এ কি কৃপণ আগুন তুমি জ্বালালে কুম্ভকার সমস্ত আয়ুময়?
পোড়ে না কিছুই, সব টেনে টেনে বয়ে নিয়ে যেতে হয়
যা কিছু দিলে তুমি আমাদের
কিছুই হয় না ছাই।
যাই
বয়ে নিয়ে যাই
আদি থেকে অন্তে,
অন্ত থেকে আদি আদিগন্ত -
অন্ত নাই, নাই অন্ত নাই।
স্মৃতির খোসাগুলো কি অন্ততঃ পারতে না তুমি
পুড়িয়ে দিতে তোমার প্রজ্জলিত পৌণে মহাকুম্ভকার?
ওস্তাদ ওস্তাগীর তুমি?
কেন ভবিষ্যতের পথ ঘুরে যায় উল্টোরথে চেপে
বঙ্গপোসাগর থেকে গঙ্গোত্রীর দিকে?
কেন এই ব-দ্বীপে নিদ্রিত থেকেও মানস সরোবরের ডাক শুনি
অন্তরের চরাচর জুড়ে অহরহ?
খুঁড়ে চলি গোর?
জীবাশ্মে খুঁজে চলি আত্মপ্রতিকৃতি-
পাললিক শিলায় চাপা নিজস্ব শরীরের পরিচিত ছাপ?
কেন তুমি সঠিক আগুনে জ্বালিয়ে দিলে না এই শরীর সেদিন?
বৃষ্টিতে, পুনঃপুন প্লাবনে ধুয়ে যায় সোনার বঙ্গ?
এই সোনার অঙ্গ?
শরীরের ছাঁচ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়?
শরীর ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়?
কে পেরেছে আমার মতন অবয়বহীন?
সবার মত টেরাকোটা শরীর কেন দিলে না আমাকে?
কেন মায়াবতী লীলাবতী টেপা পুতুল পোড়ালে না সঠিক আগুনে?
আমিও যে সবার মত, এ দ্বীপের আর সব মানুষের মত পাপ করতে চাই।
আমিও যে ভুল করতে চাই মহাশয়।
আমিও যে তারপর ক্ষমা প্রার্থনা করে ফিরে পেতে চাই ভালবাসা।
আমিও যে স্বাভাবিক মানুষের মত পাপ করতে চাই।
কেন আমি সমতলে এত পাপ নীরব দর্শক হয়ে দেখে যাই?
কেন আমি এত ব্যথা পাই?
কুম্ভকার এত কিছু বোঝ তুমি - আমাদের অন্তরের অন্তর্যামী
দহনের শাস্ত্র জানো, আট রকম কলাছলাকলা
এত মোহ, অলীকের সতের রকম মন্ত্রের মায়া
এত ভালবাসো তুমি এতটা নিঁখুত
ভুল আগুনে এইভাবে কেন তুমি পোড়ালে আমায়?
শরীর যে বৃষ্টিজলে ধুয়ে ধুয়ে যায়
বৃষ্টিজলে ধুয়ে যায় চোখ - আমি অন্ধ হয়ে থাকি চিরকাল
আমি কিছু দেখতে পাই না, কোথায়, কার, কি, কতখানি দোষ?
হাত-পা, দেহভঙ্গী মুছে যায়
কেউ আর চিনতে পারে না সেই তো একই পুরোনো শরীর,
একদিন চেনে আর পরদিন পরপর লাগে দেহভাষা।
আমার চেহারা, নাম-নিশানা কেউ খুঁজে পায় না কোথাও।
হারিয়ে যাই আমি পুরোপুরি
পরিপূর্ণভাবে পোড়া একখানি শরীরের অভাবে।
সবার মত আমাকেও যদি দিতে তুমি সঠিক শরীর
আমাকেও তো চিনতো লোকে
কমপক্ষে চেনা চেনা মনে হত ঃ
কোথায় যেন দেখেছি এই মুখ!
নরকের আগুন তুমি রেখেছো কোথায়?
ভেবেছো আমরা জানবো না কোনদিন নারকীয় ব্যাপক আগুন?
এত আগুন তুমিই বা রাখবে কোথায়?
আর আমি ছায়াবীথি তলে ঘন কালো কেশ সিক্ত করে
সূক্ষভাবে ভিজতে পারবো না, শোন, - বৃষ্টি নেশাভরা সন্ধ্যাবেলায়।
আমাকে সবচেয়ে প্রকান্ড অগ্নিকান্ড দাও উপহার
জেনে যাই আমিও যে কলঙ্কের ভাগী, আমি সব দাগে দাগী
ছোপ ছোপ কালশিটে শরীরে আমার, সনাক্তের চিহ্ন দেখো নেই কিছু আর -
কোন পৈতে তাবিজ মাদুলী তাগা মঙ্গলসুত্র শাঁখা-নোয়া কোন সিঁথির সিঁদুর নাকছাবি
আইডেনন্টিটি কার্ড কোন ভোটার তালিকা কোন ভিজিটিং কার্ড সাইবার অ্যাড্রেস
গ্রীবায় নাসিকায় কোন কালো কালো তিল, হাতে মেহেদীর ঘ্রাণ - নেই ।
আমি যে কলার ভেলায় করে সব প্রেম ভাসিয়ে দিয়েছি
নতুন নতুন বাৎসরিক বেনোজলে যমুনায়
হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে স্নান করে পাড় ধরে
যে দিকে দু‘চোখ যায় ভেজা ভেজা পায়ে হেঁটে চলে গেছি জড়িয়ে কাপড়
বালুচরে এখনও সেই পায়ের ছাপ বহুদূর দিগন্তে
আবছা সবুজ আর আবছা নীলে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যেতে দেখা যায়
পদ্মার ঢেউয়ে আমি হারায়েছি যারে চিরতরে
তার সাথে আমিও সেদিন থেকে গিয়েছি হারায়ে
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ বিদিশা অবন্তী উজ্জয়িনী পাটলিপুত্র পন্ড্রুবর্ধন
গৌড় রাঢ় সমতট হরিকেল চন্দ্রদ্বীপ কিংবা
ঢাকা শহরের টিকাটুলি, শাঁখারী বাজার, শেরাটনে -
গঙ্গাবুড়িগঙ্গা থেকে তুরাগের পাড়ে
কোথাও আমাকে আর পাই না যে খুঁজে,
আমার ঠিকানা-ঠিকুজি কোথায় ফেলেছি হারায়ে একেবারে
আমি আর জানি না তো, - কে আমার শ্যাম, কে লখিন্দর, আর কেই বা সেই যে সূঁচকুমার?
কি আমার কুলপরিচয়, কে আমার গুরু, কোন্ মন্ত্রে, কিসে দীক্ষা হয়েছে আমার,
কোন কলা, কোন বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি,
কোন তন্ত্রে আমি রেখেছি বিশ্বাস, কোন ধর্ম অন্তরের অন্তঃস্থলে করেছি গ্রহণ,
কি আগুন নিয়ে আমি করিয়াছি খেলা, আর কারে আমি সব বাজি হেরে,
আমার এই জীবনের বিনিময়ে রাখিয়াছি ধরে।
আমি যে উজান পথে, যে দিকে দু‘চোখ যায় বরাবর সেই দিকে চলে গেছি নিরুদ্দেশ্যে দিকশূন্যপুরে
উত্তরে সরযু নদীর দিকে চলে গেছি প্রবজ্যা নিয়ে, শরণার্থী হয়ে নিয়ে সংঘের শরণ
মানুষের জীবনের সুখ খুঁজে পেতে পুর্নবার।
এই লোকালয়ে ঠাঁই পাই নাই আত্মা ও শরীরসমেত পরিপূর্ণ আমি
আমার ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার-কৃত্য-আচার-বিচার সহকারে।
আমার হল বিধি বাম, হল বনবাস যাবজ্জীবন
অজ্ঞাতবাসে তাই আমি পাখিদের সাথে বাঁধিয়াছি নিরজন কুঁড়ে একা একা
তাই আমি নিঁখোজ নিরুদ্দিষ্ট - ঝর্ণায় স্নান করি, বনফল খাই, পরিধেয় বৃক্ষের বাকল
আমার দ্বিধা নাই, দৈন্য নাই, - তাই আমি স্বচ্ছল প্রকৃতির মত।
যমুনার পাড়ের মত ভেঙে যেতে থাকে শরীরের সীমা, তাই
দক্ষিণে আমার দেশের দরিয়ায় নোনাজলে ভাসাবো না শরীরের এই কাঁচামাটি
ভাটির দেশে বেহুলার বাসরে ঢুকে গেছে শত শত সাপ,
নষ্ট তার হয়েছে বাসর; কালপুরুষ খেয়েছে শরীর
শুধু সাপ আর সাপ আছে ফণা ধরে চারপাশে দোসরের আত্মহত্যার পর
লাভা স্রোত ধমনীতে বয়ে চলে যায় উল্টো গিরিপথে
তাতে প্রকান্ড অগ্নিকান্ড সন্নিকটে অনুভব করা যায়
কূলে অকূলে উপকূলে - কুলে কুলে মহা বিপদসংকেত সহকারে।
৪ আগাষ্ট, বুধবার ০৪
উত্তরা, ঢাকা চ
৪ আগাষ্ট, বুধবার ০৪
উত্তরা, ঢাকা