রমজান মাস এলেই আমাদের দেশে বিশেষ করে চট্রগ্রাম ও সিলেটে শুরু হয় একটি কুপ্রথা! যুগ যুগ ধরে সামাজিক রীতি-রেওয়াজের নামে অন্যান্য কিছু কু-প্রথার মত মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীতে ইফতারী প্রথাকে মারাত্মকভাবে আকড়ে ধরে আছে যে কয়টা অঞ্চল তার মধ্যে সিলেট সবার উপরে।
আজব এই প্রথার স্থানীয় নাম "ইস্তারী"। আধুনিক যুগেও সিলেটের ধনী-গরীব নির্বিশেষে অধিকাংশ পরিবারে প্রচলিত এই প্রথা। ইস্তারী প্রথা সমাজের একটা 'ব্যাধি'। এই ব্যধিটা কত যে ভয়ংকর ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। বাংলাদেশের সমাজে বিয়ের সময় যেরকম 'যৌতুক' দেয়ার প্রচলন
আছে, ঠিক তেমনি এই "ইস্তারী" প্রথা সিলেটের সমাজে এখনও মারাত্নকভাবে প্রচলিত!
যৌতুক না দিলে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীতে মেয়েগুলো যেভাবে সামাজিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকে, তেমনিভাবে সিলেটে ইস্তারী না দিলে সিলেটী মেয়েদেরকেও সামাজিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়! বাপের বাড়ী থেকে ইস্তারী না দিলে সিলেটী মেয়েদের শ্বশুড় বাড়ী থেকে 'খোটা' শুনতে হয়! ইফতারী না আসলে সমাজে নাকি শ্বশুড় বাড়ীর কোন মান-সম্মান থাকে না! সিলেটের সমাজে এই প্রথাটি অনেকটা 'না দিলেই নয়', অবশ্যই কর্তব্য বা বাধ্যতামূলকভাবেই প্রচলিত রয়েছে!
ঠিক কবে থেকে এই কু-প্রথার প্রচলন শুরু হয়েছে তা জানা নেই তবে শুনা কথা হলো- আগেকার দিনে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বলে বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে খুব একটা আসা যাওয়া করতে পারতো না। শুধু মেয়ে আর জামাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো তখনকার দিনে অসভ্যতা হিসাবে গন্য করা হতো তাই হয়তো আয়োজন করেই ইফতার পাঠানোর প্রথা চালু হয়।
সেই প্রথাই কালের পরিক্রমায় একটি কু-প্রথায় প্রচলিত হয়। এখনকার দিনে সমাজের ধনী লোকজন এই প্রথাকেই লোক দেখানো একটি প্রথায় পরিনত করে রেখেছে! লোক দেখান'র জন্য ধনীরা কুরবানীর ঈদের সময় যেরকম গরু কেনার নামে প্রতিযোগিতা করে, তেমনি ইস্তারী দেয়ার নামে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিযোগিতা শুরু হয়!
বিত্তবান সিলেটীরা অনেকগুলো ট্রাক ভাড়া করে নানা ধরণের দামি ইফতারী সাজিয়ে মহা আড়ম্বর করে বহু লোকজন নিয়ে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীতে নিয়ে যায়! এই ইস্তারী দেয়াকে কেন্দ্র করে মেয়ের বাড়ীর টাকায় মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীতে করা হয় মহা আয়োজন! প্যান্ডেল টানিয়ে আসে-পাশের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, ছেলের বন্ধু-বান্ধব সকলকে দাওয়াত করে সেই ইফতারী খাওয়ানো হয়! এই ইফতারীতে যত বেশী লোকজন হবে অথবা এই অনুষ্ঠানে যত বেশী জাকজমকভাবে খাওয়ানো হবে, শ্বশুড় বাড়ীতে মেয়ের সম্মান তত বেশী বাড়বে!
এই ইস্তারী শুধু মেয়ের বাবার পক্ষ থেকে দিলেই শেষ না! দুই দিন দিবে মেয়ের বাবা, প্রথম রমজানে একবার। পরে আরও একবার। মেয়ের চাচা থাকলে চাচাদের পক্ষ থেকে আরেকবার। মামা থাকলে মামাদের পক্ষ থেকে আরেকবার।
ইস্তারী দেওয়ার এই প্রতিযোগিতায় সক্ষম লোকজনদের অবস্থা যেমন-তেমন কিন্তু গরীব মেয়েদের বাপ-ভাই, স্বজনদের অবস্থা হয় মরার উপর খাঁড়ার ঘা! অনেক গরীব মেয়ের বাপ, ভাই অথবা স্বজনরা লোকজনের কাছ টাকা কর্জ করে, কিংবা সুদে টাকা নিয়ে অথবা ব্যাংক লোন নিয়ে যেভাবে হোক এই ইফতার পাঠায়! কারণ এটা তাদের মেয়ের মান-সম্মানের ব্যাপার! প্রতি বছর এই ইফতার পাঠানো কি পরিমান কষ্টের একমাত্র ভোক্তভোগীরাই জানেন!
সিলেটের ইফতারী দেয়ার এই প্রতিযোগিতা সত্যিই হাস্যকর! ইসলামের নামে এই অনৈসলামিক কু-প্রথাকে অনেকেই জায়েজ বলেও চালিয়ে দিতে চান! এই কু-প্রথাকে জায়েজ বানানোর জন্য দলীল দেন-"ইফতার খাওয়ানো সওয়াবের কাজ ও ফজিলতের কাজ।" অবশ্যই ইফতার খাওয়ানো অত্যন্ত সওয়াব ও ফজিলতের কাজ। কিন্তু সেটা সাধ্যের ভিতরে ইচ্ছাস্বাধীনভাবে, কোন প্রথা পালন করতে গিয়ে জোর জবরদস্তি ভাবে না!
এই ইফতার মেয়ের বাড়িতে না পাঠিয়ে কোন এতিমখানা পাঠালে, কিংবা দুস্থ, ক্ষুধার্ত, অসহায়দের দাওয়াত করে খাওয়ালে সওয়াব বেশী পাওয়া যাবে এবং ফজিলতও বেশী পাওয়া যাবে। অনেকেই আবার এই ইফতার দেয়াকে 'সুন্নত' বলেও মনে করেন। যেটার কোন ভিত্তি কুরআন হাদীস তথা ইসলামী শরিয়তে নাই।
সিলেটীদের মধ্যে যারা এই কুপ্রথার অনুসারী তারা একটা খোড়া যুক্তি দেখায়- "যাদের সামর্থ্য আছে শুধু তাঁরা ইফতারী দিলে আপনাদের সমস্যাটা কোথায়?"
সমস্যাটা কোথায়, উনাদেরকে বুঝিয়ে দিতে এটুকু বলবো- "সামর্থ্য থাকলে যৌতুক দেয়া বাংলাদেশে যেরকম একটি বড় ধরণের অপরাধ, ঠিক এরকম এই কুপ্রথাটিও একটি অপরাধ। কারন প্রথাগত এই ইফতারি আর যৌতুকের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
এই কু-প্রথার বিরুদ্ধে দেশে কঠোর আইন করা উচিত। এই কু-প্রথা যৌতুক থেকেও আরো ভয়ংকর। কারন যৌতুক বিয়ের সময় একবারই দেয়া হয় কিন্তু এই প্রচলিত প্রথা বিয়ের পর থেকে প্রতি বছর দেয়ার রেওয়াজ হয়ে গেছে!
এই ধরণের ইফতারীর দাওয়াতে সবাই মিলে সামাজিকভাবে না গেলেই হয়তো এই প্রথার কিছুটা প্রচলন বন্ধ হবে। সচেতন ছেলেরা যদি ইস্তারী প্রথাকে 'না' বলে তাহলে অনেক কমে আসবে এই সামাজিক ব্যাধি। আধুনিক সামাজিক জীবনে এই কু-প্রথা আমাদের জন্য লজ্জা। একবার ভাবুন, একটা বাবা মেয়ে জন্ম দিয়েছে বলে অপরাধ করেছে নাকি? যদি অপরাধ না করে থাকে থাহলে তাকে কেন এমন।শাস্তি দিচ্ছে এ সমাজ?
এই কু-প্রথাকে সমূলে বন্ধ করার জন্য সচেতন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা শুধু প্রথা না, এটা যৌতুক। মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে কোন ধরনের যৌতুক গ্রহন ছেলেদের জন্য অক্ষমতা। সবাইকে বুঝতে হবে। শক্ত অবস্থান নিয়ে এই কু-প্রথাকে বিদায়
জানাতে হবে।
শিক্ষিত, সচেতন মহলসহ নতুন প্রজন্মের সবাইকে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। এই প্রথার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা খুবই জরুরী। যৌতুকের বিরুদ্ধে যেভাবে আইন হয়েছে এই কু-প্রথার বিরুদ্ধেও আইন করা হবে যদি জনগণ সচেতন হয়।
বিলুপ্ত হোক সব কু-প্রথা, কুসংস্কার।
সুখী হোক আমাদের সমাজ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৮ রাত ১০:২৭