অন্য পর্বগুলো
ইতিহাসের চাইতে আজ ব্যাক্তিগত কথা হয়েছে বেশি। আমি সোহেল ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আচ্ছা এক বছর বুয়েটে পড়ার পর আপনি আবার ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলেন কেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি যদি প্রথম বছর মেডিকেলে পড়তাম তাহলে পরের বছর বুয়েটেই ভর্তি হতাম।
সোহেল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় পর্বটা বেশ মজাদার। আগের কোন একটা লেখায় তার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছি। একদিন ফোনে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই আপনি কি বিবাহিত। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার ফোন কেটে দিয়েছিলেন। শুধু তাই না, ফেসবুকে আমাকে আনফ্রেন্ডও করে দিলেন। এরপর থেকে অনেক সাবধান হয়ে গিয়েছি। কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করি না, তিনি নিজে থেকেই যেটা বলেন সেটুকুই শুনি।
কার্জন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছি। ঢাকার তাপমাত্রা তখন ৩৮ এর বেশি। প্রচন্ড রোদ যেন বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ছে। কিন্তু তারপরেও হাটতে ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, অসম্ভব রকমের ভালো।
ঢাকার সেরা স্থাপত্য নিদর্শনের প্রথম সারির একটি হচ্ছে কার্জন হল। এটি নাকি মোঘল সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেপুর সিক্রির দেওয়ান-ই-খাস এর কিছুটা অনুকরণে তৈরী করা হয়। ১৯০৪ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী জর্জ নাথানিয়েল কার্জন যিনি সেসময় ভারতের ভাইসরয় ও গভর্ণর জেনারেল ছিলেন তিনি এর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯০৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। এরপর থেকেই এই ভবনটি এই উপমহাদেশের সবচাইতে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি ঢাকা কলেজের ক্লাসরুম হিসাবে ব্যাবহৃত হতে থাকে। কিন্তু ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো তখন ঢাকা কলেজ তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, লাইব্রেরী, বই-পত্র, হল, বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি ইত্যাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করে নিজে স্থানান্তর হয়ে গেল। ভবনটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ। তবে সব ইতিহাসকে ছাপিয়ে যায় ১৯৪৮ সাল। পাকিস্তানের জাতির পিতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি ঢাকায় এসে কার্জন হলে গিয়ে ঘোষনা দিয়েছিলো যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সরাসরি প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছিলো জিন্নাহ এখানেই। আর এই প্রতিবাদ করেছিলো এখানকার ছাত্ররা। ধাপে ধাপে বাংলা তো রাষ্ট্রভাষা হলোই বাংলাদেশও স্বাধীন হলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে জিন্নাহর কবরের ফলক কিন্তু বাংলাতে লেখা।
কার্জন হল পেরিয়ে দোয়েল চত্বরকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম তিন নেতার মাজারের দিকে। এখানেই রয়েছে ঢাকা গেট।
ঢাকা গেট সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকা গেটের আরেকটি নাম মীর জুমলার গেট। মূলত মোঘল আমলেই এই নাম ছিলো। ইসলাম খাঁর আমলে রমনা অঞ্চলে যে বাদশাহী বাগান ছিলো তার প্রবেশপথ হিসাবে ব্যাবহৃত হতো এই তোরণ। পরে বৃটিশ আমলে যখন যখন ঢাকাতে রেসকোর্স তৈরী করা হলো (বৃটিশরা মনেহয় জুয়াখেলা খুবই পছন্দ করতো। যেখানেই তারা শাসন ও শোষণ করতে গিয়েছে মোটামুটি সেখানেই তারা রেসকোর্স তৈরী করেছে।) তখন সেই জুয়ার আসরে যাতায়তের সুবিধার্থে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস একটি রাস্তা তৈরী করেন। এই রাস্তার প্রবেশ মুখেই এই তোরণ বানানো হয়। তখন থেকেই এর নাম ঢাকা গেট। মোঘল আর ব্রিটিশ দু’আমল মিলিয়েই এই দরজাটি তৈরী।
ঢাকা গেটের তিনটা অংশ। মাঝখানে একটা গোল স্তম্ভ যেটি বর্তমানে আধুনিক প্রশস্থ সড়কের সড়ক বিভাজকের মধ্যে পড়েছে। বাকী দুটি অংশ দেয়াল আকৃতির যেগুলো সড়কের দুপাশে। একটি প্রাচীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে আর অন্যটি তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণে।
ঢাকা গেটের সাথেই তিন নেতার মাজার। এই মাজারের স্থাপনাটি দেখতে অদ্ভুত এবং দৃষ্টিনন্দন। ১৯৬৩ সালে এই হৃদয়গ্রাহী মনুমেন্ট তৈরী করা হয়।
শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার সুবিশাল কর্মজীবনে তিনি অবিভক্ত বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬২ সালে বৃদ্ধাবস্থায় তিনি ঢাকায় মারা যান।
হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ১৮৯২ সালে ভারতে একটি উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। সুবিশাল কর্মজীবনে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ত্ব পালন করেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা করার জন্য একদিন তিনি সরকারী ছুটি ঘোষনা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন ১৮৯৪ সালে ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সুবিশাল কর্মজীবনে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ত্ব পালন করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে সবচাইতে ঘোর বিরোধীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই প্রথম সারিতে। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
এই তিনজনকে মৃত্যুর পর ঢাকা গেটের পাশে দৃষ্টিনন্দন মনুমেন্টটির নীচে সমাহিত করা হয়। তারপর থেকেই এটি তিন নেতার মাজার হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
তিন নেতার মাজারের পিছনেই রয়েছে খাজা শাহবাজের মসজিদ। হাটতে হাটতে সেখানে গেলাম।
শাহবাজ নামক একজন ব্যাক্তি যিনি হাজী এবং ব্যাবসায়ী ছিলেন তিনি কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন। ১৬৯৭ সালে তিনি এই সুদৃশ্য মসজিদটি তৈরী করেন। একই সাথে জীবিত অবস্থায় তিনি তার মাজার তৈরী করেন। মসজিদটি দেখতে খুব সুন্দর এবং এটি এখনো পর্যন্ত ভালো অবস্থায় আছে। প্রচন্ড রোদের কারনে মসজিদের চত্ত্বরটিতে সামিয়ানা টাঙ্গানো যেন মুসল্লীদের কষ্ট কম হয়। এই সামিয়ানার কারণে মসজিদের সৌন্দর্য অনেকখানি ঢাকা পড়েছে। মসজিদের লাগোয়া রয়েছে মাজারটি। এটি দেখতেও খুব সুন্দর। এই মসজিদ ও মাজারটি বেশ ভালোভাবেই সংরক্ষণ করা হয়েছে যা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
খাজা শাহবাজের মসজিদটি দেখার পর আমরা গেলাম রমনা কালীবাড়ি দেখার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করতে পারলাম না। কালীবাড়ি যাবার দরজা বন্ধ এবং একজন পুলিশ সেখানে পাহারা দিচ্ছে। সে আমাদেরকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো না। সোহেল ভাই ব্যাপারটিতে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আজ আর কোন হিন্দু স্থাপনা পরিদর্শনে যাবো না।
ঘুরে চলে এলাম আমরা কার্জন হলের দিকে। কার্জন হলের পিছনে রয়েছে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবর। ১৯৬৯ সালে এই জ্ঞানতাপস যখন মারা যান তখন তার সম্মানার্থে ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদুল্লাহ হল রাখা হয়। বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ভাষা আন্দোলনের বুদ্ধিজীবি এই মানুষটার কবর আরো সযত্নে রাখা যেত।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবরের পাশেই রয়েছে মুসা খাঁর মসজিদ। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল ছিলেন ঈসা খাঁ। মুসা খাঁ ছিলেন ইশা খাঁর পুত্র। মোঘল সুবেদার ইসলাম খাঁর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী এবং নির্বাসিত হয়েছিলেন মুসা খাঁ। মুসা খাঁর পরিবার পরবর্তীতে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
দোতলা এই মসজিদটির স্থাপত্যরীতি খুবই সুন্দর। কিন্তু সংস্কারের অভাবে এটাকে অনেক ম্লান দেখায়। মসজিদের পাশেই রয়েছে মুসা খাঁর কবর। এটির অবস্থাও ততোটা ভালো না।
মুসা খাঁর মসজিদ দেখা শেষ হলে আমরা এগিয়ে গেলাম শহীদুল্লাহ হলের দিকে। শহীদুল্লাহ হলের পুকুর একটি জীবন্ত কিংবদন্তী। অসাধারণ রুপসী এই জলাধারটিকে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ। এই পুকুরে সাতার কাটতে গিয়ে ৩০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। খুবই সাম্প্রতিক সময়ে এইরকম দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে আরেকজন। ব্যাপারটি সত্যিই দুঃখজ্বনক।
তবে পুকুরপাড়টিতে বসলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পুকুরের চারপাশ ঘিরে আছে নারকেল গাছ। কয়েকটি ঘাট রয়েছে যেখানে বসার সুন্দর ব্যাবস্থা আছে। এই প্রচন্ড গরমেও পুকুরের এই এলাকা জুড়ে ঠান্ডা প্রাণশীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে। সত্যিই মন ও প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমি আর সোহেল ভাই গিয়ে বসলাম একটা ঘাটে। আর তারপর যে সময় কোথা দিয়ে বয়ে গেল একেবারেই টের পেলাম না।
আনমনা হয়ে ছিলাম, অনেকক্ষণ পর সোহেল ভাই বললেন যে তার বাইসাইকেলের জন্য একটা পাম্পার কেনা দরকার। আমরা তখন এগিয়ে চললাম বংশালের দিকে। বঙ্গবাজার পার হয়ে আমরা যখন পুরানো ঢাকার আলাউদ্দিন রোডে ঢুকলাম তখন ঐতিহ্যবাহী মোঘল খাবারের সুঘ্রানে চারপাশ ম ম করছে। আমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। আসলে স্বাদের দিক দিয়ে ঢাকার খাবারের কোন তুলনাই হয়না। পুরানো ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে পুরানো দিল্লীর খাবার যোজন যোজন পিছিয়ে থাকবে। সোহেল ভাইও আমার সাথে পুরোপুরি একমত হলেন। দুপাশে বিখ্যাত বিখ্যাত সব খাবারের ছড়াছড়ি, মাঝখান দিয়ে রিক্সার জ্যাম ঠেলে আমরা দুজন এগিয়ে চলেছি।
বিঃদ্রঃ অধিকাংশ তথ্য শ্রদ্ধেয় লেখক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখালেখি থেকে এবং ব্যাক্তিগত বড়ভাই সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
অন্য পর্বগুলো
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৪