প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী ও পুরানো ঢাকা (এক-তৃতীয়াংশ)
প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী ও পুরানো ঢাকা (তিন-তৃতীয়াংশ)
অন্য পর্বগুলো
বাংলাবাজারের পথ ধরে হাটার সময় সোহেল ভাইকে হাসতে হাসতে বলছি, ভাই দেখেন এখানে কিন্তু কোন ফরেনার নেই। অথচ এটা দিল্লীতে হলে সাদা চামড়ার পর্যটকে গিজগিজ করতো। সোহেল ভাই কিন্তু আমার কথা শুনে হাসলেন না, কারণ তিনি জানেন যে আমি এক অপ্রিয় সত্য কথা উচ্চারণ করেছি।
বাংলাবাজার মোড়ে রয়েছে বিখ্যাত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল
বাংলাদেশের প্রথম সরকারী স্কুল এটি। ১৮৩৫ সালে এক ইংরেজ কুঠিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বিখ্যাত ঢাকা কলেজ সৃষ্টি হয়েছিলো এই স্কুল থেকেই। ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার ক্লাস হতো ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের দ্বোতলায়।
বাংলাবাজার পার হয়ে আমরা ঢুকলাম পাটুয়াটুলিতে।
পাটুয়াটুলি
জায়গাটার আসল নাম হচ্ছে পটুয়াটুলি। কালের বিবর্তনে এটি পাটুয়াটুলি হয়ে গেছে। একসময় এখানে পটুয়ারা বসবাস করতো, সেই থেকে এই নামকরণ।
শর্টকাটে যাবার জন্য ঘী পট্টির রাস্তা ধরলাম। এখানকার একটা টং-এ আমরা ক্লাসমেটরা মিলে চা খাই। চা দোকানদার মামা মাঝে মাঝে গল্প করেন। একদিন তিনি বলছিলেন যে নবাববাড়ি থেকে নাকি ঘি পট্টির তিনটে বাড়ি পর্যন্ত সুড়ঙ্গ আছে। নবাব আমলে এই এলাকাটা ছিলো নাকি বেশ্যা পাড়া। সুড়ঙ্গগুলো দিয়ে নাকি নবাববাড়িতে বেশ্যা সমাগম হতো। কি জানি তার গল্পের সত্যতা কতোটুকু!! তবে তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে একদিন আমাকে এই সুড়ঙ্গগুলি দেখাবেন, আমি অধীর আগ্রহে সেগুলি দেখার অপেক্ষা করছি।
সোহেল ভাইকে এই মামার দোকানে চা খাওয়ার আমন্ত্রন জানালাম। কিন্তু আমি চা খাবোনা শুনে তিনিও আর খেতে রাজী হলেন না। ঘী পট্টির সরু গলি দিয়ে আমরা আরো সামনে এগিয়ে চললাম।
সোহেল ভাই ততোক্ষণে তার ভুটান ভ্রমনের গল্প শুরু করেছেন। ভুটানে গিয়ে তিনি তার এক ভুটানি ছাত্রীর বাবার যে আপ্যায়নের খপ্পরে পড়েছিলেন সেই গল্প।
অবশেষে আমরা এসে পৌছালাম শাঁখারিবাজারে।
শাখারীবাজার আমার কাছে সবসময়ই অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় যে একলাফে বুঝি দুশো বছর পিছনে চলে গেছি। আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা হচ্ছে এই শাঁখারিবাজার। হঠাত কোন ক্লাস না হলে আমি এই শাঁখারিবাজারের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াই। আগে বেশ কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে আসতাম, প্রথম প্রথম তারা ভদ্রতা করে আসতো। কিন্তু একসময় তারা এখানে না আসার জন্য বিভিন্ন অযুহাত তৈরী করা শুরু করে। এখানকার গন্ধ নাকি তাদের পছন্দ হয় না। আসলে পুরো শাঁখারিবাজার জুড়েই বাসী ধূপ-ধুনোর একটা গন্ধ ভেসে থাকে। কলকাতাতেও এইরকম গন্ধ পাওয়া যায়। আমি গন্ধটা সহ্য করতে পারি, অতোটা অসুবিধা হয়না। তাই আমার এই প্রিয় জায়গাতে একাএকাই ঘুরি।
শাঁখারিবাজারের এই বাড়িগুলো আমাকে প্রচন্ডভাবে টানে। কতো সরু গলি পেরিয়ে এই বাড়িগুলোতে ঢুকতে হয়। আমি তৃষ্ণার্তের মতো এই গলিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। সবসময় মনে হয় যে এই গলির শেষে নিশ্চয় অনেক রহস্য আছে। গলির শেষ প্রান্তের বাসিন্দারা নিশ্চয় অন্য এক রাজ্যের বাসিন্দা।
কিন্তু আমি কখনো এখানকার কোন বাড়িতে ঢুকতে পারিনি, আমার কোন পরিচিত মানুষ নেই এখানে। আর স্বাভাবিকভাবেই এখানকার বাসিন্দারা জগন্নাথের ছাত্রদেরকে পছন্দ করে না। অনেক বছরের অবিশ্বাস মিশে আছে এই অপছন্দে।
আগে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে এখানকার নারীদের সংখ্যাধিক্য দেখা গেলেও ইদানিং বোধহয় নারীরা কম বের হন। অনুষ্ঠানের ছুতোয় বাইরের কতোগুলো কুলাঙ্গার এখানকার মেয়েদেরকে খুবই যন্ত্রনা করে। যেহেতু এখানকার নারীদের পোশাক-আসাক পরার ধরন কিছুটা অন্যরকম যেটা এই পরিবেশের সাথে মানানসই, কিন্তু বাইরের কতোগুলো জানোয়ার সবসময় ভীড়ের মাঝে এই সুযোগটা গ্রহন করে।
শাঁখারিবাজার
ঢাকার সবচাইতে দামীজমি হচ্ছে শাঁখারিবাজারে, সেই চারশো বছর ধরেই।মূলত মোঘলদের হাত ধরেই শাখারীদের ঢাকা আগমন। শাঁখারী মহিলারা বরাবরই সুন্দরী। সেই মোঘল আমল থেকেই এখানকার সুন্দরী নারীদেরকে অপহরন করা হতো। শাঁখারীবাজার থেকেই পুরো বাংলায় হিন্দুদের শাখা সরবরাহ করা হতো। এখানকার শাখার মান খুব ভালো।
সোহেল ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এখানকার মন্দিরগুলো কই? আমি বললাম যে আছে বেশ কয়েকটা। তিনি বললেন যে এখানে পূজা হয় কোথায়, এতো ছোট জায়গায়। জানালাম যে পূজার সময় রাস্তায় রিক্সা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। রাস্তার উপরেই উচু করে একটু পরপর মন্ডপ বানানো হয়, আর মন্ডপের নীচে মানুষ চলাচলের জন্য রাস্তা রাখা হয়।
শাঁখারিবাজারের ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে সরু একটা গলি দিয়ে তাঁতিবাজারের রাস্তায় ঢুকলাম। হাটতে হাটতে এগোচ্ছি। সোহেল ভাই দিল্লীর গল্প করছেন। দিল্লী হচ্ছে সিটি অফ সিটিজ। সাতটি শহরের সমন্বয়ে দিল্লী শহরটা গড়ে উঠেছে। কত্তো কিছু দেখার আছে দিল্লীর সেই গল্প করছেন। অকারনেই মন খারাপ হয়ে যায়। আচ্ছা, আমাদের ঢাকা শহরের কি কম আছে দেখার!! কিন্তু কিছুই তো সংরক্ষন করতে পারিনি। চোখের সামনে রুপলাল হাউজের ছবিটা ভেসে উঠলো।
তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ালাম, একটা তো শাঁখারী বাজার দিয়ে এসেছি। ডানদিকেরটা তাঁতিবাজারের।
তাঁতিবাজার
একসময় এখানে তাঁতিরা বসবাস করতো। মোঘল আমলে এখানে একটা বাজার গড়ে ওঠে। সেই থেকেই তাঁতিবাজার।
সামনের বাড়িটা দেখিয়ে সোহেল ভাইকে বললাম যে এটা হচ্ছে বিখ্যাত অভিনেতা প্রবীর মিত্রের বাড়ি। বাড়িটার সামনেই একটা মন্দির আছে। সবসময়ই লোকে গমগম করে জায়গাটি।
এখানে একটা নিরামিষ হোটেল আছে, বিষ্ণুপ্রিয়া। আহামরি খাবার না হলেও মাঝে মাঝে স্বাদ বদলাতে ভালোই লাগে। খরচ খুব কম, অনেকগুলো তরকারি সামনে রেখে জিজ্ঞাসা করে যে কোনটা খাবেন। সবচাইতে অবাক লাগে যে এখানে বেগুনি দিয়ে ভাত খেতে হয়। বাঙ্গালী হলেও হিন্দু-মুসলমানের খাবার ধরনে ছোটখাটো মজাদার কিছু পার্থক্য আছে। আমরা রমজান মাসে ইফতারির সময় যে বেগুনি খাই, হিন্দুরা সেগুলো ভাতের সাথে খায়। বেগুনি দিয়ে ভাত খাবার এই ধরনটা আমি ইন্ডিয়াতেও দেখেছি। সোহেল ভাইকে আমন্ত্রন জানালাম যে এই হোটেলটাতে খাবার জন্য, কিন্তু তিনি রাজী হলেন না। আসলে আমরা তখন বেশ হাটাহাটির মুডে আছি।
মন্দিরের সামনে দিয়ে প্রবীর মিত্রের বাড়ির পিছনের গলি দিয়ে এগিয়ে চললাম। সোহেল ভাই অনেক পুরানো কোন সাধারণ বাড়ি দেখতে চাচ্ছেন। আমি কিছুদিন আগে একটা দেখেছিলাম যেটা মাত্র ভাঙ্গা শুরু করা হচ্ছে। ভাইকে নিয়ে চললাম সেদিকে।
সেই বাড়িটা পর্যন্ত গিয়ে দেখলাম যে সেখানে কোন বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। ভাঙ্গাচুরা শেষে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। আচ্ছা, জায়গাটা না প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রনাধীন! ইচ্ছা করলেই কি এখনকার কোন স্থাপনা ভাঙ্গা যায়!!
এগিয়ে চললাম আরো সামনের দিকে। সরু একটা গলি দিয়ে এসে উঠলাম ইসলামপুর রোডে।
ইসলামপুর রোড
মোঘল সম্রাটদের প্রতিনিধি হিসাবে ঢাকায় এসেছিলেন ইসলাম খা। তিনিই প্রথম ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেছিলেন। তার নামেই এই রাস্তার নামকরন করা হয়েছে ইসলামপুর রোড।
ইসলামপুর রোড এখন কাপড়ের দোকানে ভরপুর।এমনিতেই সরু রাস্তা, তাতে সারাদিনই যানবাহন গিজিগিজ করে। লাখ-লাখ মানুষ আর ঠেলাগাড়ি, সবমিলে রাস্তাটা প্রায় স্থবির। কিছুদূর যাবার পরেই কিছুটা দূর থেকে নবাব বাড়ি যাবার রাস্তাটা চোখে পরে, আর সেটা দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। নবাববাড়িকে ঘিরে একগাদা বড়বড় ট্রাক প্রায় হুমড়ি খেয়ে আছে। দেখলে মনেহয় বাংলা সিনেমার কোন নায়িকাকে একগাদা ভিলেন রেপ করার জন্য উল্লাসে টগবগ করছে।
সোহেল ভাইকে বললাম, চলেন আহসান মঞ্জিল দেখে আসি। কিন্তু তিনি একেবারেই রাজী হলেন না। নবাব বাড়ি যাবার পথটাই মন খারাপ করে দিয়েছে। আমরা আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর পরেই নবাব বাড়ি যাবার তোরণ। সুদৃশ্য তোরণটার হাল দেখলে রাগ হয়। সেটাকে যে কিভাবে দখল করা হয়েছে। আচ্ছা! এতো সুন্দর একটা ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ধ্বংস করতে কি কারো একফোটা মায়া লাগলোনা!!!
আমরা খুব দ্রুত এই স্থানটি ছেড়ে চলে গেলাম।
আরেকটু সামনেই হচ্ছে মাদার তেরেসার ভবন। শ্রদ্ধেয় মাদার তেরেসার চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের একটা শাখা এটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের যুদ্ধ শিশুদের অনেকের গন্তব্য ছিলো এটি।
হঠাত মনে হলো সোহেল ভাইকে বেগম পত্রিকার অফিসটা দেখানো হয়নি। ওটা পাটুয়াটুলিতে ছিলো। এখন দেখতে গেলে আবার এতো দূর ফিরে যেতে হবে। সোহেল ভাই বললেন যে ঠিক আছে, ওটা আরেকদিন দেখা যাবে।
এসে পৌছালাম বাবুবাজার ব্রীজে।
বাবুবাজার
এখনকার বিখ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যার নামে সেই জমিদার জগন্নাথ রায় বাবুর বাড়ি ছিলো এখানে। তিনি এখানে একটি বাজার বসিয়েছিলেন। জমিদারবাবুর বাজার থেকেই কালক্রমে সেটি বাবুবাজার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
২০০১ সালে ঢাকার সাথে কেরানীগঞ্জের যোগাযোগ সহজতর করার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এটির নাম এখন বাবুবাজার ব্রীজ। সারাদিনই যানবাহনের জটলা লেগে থাকে এই সেতুর উপর। সেতুটির নীচেই আছে একটা মাজার।
নদীর দিকে এগিয়ে চললাম। কিছুদুর পরেই আছে আমিরউদ্দিনের কবর ও মসজিদ।
আমিরউদ্দিনের কবর ও মসজিদ
১৮১৮ সালে জন্ম নেয়া আমিরউদ্দিন ঢাকার একজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি ছিলেন। শেষ জীবনে জমিদারী কিনলেও প্রথমে তিনি ইংরেজ সরকারের দারোগা ছিলেন এবং অর্থ উপার্জন করেছিলেন প্রচুর। সুদৃশ্য এক মসজিদ স্থাপন করেছিলেন তিনি বাবুবাজারে।
মৃত্যুর পর তাকে তার মসজিদের পাশেই সমাহিত করা হয়।
সুদৃশ্য মসজিদটি এমন বিশ্রিভাবে সংস্কার করা হয়েছে যে দেখতে ততোটা ভালো লাগে না। পাশেই টিনের চালা তৈরী করা হয়েছে, সেটা দেখতে খুবই দৃষ্টিকটু। এই টিনের চালাঘরটি বোধহয় মাদ্রাসা হিসাবে ব্যাবহার করা হবে।
বাবুবাজার থেকে গাবতলী পর্যন্ত নদীর ধার ঘেসে একটা সড়কপথ চলে গেছে। বাসে করে এই রাস্তা ধরে যেতে খুবই ভালো লাগে। সোহেলভাই আর আমি এই রাস্তা ধরে কিছুদূর হাটতে চাইলাম। কিন্তু এতো রোদ আর ধুলা যে আমরা খুবই বিরক্ত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে গেলাম।
অন্য পর্বগুলো
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৬