রনিক হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি ও সি এর বিরুদ্ধে কার্যকর ঔষধ গুলির সবই এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তাই এ ক্ষেত্রেও হতাশ না হয়ে লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

লিভার রোগ প্রতিরোধে আপনার করণীয়:

০ হেপাটাইটিস বি এর টীকা নিন

০ ঝুঁকিপূর্ণ আচারণ যেমন-অনিরাপদ যৌনতা, একই সুঁই বা সিরিন্‌জ বহুজনের ব্যবহার পরিহার করুন।

০ নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও ডিজপজেবল সুঁই ব্যবহার করুন। ব্লেড, রেজার, ব্রাশ; খুর বহু জনে ব্যবহার বন্ধ করুন।

০ শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রন করুন।

০ শাক সবজি ও ফলমূল বেশি করে খান আর চর্বি যুক্ত খাবার কম খান।

০ মদ্যপান ও অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করুন।

০ বিশুদ্ধ পানি ও খাবার গ্রহন করুণ।

০ ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রনে রাখুন।

০ পরিস্কার পরিছন্ন থাকুন।

শেষ কথা : মানুষের দেহে লিভার মাত্র একটিই আছে এবং জীবন ধারনের জন্য এটি অপরিহার্য। তাই লিভারের অসুস্থতার ফলাফল ক্ষেত্র বিশেষে হতে পারে ব্যাপক ও ভয়াবহ। তবে লিভারের রোগ মানেই সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ন নিরাময় এবং অনিরাময় যোগ্য জটিলতা মুক্ত মোটামুটি স্বাভাবিক ভাবে জীবন নির্বাহ করা যায়।

অধ্যাপক ডা. মবিন খান
লিভার বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা, বাংলাদেশ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ২১, ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১১ বিকাল ৩:০৫
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×