লোকাল বাসে চড়া খুব বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে চড়তে হয়। গত কয়েকদিন আগে বাড়ি যাচ্ছি। লোকাল বাসে করে। পুরো বাস লোকে লোকারণ্য। সিটের অভাব নাই, কিন্তু খালি সিট খুজে পাচ্ছি না! অবশেষে একদম পেছনে পেলাম। পাশের সিটে দুইটা বাচ্চা। একটা ছেলে ৭/৮ বছরের আরেকটা মেয়ে ৫/৬ বছরের। ভাই বোন। পুরো সিট নিয়েই বসেছিল। আমাকে দেখে ডাক দিলো বসার জন্য। তারা একজন আরেকজনকে কোলে নিলো। বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে কী যেন গল্প করছে আর অট্রহাসি দিচ্ছে। দুই একবার নিষেধ করলাম। নিষেধ করার পর একটু থামে আবার শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর অনেকটা অধৈর্য হয়ে গেলাম। জোরে একটা ধমক দিলাম। ভেউ করে কান্না শুরু করলো মেয়েটা। পরক্ষণেই খারাপ লাগলো। খুশি করার জন্য আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। তারা এতিমখানায় থাকে। মা অসুস্থ, তাই বাড়িতে মা কে দেখতে গিয়েছিল। এখন আবার এতিমখানায় ফিরে যাচ্ছে। চিন্তা করলাম কত ছোট বাচ্চা এত দুরের পথ একা একা পাড়ি দিচ্ছে। তাদের বয়সে থাকতে আব্বা, আমাদেরকে একা একা দোকানেই যাওয়ার দিতেন না। আর তারা ৯৬/৯৭ কিলোমিটার যায়গা একা একা পাড়ি দিচ্ছে!
হঠাৎ মেয়েটা বমি করা শুরু করলো। ছেলেটা মেয়েটার পিঠ হাতাতে লাগলো। বমি করা শেষ হলে পরে বোতল থেকে হাতের তালুতে পানি ঢেলে মেয়েটার মুখ মুছে দিলো। তারপর পানি খাওয়ালো। পানি খাওয়ানোর সাথে সাথে মেয়েটার আবার বমি শুরু হলো। ছেলেটা আগের মত বোনের পিঠ চাপড়ে দিল। মুখ মুছে দিল। তারপর আবার পানি খাওয়াতে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম সকালে কী খেয়ে এসেছ? ভাই-বোন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর ছেলেটা কাপা কাপা কন্ঠে বলল "ভাত খেয়ে এসেছি"। আমি বললাম "মিথ্যে বলছ কেন?" ছেলেটা মাথা নিচু করে থাকল। বললাম পানি খাওয়াবে না এখন। আবার বমি হবে। আগে দুজনে কিছু খাও।
বাস থেকে নেমে দুজনকে ব্রেড আর জেলী কিনে দিলাম। (গ্রামের বাজারে ভাত পাওয়া যায় না। আর আমার বাড়িও অনেক দূর।) আমার দেওয়া খাবার তারা নিতে চায় না। তাদের মা নিষেধ করেছেন। বললাম "খুব ভালো। অপরিচিত কারো দেওয়া কিছু খাওয়া ঠিক না।" পকেট থেকে একশত টাকার নোট একটা বের করে দিয়ে বললাম কিছু খেয়ে নিও। কিছুটা সংকোচ বোধ করেছিল নিতে। তবুও নিল। আমাকে বলল, "একমিনিট আম্মার সাথে কথা বলবো আপনার মোবাইলটা দিন"
মায়ের নাম্বারে কল দিলো। মা রিসিভ করতেই বলল, "আমরা পোঁছে গেছি। এ মাসে আমাদের হাত খরচের টাকা দেওয়া লাগবে না। এ-ক-শ-ও-ও-ও টাকা পেয়ে গেছি"
...
গরীবরাই পৃথীবির সবচেয়ে সুখী। জীবন শুরুর আগেই জীবনের মানে বুঝে যায়। বেচে থাকার যুদ্ধ শিখে যায়। দুঃখ এদের কাছে জীবন জয়ের খেলা। প্রতিদিন এরা এই খেলা খেলে। পরাজয় জেনেও বিজয়ীর মতো হাসে।
এরা খুব সহজেই কাদতে পারে। মায়া কান্না না, উপচে পড়া দুঃখের কান্না। যে কান্নার সাথে বের হয়ে যায় সব দুঃখ।
গরীবরা অল্পতেই খুশি হয়। খুব সহজেই হাসতে পারে। দাতের পাটী বের করে, খিলখিল শব্দ করে, নির্মল হাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:৩২