একা একা গুমোট সন্ধায় হাটতে ভালই লাগছিল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ অন্ধকারটাকে প্রলম্বিত করে সময়টাকে যেন আরো বাড়িয়ে দেয়।
আবহাওয়া দ্রুত ঠান্ডা হয়ে আসছে। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। এমুহুর্তে আমার বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানো উচিত। কিন্তু আমি যাচ্ছি না। একা একা নির্জন খোলা মাঠে এরকম পরিবেশে আমার অসম্ভব ভাল লাগছিল। থেমে থেমে একটু পরপর দমকা হাওয়ায় অল্প অল্প শীতল অনুভুতি সেইসাথে একটা ভয়ার্ত গাড় পরিবেশে নিজেকে কেমন যেন খাপছাড়া লাগে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করা যায়না সে সময়। আমারও ঠিক তা-ই হল। হাটতে হাটতে আরো দূরে চলে যা্চছি...আরো দুরে...
সময়য়টা ভাদ্র মাসের শেষদিকের এক মেঘময় সন্ধ্যা।
শহরের ইট পাথরের জঞ্জালে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে বুক ভরে একটু শ্বাস নিতে অফিস থেকে বহু কসরত করে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। অনেকদিন হল গ্রামে আসিনা। তাই আশে পাশের সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছে। বাড়ির সামনের সেই পরিচিত পুকুরটা নেই। সেখানে একটা তালগাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশের করিম চাচার মুদির দোকানটাও নেই, সেখানটা খালি পড়ে আছে। একটা বেঞ্চি পাতা। করিম চাচা মারা গেছেন অনেক আগেই। আমি ঢাকায় চলে যাওয়ার দুই বছরের মাথার কি এক অসুখে ভুগে মারা গেলেন। এত বছর পরে বাড়িতে এসে তার মৃত্যুর খবর শুনে খুবই কষ্ট লাগল।
এই দশ বছরে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। বছর দশেক আগে মা কে যেমন দেখে গিয়েছিলাম তেমনটা আর এখন আর নেই। মা অনেক বেশী বুড়িয়ে গেছে। তার হাড়জিরজিড়ে শরীর নিয়ে ভাত বেড়ে আমাকে খাওয়ালো পরম মমতায়। খাওয়ার সময় ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকল তার ছেলের দিকে।
অথচ বাড়িতে আসার পরে মা তার পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেয়নি। দেবেই বা কেন? দশ বছর ধরে তার ছেলে তার কোন খোঁজ খবর রাখে না। ছেলের উপর অভিমান করাটাই স্বাভাবিক।
হঠাত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে চোখ মেললাম। অনেকদুর হেটে এসেছি। এখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে হবে। নয়ত সন্ধাবেলা কাকভেজা হয়ে ফিরতে হবে।
হঠাত করে বৃষ্টি বেড়ে গেল। যেন আমাকে ভিজিয়েই ছাড়বে। আমার পক্ষে এখন আর বাড়িতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবেনা শুকনো অবস্থায়। তাই আশেপাশে আশ্রয়ের জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলাম। হ্যা, একটু দূরে মাঠের মধ্যে ছাপড়ামত দেখা যাচ্ছে। সেদিকে ছুটলাম।
যাক! এ যাত্রা ভিজতে হলনা। আমার আবার সর্দির ধার। তাই রুমাল দিয়ে মাথাটাকে ভালমত মুছে নিলাম।
মাঠের মধ্যে এই ছাপড়াটার একটা মানে আছে। বাঁশ গেড়ে উপরে শুধু চালা দেয়া ছোট আশ্রয়বিশেষ। কৃষকরা সারাদিন প্রখর রোদে মাঠে খেটেখুটে এর নিচে বিশ্রাম নেয়। কেউ এখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের বেলা এখানে হয়ত পাটি বেছানো থাকে। কিন্তু এখন সন্ধাবেলায় কিছুই নেই। তবে আরাম করে বসার জন্য কতগুলো মাটির ঢিবি আছে। তার একটাতেই বসে পড়লাম।
বৃষ্টি ঝরছে মুষলধারে। ভাদ্র মাসের এই এক সমস্যা, বৃষ্টি শুরু হলে পথঘাট পানিতে ডুবিয়ে ছাড়ে।
তবে আজকের এই অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে আমার ভালই লাগছে। কতদিন এমন সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়না! অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। সেই সাথে ভয়ও।
একা একা অন্ধকার পরিবেশে জনমানবহীন মাঠের ভেতরে বসে থাকলে যে কারো একটু আধটু ভয় পাবারই কথা। মনে হয় মৃত্যুপুরীতে বসে আছি। ভয়টাকে কাটানোর জন্য পুরোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলাম চেষ্টা করলাম।
এদিকে মায়ের জন্য টেনশন হচ্ছে। মা একা একা ঘরে বসে আছে। অথচ গত ছয়সাত বছরে আমার মায়ের কথা একটিবারো মনে পড়েনি। মনে পড়েনি বলতে মায়ের জন্য কষ্ট লাগেনি। তবে আজ কেন জানি মাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। হ্যা, সত্যিই আমি আজ অনুতপ্ত। নিজের অজান্তেই চোখের কোনা দিয়ে জল বেড়িয়ে এল বোধহয়।
এতদিন ভেবেছি মা বড়ভাইয়ের সাথে ভালই আছে। আজ এসে শুনি ভাইজান মারা গেছে তাও পাঁচবছরের মত হল। ভাবি আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে। মা একা।
আজ ভাইজানের জন্যও বুকের মাঝে একটা শুন্যতা অনুভব করলাম। শত দ্বন্দ্ব থাকুক, আজ ভাইজান কাছে থাকলে পা জড়িয়ে ধরতাম। বলতাম ভাইজান আমার ভুল হয়ে গেছে,মাফ করে দাও। আর মা কে বল আমাকে মাফ করে দিতে। মা আমার উপর অভিমান করেছে। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে না, আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে না। আমি মায়ের কোলে ঘুমোতে চাই। ভাইজান তুমি মাকে বল আমাকে ক্ষমা করে দিতে।
হঠাত বাজ পড়ার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ল । নাহ! হতচ্ছাড়া বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। কখন থামে কে জানে !
আমার এদিকে বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। তাই একটু সরে গিয়ে বসলাম।
ভাইজানের সাথে আমার দশবছর আগে ঝগড়া লেগেছিল জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।
আমি তখন সদ্য ঢাকায় চাকরী পেয়েছি। মাঝেমধ্যেই গ্রামে যেতাম। প্রত্যেক মাসে। হঠাত বাবা মারা গেল। তাই বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হল। সে এক তুমুল ঝগড়া। কেউ কাউকে খুন করে ফেলতে পারলে ছাড়ি না। শেষে সবার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসলাম। মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল। কিন্তু আমি মানবার পাত্র না।
যাবার সময় মা বিদায় দিল না। শুধু অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকল।
তারপর মাঝে মধ্যে মায়ের খোঁজখবর নিতাম চিঠি লিখে। মা পুরোনো যুগের মানুষ হলেও লেখাপড়া জানত। চিঠি লিখতে পারত। মা ও লিখত। প্রথমে সপ্তায় সপ্তায়,তারপর মাসে মাসে,শেষে বছরে একবার খোঁজ নেয়া হত। এদিকে মায়ের প্রতি টানও ফিকে হয়ে আসছে। ভীষন ব্যাস্ত এই আমার শত ব্যাস্ততার মাঝে মা কে মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে মনে পড়লেও লিখা হয়ে ওঠেনা। সে থেকে গত চার পাঁচ বছর আর খোঁজ খবর নেই।
হঠাত বৃষ্টির এক ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিল আমাকে। নাহ ! এ বৃষ্টি আমাকে ঠান্ডা লাগিয়েই ছাড়বে।
রুমালটাও ভিজে চুপচুপে। কোন রকম মুছে একপাশে সংকীর্ন হয়ে বসলাম। এবার বৃষ্টির আর সাধ্যি নেই আমাকে ছোঁয়ার। অপেক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাত ছাতা মুড়ি দিয়ে কাউকে আসতে দেখা গেল। বৃষ্টি একটু কমেছে। আবছা অন্ধকারে স্লথগতিতে হেটে আসতে থাকা তাকে কেমন যেন ভৌতিক লাগছিল। আমার ভয় বেড়ে গেল। আশংকা নিয়ে চেয়ে থাকলাম। দুর্বলচিত্ত এই আমার ভয় কেটে গেল যখন মা কে দেখলাম। নিজে একটা ছাতা মুড়ি দিয়ে এসেছে,আর আমার জন্য একটা ছাতা নিয়ে এসেছে হাতে ধরা।
অবাক হলাম। আমি এখানে মা এটা জানল কিভাবে? মাকে জিজ্ঞেস করতে কোন উত্তর দিলনা। বলল অনেক রাইত অইছে। এহন বাড়িত আয়।
বললাম মা টর্চ আনোনি?
মা বলল বেশী আলোতে তার চোখে জ্বালা করে। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
বাড়িতে চলে আসার পর লক্ষ্য করলাম মা একটুও ভেজে নি। নিশ্চিন্ত হলাম যাক না ভিজলেই ভাল। অবাকও হলাম বটে। কারন আমি ভিজে একাকার। ছাতা থাকলেও বৃষ্টির ছাঁট সবকিছু ভিঁজিয়ে দেয়। অথচ মা একদমই ভেজেনি।
খাবার সময় মা একটু দূরে বসে রইল। কুপির আবছা আলোতে মা কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। খেতে খেতে বললাম মা, তোমাকে আমার সাথে ঢাকায় নিয়ে যাব । মা রাজী হলনা।
খাবার পরে মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম মা, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমি অভাগা ছেলে তোমার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। মাফ করে দাও মা। আমি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকব।
মায়ের পা টা একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম। কিন্তু মা পানি আনার অজুহাতে চলে গেল।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম কতক্ষন। নাহ, মা আমাকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করার মত অপরাধ আমি করিনি। তার চাইতে শতগুন বেশী করেছি।
বাইরে থেকে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। “ অনেক রাইত অইছে। অহন শুইয়া পড়। ওইঘরে বিছানা কইরা দিছি। “
শুয়ে পড়লাম। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। অনেকপথ জার্নি আর হাটাহাটিতে এখন খাওয়ার পরেই ক্লান্তি অনুভব করছি।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে বের হলাম। মা কে ডাকলাম।
মা, মা,
মাগো ......
মা নেই।
জানতে পারলাম মা মারা গেছে দুই বছর হল।