মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা
এ কথা আজ সর্বজনবিদিত, একটি দেশের বা জাতির ভাষা যত বেশি সমৃদ্ধ সে দেশ বা জাতি বিজ্ঞান চর্চায়, সাহিত্যে ও শিল্পকলায় তত বেশি উন্নত। নিজস্ব ভাষায় একটি চিন্তা বা বক্তব্যকে যত সহজে ব্যক্ত ও হৃদয়ঙ্গম করা যায়, হাজার পারদর্শী হলেও বিদেশী ভাষায় তত সহজে তা’ ব্যক্ত বা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয় না। কোন ধারণা বা বক্তব্য হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে অনুরণিত না হলে তার মূল রস পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। আর সেই অনুরণন সৃষ্টি করা কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব।
বিদেশী ভাষায় কোন বক্তব্য যত সহজভাবেই পেশ করা হউক না কেন, তা’ কখনও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় না। কারণ যে কোন বক্তব্যের ব্যক্ত অংশ ছাড়াও একটা অতলস্পর্শী অব্যক্ত অংশ থেকে যায় যা’ হৃদয় দিয়েই শুধু উপলব্ধি করা যায়। ভাষার সরল বন্ধনে তাকে কখনও নির্দিষ্ট কাঠামোতে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এক ভাষায় ব্যক্ত কোন বক্তব্যের গভীরে যে অব্যক্ত অংশ থাকে তা’ অন্য ভাষাভাষীর হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না। ফলে অব্যক্ত অংশের আসল রসটুকু উপলব্ধি করা অন্য ভাষাভাষীর পক্ষে কখনও সম্ভব হয় না। অথচ একই বক্তব্য যখন নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত করা হয় তখন ব্যক্ত অংশের গভীরে বক্তব্যের যে আরোপিত অব্যক্ত অংশ থাকে শ্রোতা তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। তাই মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যত ফলপ্রসূ হয় বিদেশী ভাষায় তা’ কখনও হয় না।
উপরোক্ত বক্তব্যের সত্যতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই রাশিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স-এর মত জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত দেশসমূহের দিকে তাকালে। পৃথিবীতে আজও এমন কোন প্রমাণ নাই যে, বিদেশী বা পরের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে কোন দেশ বা জাতি এসব ক্ষেত্রে উন্নত বা সমৃদ্ধ হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে হউক বা অন্য কোন কারণেই হউক এশিয়ার কোন দেশ, চীন এবং জাপানের মত ২/১টি অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম বাদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আজও পাশ্চাত্য দেশসমূহের সমকক্ষ হতে পারে নাই। কারণ এশীয় দেশসমূহে আজও পরের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং অনুশীলন করা হয়। যে দু'একটি ব্যতিক্রমী দেশের কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একমাত্র একটি কারণেই যে, তারা বিদেশী ভাষা বা শাসনের প্রভাব মুক্ত হতে পেরেছে। পেরেছে নিজস্ব আয়নায় নিজের প্রতিফলন ঘটিয়ে অর্থাৎ নিজস্ব ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে। পরের বুলি গলধঃকরণ করে কাজ হয়ত চালিয়ে নেয়া যায়, মৌলিক ও সার্বিক উন্নতি কখনও সম্ভব হয় না। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করতে হলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই এসবের চর্চা ও অনুশীলন করতে হবে, সাধনা করতে হবে হৃদয়ের অতলস্পর্শী উপলব্ধি দিয়ে। আর সেই উপলব্ধি একমাত্র মাতৃভাষার যাদুস্পর্শেই সম্ভব।
আমাদের সংশয়, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা বা বিজ্ঞান সাধনা সম্ভব কিনা। এই সংশয় আমাদিগকে প্রতিনিয়ত পিছু টেনে রাখছে। ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, চীনা বা জাপানী ভাষায় যদি বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব হয়ে থাকে, বাংলা ভাষায় তা কেন সম্ভব হবে না তা আমাদের বোধগম্য নয়।
সমৃদ্ধ ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। বাংলা ভাষায় বর্ণমালা, শব্দ, ধ্বনি ইত্যাদি এতবেশী যে, পৃথিবীর খুব কম ভাষায়ই তা’ আছে। পৃথিবীর যে কোন ভাষাকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু এ সুযোগ পৃথিবীর অন্যান্য খুব কম ভাষায়ই আছে। এত সমৃদ্ধশালী একটা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা যদি সম্ভব না হয়, অন্যান্য কম সমৃদ্ধ ভাষায় তা’ সম্ভব হলো কি করে? আসল কথা হলো, ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে, নিজের আসল পরিচয় আমরা ভুলতে বসেছি, নিজস্ব সম্পদকে আমরা চিনতে ভুলে গেছি। পরমুখাপেক্ষিতা এবং পরনির্ভরশীলতা আমাদের অস্থি-মজ্জায় এমনভাবে মিশে গেছে যে আত্মনির্ভর হতে আমরা ভুলে গেছি। এ দীনতা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। মজ্জাগত একটি সিস্টেম পরিবর্তনের ফলে সাময়িক কিছু অসুবিধা অবশ্যই হয়। তবে অচিরেই তা’ কাটিয়ে উঠা যায়। যেমন কাটিয়ে উঠেছি আমরা অফিস-আদালতের কাজে। ইংরেজী ছাড়া অফিস-আদালত চলতে পারে না - এই ধারণা আশা করি আজ আর কেউ পোষণ করেন না।
বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা সম্ভব। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করতে হলে এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। পরের বুলি আউড়িয়ে আর যা-ই হউক সাধনা হয় না। কারণ সাধনার অর্ধেকটা ভাষার, বাকিটা আত্মার উপলব্ধির। বিদেশী ভাষায় অর্দ্ধেকটা সম্পন্ন করা যায় বটে সম্পূর্ণটা কখনও সম্ভব হয় না।
তবে হাঁ, ভাষার ব্যাপারে গোঁড়ামি এবং সংকীর্ণতা সর্ব ক্ষেত্রে পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে ভাষা যত উদার এবং অন্য ভাষার শব্দ-সম্বলিত সে ভাষা তত সমৃদ্ধ, তত সার্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য। ইংরেজী ভাষার কথা যদি ধরি, তবে দেখা যাবে সে ভাষায় ইংরেজী শব্দের সঙ্গে অসংখ্য ফরাসী, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষার শব্দ নিবীড়ভাবে মিশে গেছে। বিশুদ্ধ ইংরেজী ভাষার অজুহাতে ঐসব বিদেশী শব্দকে বাদ দিলে ইংরেজী ভাষার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। ইংরেজী ভাষার সাথে ঐসব বিদেশী শব্দকে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে নেয়া হয়েছে বলেই পৃথিবীতে ইংরেজী ভাষা আজ এত সার্বজনীন। বাংলা ভাষায়ও অসংখ্য বিদেশী শব্দ, বিশেষ করে ইংরেজী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত ইত্যাদি শব্দ এমনভাবে মিশে আছে যে, এদেরকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা চিন্তাও করা যায় না! দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক শব্দ আমরা ব্যবহার করি যা’ সর্বোতভাবে বিদেশী ভাষার শব্দ। কিন্তু যুগ-যুগ ধরে ব্যবহারের ফলে সেসব শব্দ আমাদের চিন্তা-চেতনায় এমনভাবে মিশে গেছে যে, সেগুলোকে বিদেশী ভাষার শব্দ ভাবতেও অবাক লাগে। যেমন চেয়ার, টেবিল, কাপ, ফ্রিজ, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিফোন ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে দরকার হলে আরো অগণিত বিদেশী ভাষার শব্দ ব্যবহার করতে হবে। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে বলেই যে অক্সিজেনকে অম্লজান, হাইড্রোজেনকে উদ্জান, কার্বনকে অঙ্গার, কার্বনডাইঅক্সাইডকে অঙ্গার দ্বিঅম্লজান, ফটোসিন্থেসিসকে সালোকসংশ্লেষণ, চেয়ারকে কেদারা, টেবিলকে চারপায়া, রেডিওকে বেতার যন্ত্র, টেলিফোনকে দূরালাপনী যন্ত্র, ম্যাচ বক্সকে চকমকির বাক্স, ফ্রিজকে ঠাণ্ডাকরণ যন্ত্র ইত্যাদি বলতে হবে এমন কোন কথা নেই।
উপরোক্ত শব্দগুলো বিদেশী হলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, কাজে-কর্মে, লেখাপড়ায়, কথাবার্তায় ও চিন্তাধারায় এগুলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে। এদের পরিবর্তে বাংলার অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করতে চেষ্টা করলে বাংলা ভাষার গতিময়তা ব্যাহত হবে, বাংলা ভাষা সমৃদ্ধশালী হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে এবং আমাদের চিন্তাধারা পদে পদে হোচট খাবে। বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চা দারুণভাবে বিঘ্নিত হবে। তাই মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে সব বিদেশী শব্দেরই যদি আমরা বাংলা ভাষার অপ্রচলিত প্রতিশব্দ ব্যবহার করে অতি বাঙ্গালিত্ব জাহির করতে চেষ্টা করি তা’হলে এতে যে বাংলা ভাষাকেই শুধু সংকীর্ণ করা হবে তাই নয়, বিজ্ঞান চর্চায়ও আমরা আরো ১০০ বছর পিছিয়ে যাব। অক্সিজেনকে অক্সিজেন, হাইড্রোজেনকে হাইড্রোজেন, কার্বনকে কার্বন বা রেডিওকে রেডিও বললে নতুন শব্দ ভাণ্ডারে বাংলা ভাষাই শুধু সমৃদ্ধ হবে না, মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চাও অনেক সহজ হবে।
বিজ্ঞানে ব্যবহৃত টার্মগুলোর অধিকাংশই আন্তর্জাতিক, অনুবাদের যাঁতাকলে ফেলে এদের আন্তর্জাতিকতাকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করলে আমরা ভুল করব, আর সে অধিকারও আমাদের নেই। বাংলা ভাষায় এ সকল শব্দ বা টার্মের সংযোজন বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দান করতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি বাংলায় বিজ্ঞান চর্চাকেও সহজতর করবে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে বাংলাকে সংকুচিত না করে যতটুকু সম্ভব প্রসারিত করতে হবে। আর এভাবেই বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৫৮