চৈত্রের সন্ধ্যাবেলা ট্যাপের পানি আগুন গরম। খুলনা টু ঢাকা জার্নিতে ধুলো গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে উঠেছি। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শ্যাম্পু করতে করতে গতকালকের সন্ধ্যার কথা ভাবছিলাম। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দুপুরে আর ভাত খাইনি। শুয়ে ছিলাম। কখন ঘুমিয়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভেঙে দেখি বিকেল সাড়ে পাঁচটা। দরজার কাছে মেঝেতে মাদুর পেতে আম্মা ঘুমিয়ে আছেন। আমার নড়াচড়ার শব্দে ওনার পাতলা ঘুম ভেঙে গেলো। আম্মাকে বললাম ভাত দিতে।
কলের শীতল জলে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি আম্মা ভাত রেডি করে ফেলেছেন। আম্মাও খাননি। মায়ে পুতে একসাথে বসলাম অবেলায় দুপুরের ভাত খেতে। প্রথমে দিলেন ঝিঙের ঝোল। ঝাল ঝাল করে রেধেছেন। ভালই লাগলো। এর পরে কুমড়োর বড়ি দিয়ে রুই মাছ ঝোল। মন্দ লাগলো না। তবে আখাস্তা গরমে আর কুমড়োর বড়ি তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হলো না। এরপরের আইটেম আমার বেসম্ভব প্রিয়। শোল মাছের দোঁপেয়াজা। আমি বাড়ি গেলে আম্মা চেষ্টা করেন শোল মাছের দোপেয়াজা রান্না করতে। স্বর্গীয় স্বাদ অনুভব করলাম। স্বাভাবিকের তুলনায় আজ ভাত বেশী খেলাম। তোমরা ভাবো আমি মহা খাদক। আমি আসলে ভাত কম খাই। অন্য অনেকের চেয়ে। তবে যা খেতে ভালো লাগে তা উপভোগ করেই খাই। তবে এখনি আম্মার হাত থেকে রেহাই পেলাম না। শীত কালে এবার বাড়ি যাইনি বলে খেজুরের রসের পায়েস খাওয়া হয়নি। আম্মা আমার জন্য রসের পায়েস রেধে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন। এত দিন বাদে পায়েসের স্বাদ গন্ধ একটুও বদলায়নি। খেঁজুরের পায়েস জিন্দাবাদ!
খেয়ে দেয়ে জামা জুতো পরে আমাদের বাড়ি দেখতে গেলাম। বাড়ি বলতে এক টুকরো জমি। নামে মাত্র এক ঘর ভাড়াটে। কিছু গাছ গাছালি। ছোট্ট একটা পুকুর। আম্মা অসুস্থ বলে আজকাল আর ওদিকে যান না। তাই খবরদারি করতে যাওয়া আর কি। আম্মা একটা নেটের ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। যদি শিমুল তুলা গুলো পেঁকে ফেটে গিয়ে থাকে তাহলে যেন ব্যাগে ভরে নিয়ে আসি। হেঁটে যেতে গিয়ে পুরোই ঘেমে ভিজে গেলাম। কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। মিনিট দশেকের পথ মাত্র।
বাড়িতে কেউ নেই। আমি উঠোনে দাঁড়ালাম গাছগাছালিতে বাড়িটা বেশ ঝোপালো হয়েছে। যখন জায়গাটা কিনি তখন মাত্র চারটা নারিকেল গাছ আর একটা শিরিষ গাছ ছিলো। এখন তো পুকুরের দুই পাশে কলার ঝাড়ে এটে গেছে। আরো কিছু নারিকেল আর খেঁজুর গাছ বেড়ে উঠেছে। কলাগাছে তিন কাঁদি কলা ঝুলছে। নারিকেল গুলোও বেশ পাড়ার মত হয়েছে। শিমুল গাছটা খুঁজে পেলাম। টিংটিঙে গাছটাতে গোটা আটেক ফল ধরেছে। এখনও পাঁকার বহু বাকি। বোঝা যাচ্ছে আম্মার শখের শিমুল গাছ। জানিনা এই কটা তুলো দিয়ে উনি কি বানাবেন। সজিনার গাছটা মাজা থেকে ভেঙে গেছে বোধহয়। নতুন ডাল গজিয়েছে।
কবরখানার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে চলে এলাম। এই পথটা একসময় ঘেরের বাধ ছিলো। তখন হাই স্কুলে পড়তাম। কারা যেন এসে বিলের মাঝখানে এক খানা ঘর তুলে বাস করা শুরু করে। অবাক হয়ে ভাবতাম এই বিজন প্রান্তরে এরা কিভাবে বাস করে। এখন দেখছি পথটা পিচ ঢালা পাকা রাস্তা। দুপাশে বাড়ি ঘরে এটে গেছে। সময়ের চেয়েও বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশ। নদীর পাশে বেশ বাতাস বইছে।
বাবুই পাখিটাকে ফোন দিলাম। গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি। সমিলের পাশে রাখা কাঠের গুড়ির উপর উঠে বসলাম। ঘন্টা দুয়েক বসে রইলাম। নদী আমি বড্ড ভালোবাসি। এই নদীর পাড়েই কেটেছে আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলি। হঠাৎ মনে হলো আর যদি দেখা না হয় এই নদীর সাথে! কখন যে চোখ ভিজে গেছে নিজেও টের পাইনি। সাধে কি সাদ্দাদ বাদশা পৃথিবীতেই তার স্বর্গ নির্মান করতে চেয়েছিলেন। তোমরা তার অহংকারী রূপটাই দেখলে, ভালোবাসার অন্তরটাকে উপলব্ধি করলে না।
নটার দিকে বাসায় ফিরলাম। বাড়ির মধ্যে যেন বাতাসের ঢুকতে মানা। গুমোট গরম। সাড়ে নটায় আম্মা ভাত খেতে ডাকলেন। আবার কিভাবে খাই! আম্মা বললেন, দুধ গরম করে দিয়েছি। কলা দিয়ে খাও। প্লেটের মধ্যে প্রায় পোয়াটাক দুধ আর দুটো গাছে পাকা সবরি কলা দিয়ে রেখেছেন। এতগুলো ভাত খেয়ে হাঁসফাঁস করছি। আব্বা বাড়ির বড় ছেলে। একটা সময় ছিলো যখন তার বেতন কম ছিলো। তাকে আমাদের সংসার, দাদাজানের সংসারেও অবদান রাখতে হতো। তখন এরকম এক পোয়া দুধ আর দুটো কলা আমাদের চারজনকে ভাগ করে খেতে হতো। এরপর কাকারা বড় হলেন। সবাই আলাদা হয়ে গেছে। আব্বারও বেতন বেড়েছে। এখন আম্মা যেন শৈশবে না পারা খাওয়ানোটুকু সুদে আসলে উসুল করতে চান। খেয়ে উঠেছি এমন সময়ে আম্মা সেমাই নিয়ে এলেন।
আবার সেমাই কেন! জবাবে আম্মা বললেন, এত অল্প সময়ে উনি খাওয়াবেন কখন। বললাম সেমাই সকালে খাবো। ফ্রিজে রেখে দেন। খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট করিয়ে বিদ্যুৎ দিলো দৌড়। গরমে বাড়ির উঠোনে রাখা খাটের উপরে বসলাম। তাও শান্তি নেই। বিদ্যুৎ আসা মাত্র ফ্যানের নিচে দে দৌড়। পারলে তো ফ্রিজের মধ্যে গিয়ে বসি। আম্মা একজগ পানি রেখে দিয়েছেন ডেস্কটপের টেবিলের পায়ের কাছে। আম্মা জগভরে পানি ফ্রিজে রাখেন। এই পানির স্বাদ ঠান্ডা নরমাল মিশেল পানির স্বাদ থেকে বেশী হয়। পরীক্ষা করে দেখতে পারো। তবে ডিপে নয়, নরমালে রাখবে। এরপর ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত পোহালেই যে আমাকে ফেরার পথ ধরতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৩