ধর্ষণের সঙ্গায়ন করা হবে আমার মতে অতি বাচালতা। ধর্ষন কী তা আমরা কম বেশি সবাই জানি। অন্তত আমরা যাহাকে ধর্ষন না বললেই নয় তা অন্তত জানি।
ধর্ষন একটি প্রাচীন অপরাধ। যার প্রয়োগ প্রায় সর্বাংশেই নারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে বলাৎকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
ধর্ষনঃ
সমাজে যতো পেশার পুরুষ আছেন, তাদের অধিকাংশেরই নামে ধর্ষনের বদনাম আছে। সুতরাং পেশা ধরে দোষ দেয়া হবে ভুল। ঘরে, বাহিরে। কর্মক্ষেত্রে, আশ্রয়ে, যুদ্ধে, শান্তিতে সব সময়েই নারীকে ধর্ষন করা হয়েছে। যুদ্ধ চলছে; পুরুষকে হত্যা করো আর নারীকে প্রথমে করো ধর্ষন আর তারপরে প্রয়োজনে হত্যা। তাও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। নারীর প্রতিটা অঙ্গ কাপুরুষ দ্বারা ধর্ষনের স্বীকার হয়। পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত। মেয়েরা কাজিন থেকে আংকেল, বন্ধু থেকে অপরিচিত কোন স্থানেই নিরাপদ নয় শধু এই একটি কারণে। একজন পুরুষ যখন নিজেকে ভয়ের মাঝে আবিস্কার করে, তখন সর্বোচ্চ নিজের প্রাণ হানির আশংকা করে। আর একজন নারী করে প্রাণ ও মান দুটোরই হানির। মানব সমাজে যখন থেকে এই অপরাধ সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে এই অপরাধের জন্য যতো না পুরুষকে শাস্তি দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে নারীকে।
১। একজন খারাপ নারী কেনো ধর্ষিত হবার রিস্ক নিবে? সেতো নিজেকে বিলিয়েই দিবে!
২। একজন অসভ্য নারী ধর্ষিত হতে চায়? তবে একজন অসভ্য পুরুষ কি হতে পারে? বলাৎকার? কয়টা হয়?
৩। একজন নারী-মা, বোন, স্ত্রী, আত্নীয়। তবে কেনো আমাদের এই সম্পর্কগুলো শক্তিশালী থাকেনা?
৪। নারীর পোশাক যদি ধর্ষিত হবার কারণ, তবে পুরুষের পোশাক কি?
হাজারো প্রশ্ন উত্থাপিত করা যায়।
বিভিন্ন দেশে ধর্ষনের শাস্তি প্রায় একই, কঠিন এবং কঠিন। নিম্নে কিছু দেয়া হলোঃ
১। সৌদি আরবে ধর্ষনের শাস্তি শিরোচ্ছেদ, এক কোপে।
২। চীনে একটি একক বুলেট দ্বারা ধর্ষকের ঘাড় ও স্পাইনাল কর্ডের সংযোগ স্থানে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
৩। উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষকের শাস্তি খুব দ্রত করা হয়। অপরাধীকে একটি ফায়ারিং স্কোয়াড দ্বারা তার মাথা বা অত্যাবশ্যক অঙ্গে গুলি করা হয় হয়। এতে অপেক্ষাকৃত দ্রুত আসামি নিহত ও ভুক্তভোগী তাৎক্ষণিক বিচার পায়।
৪। আফগানিস্তানে ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়া হয় অথবা বা মাথায় গুলিতে করে মারা হয়। শাস্তি অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার চার দিনের মধ্যে দেওয়া হয়।।
৫। ইরানেও ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
৬। গ্রীস, ইজরাইয়েল, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও জরিমানা করা হয়।
৭। আমাদের দেশে ‘ধর্ষণের পর হত্যার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদন্ড’-এমন বিধান দিয়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের তিনটি ধারাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। যে আইনটিকে রহিত করে ২০০০ সালে‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ করে বাংলাদেশ সরকার।
সে আইনে ধর্ষণ ও হত্যার সাজা মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবনের বিধানও রাখা হয়। তবে নতুন এ আইনেরও একটি ধারাকেও অসাংবিধানিক বলেছেন আপিল বিভাগ। যে ধারায় বলা হয়েছিল- ‘১৯৯৫ সালের আইনে করা মামলা সেই পুরোনো আইনেই চলবে’।
আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে ধর্ষণের পর হত্যা সংক্রান্ত পুরাতন ও নতুন সব ধরনের মামলায় সর্ব্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।যেখানে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সাজা হিসেবে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল।
আইনজীবীদের মতামত, কোনো অপরাধেরই একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অন্য শাস্তিও হতে পারে। দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে কেউ কম অপরাধী, আবার কেউ বেশি অপরাধীও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী। কারণ, অপরাধের ধরন অনুযায়ী সাজা কম বা বেশি হতে পারে।
এ নিয়ে ইসলাম কী বলেঃ
ইসলাম ধর্ষণকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। কারণ ইসলামে ধর্ষণ ভিন্ন কোনো অপরাধ নয়। বরং বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌন সঙ্গমই ইসলামে অপরাধ। যাকে “যিনা” শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে।
যিনা সুস্পষ্ট হারাম এবং শিরক ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ। আল-কুরআনে আছে:
বং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে। কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (ফুরকান, ৬৮-৭০)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (ইসরা, ৩২)
যিনার শাস্তি
ইসলামে যিনার শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। যিনাকারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশত ছড়ি মারা হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তি।
ধর্ষণের শাস্তি
ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে যিনা সংঘটিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। কেবল জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় সংঘটিত হয়। ১. যিনা ২. বলপ্রয়োগ/ ভীতি প্রদর্শন।
প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত যিনার শাস্তি পাবে। পরেরটির জন্য ফকীহদের একটি অংশ বলেন, মুহারাবার শাস্তি হবে।
মুহারাবা (محاربة) হলো, পথে কিংবা অন্যত্র অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার দুটোই হতে পারে।
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। (মায়িদা: ৩৩)
এখানে হত্যা করলে হত্যার শাস্তি, সম্পদ ছিনিয়ে নিলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেয়া, সম্পদ ছিনিয়ে হত্যা করলে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করা – এরূপ ব্যখ্যা ফকীহগণ দিয়েছেন। আবার এর চেয়ে লঘু অপরাধ হলে দেশান্তরের শাস্তি দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টি করে করা অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর।
এ আয়াত থেকে বিখ্যাত মালেকী ফকীহ ইবনুল আরাবী ধর্ষণের শাস্তিতে মুহারাবার শাস্তি প্রয়োগের মত ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, ধর্ষক যদি বিবাহিত হয়, তাহলে এমনিতেই তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কিন্তু সে বিবাহিত না হলে তাকে বেত্রাঘাতের পাশাপাশি বিচারক চাইলে দেশান্তর করতে পারেন। কিংবা অপরাধ গুরুতর হলে বা পুনরায় হলে অবস্থা বুঝে মুহারাবার শাস্তিও প্রদান করতে পারেন।
ইসলামে ধর্ষণ প্রমাণ করা:
যিনা প্রমাণের জন্য ইসলামে দুটোর যে কোনোটি জরুরী। ১. ৪ জন স্বাক্ষ্য ২. ধর্ষকের স্বীকারোক্তি।
তবে স্বাক্ষ্য না পাওয়া গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ভিডিও, ধর্ষিতার বক্তব্য ইত্যাদি অনুযায়ী ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে স্বীকার করার জন্য চাপ দেয়া হবে। স্বীকারোক্তি পেলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হবে।
উপসংহারঃ এ দেশে ধর্ষনের সেঞ্চুরী উদযাপিত হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে, হাসপাতালে, উপসানালয়ে, বিদ্যালয়ে, রাস্তায়, বাড়িতে, দোকানে, বাজারে, আকাশপথে, জলপথে সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারী ধর্ষিত হয়েছে। সোজা কথা কিছু কাপুরুষের কাছে নারী তুলোর চেয়েও নরম কিছু বস্তু যা ছিড়ে ফেলা যায়। এ কালস্রোত বন্ধ না করলে ঘরে ঘরে ধর্ষিতা পাওয়া যাবে। তখন একজন ধর্ষকের শাস্তি না হবে তার নিজের ক্ষেত্রে কিন্তু নারীতো নির্যাতিতোই হলো। এতো বড় মহামারী বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হতে পারে কিন্তু ক্ষমা'র পথ যেনো খোলা না হয়।
শেষ কথাঃ শেষ আলোচিত ধর্ষন তনু। এখান থেকেই শুরু হোক আমাদের আন্দোলন। অন্তত একজন ধর্ষককেও যদি এ দেশে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হতো!
কৃতজ্ঞতাঃ এ লেখার অনেক তথ্য ইন্টারনেট থেকে নেয়া আর মতামতের দায় আমার সম্পূর্ণ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:১২