তখন টাইটানিক পৃথিবীর বৃহত্তম এবং সেরা জাহাজ। ১৯০৯ সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত (বেলাফাস্ট হারল্যান্ড) জাহাজ তৈরি সংস্থা টাইটানিক তৈরির কাজ শুরু করেন। বিশ্বজুড়ে খবরটা তোলপাড় শুরু করে দিলো। বিত্তশালীদের মাঝে প্রতিযোগিতার ঝড় বইতে লাগল। যাত্রী হওয়ার জন্য একটা টিকিটের প্রয়োজন। টাকা থাকলেও হবে না কারন টিকিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অবশেষে ১৯১২ সালের ১২ জানুয়ারি টাইটানিকের কাজ শেষ হলো।
টাইটানিকের নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল ইস্পাত। জাহাজটির ছিল ২টি তলদেশ। ৩টি ইঞ্জিন, ১৬টি পানি রোধক কক্ষ, ১৪টি লাইফ বোট। ২ দশমিক ২৫ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের তৈরি টাইটানিকের দৈঘ্য ছিল ৮৫২৫ ফুট এবং প্রস্থ ৯২৫ ফুট আর টাইটানিকের ভর ছিল ৪৬৩২৫ টন। জাহাজে রান্নার জন্য কর্মী ছিল ৬৬ জন এবং আরও ৩৬ জন তাদের সহকর্মী ছিল।
টাইটানিকের ক্রুর সংখ্যা ছিল ৮৮৫ জন এবং যাত্রীর সংখা ছিল ১২৭৪ জন। সব মিলিয়ে মোট ২২৬১ জন । খাবার পরিবেশন এর দায়িত্তে ছিলেন ফরাসি রঞ্জনবিদ্যার জনক অগসত এসকফের । ক্যাপ্টেন জনস্মিথের পরের স্থান ছিল (বেতন এবং পদমর্যাদার কারনে) শেফ চার্লাস প্রোক্টরের । তাছাড়া টাইটানিকে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড মূল্যের মালামাল ছিল ।
বেলাফাস্ট ইয়ার্ড থেকে যখন জাহাজটি নববধূর সাজে বেরিয়ে এলো তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল শুধু যাত্রীরাই নয় , টাইটানিকের পেইন্টার মিঃ ডেভ উইলিয়াম সহ দর্শনার্থীরাও । পরিশেষে জাহাজ নির্মাণ সংস্থা, যাত্রী, ক্রুরাও নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে মনে দাবি করছিলেন । সবাই বলাবলি করছিলেন, ব্রিটেনের “হারল্যান্ড” জাহাজ নির্মাণ সংস্থা অন্তত এ ধরনের একটা ভাসমান সবপ্নবিলাসী জাহাজের বাস্তব রূপ দিতে পেরেছে । ১৯১২ সালের ১০ই এপ্রিল বুধবার সকাল হতে ভিড় জমেছে “সাউদাম্পটন” বন্দরে । টাইটানিক ভাসছে যাত্রীরা আসছে । সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে যাচ্ছে । ঠিক তখন ১২ টা বাজে । ডেকের ওপর বাজনার তালে তালে বাঁশির সুরে নানান খুশিতে সবাই মশগুল হয়ে আছে । কিছুখন পর যাত্রীরা জাহাজে উঠে পড়লেন । এতোক্ষনে ক্যাপ্টেন “এডওয়ার্ড জনস্মিথ” যাত্রীদের নিয়ে আটলান্টিকের পথ ধরে ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করলেন নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে । টাইটানিক চলছে তো চলছেই । পিটহেড, আইল অব ওয়াইট পার হয়ে চেরাবুর্গে পৌছালো সন্ধায় । অতঃপর ১১ এপ্রিল ব্হস্পতিবার রাত ১ টা ৪০ মিনিটের সময় কুইন্স টাউন নামক স্থানে কিছুক্ষনের জন্য যাত্রা বিরতি করলো । বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হলো । এ সময় ফ্যানের পাখাগুলো মিনিটে ৭৫ বার করে ঘুরছে । ফানেলগুলোর সাদা কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাচ্ছে । ১৪ এপ্রিল রবিবার হঠাৎ করে বেতার যন্ত্রে ভেসে এলো টাইটানিকের গতিপথে রয়েছে বরফ খন্ড । তখন স্থানীয় সময় সকাল ৯ টা । যাত্রীরা দেখছে পরিষ্কার নীল আকাশ । চারিদিকে সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি ঝলমল করছে সমস্ত সাগর । মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে । ২২ নর্টিক্যাল মাইল গতিতে অবিরাম ছুটে চলেছে পৃথিবীর সর্ববৃহত জাহাজ টাইটানিক । তখনই কিনা সেকেন্ড অপারেটর হ্যারল্ড ব্রাইডের কাছে “ক্যালিফোর্নিয়ান” জাহাজটি ৩টি বরফ খন্ডের সংকেত দিয়েছিলো । অতঃপর হ্যারন্ড ব্রাইড ১টা ৪২ মিনিটে পাঠানো সমকোড বেতার সংকেতটি ক্যাপ্টেনের হাতে দিলে তিনি সেটা পড়ে দিলেন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে । এটি ছিল “বালটিক” জাহাজের পাঠানো সংকেত । তাদেরও একই সংকেত পথের মাঝে বরফ খন্ড । সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে । বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও জাহাজের ভেতরে বোঝার কোন উপায় নেই । আলোর ঝলকানিতে একেবারে দিনের আলো । যাত্রীরা যার যার ইচ্ছা মতো নৈশ ভোজনে ব্যাস্ত ।
তখন রাত ১০টা । সেকেন্ড অফিসার ডিউটি পাল্টালে ফার্স্ট অফিসার “মারডক” দায়িত্ত নিলেন । চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ রাত । অনেকেই ঘুমিয়ে গেছেন । “মারডক” ব্রিজে হাটাহাটি করছেন । সে সময় অর্থাৎ “১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৪০ মিনিটে” টাইটানিক এক ভয়ঙ্কর এলাকায় হাজির হলো । চারিদিকে তুলার গাদার মত অস্পষ্ট সাদা সাদা, খন্ড খন্ড বরফের ছোট বড় টুকরো ভাসছে । এ স্থান হলো “ফাউন্ডল্যান্ড” থেকে ৪৩৫ মাইল দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম কোণে । টাইটানিক কিন্তু পূর্বেই কমপক্ষে “পাঁচটি সতর্কবাণী সংকেত” পেয়েছে । আর এ দুর্গম পথে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরও বরফ খন্ডের মধ্যে জাহাজটি আটকা পড়ে গেছে । দুরাবস্থা দেখে টাইটানিকের পর্যবেক্ষক ফ্লিটের কথায় ফাস্ট অফিসার মারডক ইঞ্জিন রুমে নির্দেশ পাঠালেন কোয়াটার মাস্টার হিচেনের কাছে । সম্পুর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে জাহাজটিকে পেছনের দিকে সরানো হচ্ছে বরফখন্ডের চাপের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য । কিন্তু পেছনের দিকে সরানোর সময় পানির নিচে বরফখন্ডের বাধার একটা শব্দ শোনা গেল, যা টাইটানিকের সামনের ডান দিকে আঘাত হানে । ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জনস্মিথ বক্স হল এবং কর্মচারী কারিগরদের আঘাত হানা স্থানে পাঠালেন । দেখা গেল, ফ্লোর প্লেটের ২ ফুট ওপরে ভাঙ্গনের দাগ হয়ে গেছে । ঘুমকাতর যাত্রীদের স্টুয়ার্ডরা বললেন যে, জাহাজে গুরুতর কিছু একটা বাধা বিঘ্নের সৃষ্টি হয়েছে । হঠাৎ করে ৮ ফুট পানি জমে গেল ৬নং ব্রয়লার কক্ষে । টাইটানিকের তলদেশ হতে ২৪ ফুট উঁচু ডাক কক্ষটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে জিনিসপত্র ভাসতে লাগল । সেই সাথে টাইটানিকের ৩০০ ফুটের উপরি ভাগের একটা অংশ ছিন্ন হতে চলেছে । নীলস্ফুলিঙ্গ যন্ত্রে কম্পন শুরু হয়েছ । সাহায্যের জন্য “মাউন্ড টেম্পল ও প্রভেক্স দুটি জাহাজ”, ফেডারসের ডিউটিরত কর্মচারী, বেতারযন্ত্রের আবিষ্কারক মার্কনির ব্যাক্তিবর্গদের, এছাড়া ৫৮ মাইল দূরে রিভারপুলগামী নিউইয়র্কের কার্পেসিয়া জাহাজটির কাছে পাঠানো হলো এ দুঃসংবাদের কথা । ফোর্ড অফিসার বক্স হল হিসাব কষে দেখলেন টাইটানিকের অবস্থান “৪১•৪৬ উত্তর অক্ষাংশ ও ৫৪•১০ পশ্চিম দ্রাঘিমায়” ।
টাইটানিকের এ দুঃসংবাদ শুনে বেশ কিছু জাহাজ তাদের গন্তব্য পালটিয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলো টাইটানিকে উদ্ধারের জন্য । ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ড আদেশ করলেন লাইফ বোটগুলোতে আগে মহিলা ও শিশুদের উঠাতে এবং লাইফ জ্যাকেটগুলো পরতে । টাইটানিক যদিও ডুবছে তবুও ব্রয়লার রুমে ইঞ্জিনিয়াররা যুদ্ধ করেই চলেছেন টাইটানিককে বাঁচানোর আশায় । কিন্তু আশ্চর্য ও দুঃখজনক সত্য কথা, তবুও যাত্রীদের মনে বিশ্বাস ছিলো টাইটানিক ডুবতে পারে না । তারা নানান আনন্দ, উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিল । মরনের ফাঁদে পড়ে ঠান্ডা পানির রাশি ও বরফের কুন্ডলী দেখলে মনে হয় গায়ের সব রক্ত জমে জমে যাচ্ছে । তবুও লাইফ বোটে উঠছে না অনেকেই । তখনও কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট যাত্রীদের উঠতে সাহায্য করছিলেন । ওদিকে অন্যান্য রুমের ভেতর পানি আরও ঢুকছে । টাইটানিকে বিরাজ করছে এক সংকটজনক পরিবেশ । লাইফ বোটগুলতে মানুষ উঠছে , কেউবা ঝাঁপ দিচ্ছে মনের হতাশায় । রাকেটের আলো আকাশের চারদিক ঝলকিয়ে দিচ্ছে । ততোক্ষনে ইঞ্জিনরুমে পানি ঢুকে পড়েছে । এরই মাঝে বহুদূরের “এশিয়ান জাহাজটি” আরেকটি সংকেত পাঠালো । পানি ব্রিজ পর্যন্ত উঠে গেছে । ক্যাপ্টেন স্মিথ ঠান্ডা, শীতল পানির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন । লাইটগুলো নিভে যায়নি তখনও । টাইটানিকের চোঙ্গগুলো ভেঙ্গে সামনের ৩০০ ফুট লম্বা একটা অংশ পানির নিচে বসতে লাগলো । অমনি হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে একের পর এক সবকিছু ডেবে যেতে লাগল গভীর সমুদ্রে । শেষ সংকেতটি পাঠায় “ভার্জিয়ান জাহাজটি” । স্টার বোর্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাইটানিকের নির্মাণকারীদের একজন অর্ধডুবন্ত জাহাজটিকে পর্যবেক্ষন করছিলেন । তিনি মনে মনে ভাবছিলেন পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যে, গর্বের টাইটানিককে ডোবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে । শেষ পর্যায়ে যাত্রীদের তেমন কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না । অনেক যাত্রী লাইফ বোটএ না চড়ে, লাইফ জ্যাকেট না প ড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল । মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করার জন্য শেষ মুহূর্তে মুম্বন ও প্রীতিজ্ঞপন চলছিল । “১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল শুক্রবার রাত তখন ২টা ২০ মিনিট” । ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে টাইটানিকের মহা চ্যালেঞ্জের অবসান হল । প্রায় ১২ হাজার ফুটেরও বেশি পানির নিচে টাইটানিক চলে গেছে, এর পরে প্রথম উদ্ধারকারী জাহাজ হিসাবে আসে “কার্প্রৌ-থ্রী” । প্রায় ৩ বছর অক্লান্ত সাধনায় তৈরিকৃত টাইটানিক মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে তছনছ হয়ে গেল । “নাবিক, যাত্রীসহ ১৫০৩ জনের মৃত্যু হয় এবং ৬৯৮ জন প্রাণে বাঁচে” ।
টাইটানিকের ফাস্ট অপারেটর ফিলিপস ক্যালিফোর্নিয়ান জাহাজের অপারেটরকে (বরফ খন্ডের যে সতর্ক সংকেত দিয়েছিল) তার জন্য প্রাপ্য ধন্যবাদ না দিয়ে কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন । যার দরুণ ক্ষোভে ডিউটি শেষে “ইয়ার ফোন” খুলে রাখেন তিনি । এর ফাঁকে গর্বের টাইটানিক ডুবছে ।
উদ্ধার অভিযানের পর যাদের লাশ পাওয়া যায় তাদের এই খানে সম্মানের সাথে সমাধিত করা হয়।