উত্তর ভারতের হিমালয় (পর্ব - ১, আধিক্য যশোর রোড)
সবগুলো পর্ব
রান্নার অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেস্ট ছিলো সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি। রান্না যে পৃথিবীর সবচাইতে বড় শিল্প আর সিদ্দীকা কবির যে সে শিল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় বড় মাপের শিল্পী তা এনটিভির এই প্রোগ্রামটা দেখলেই বোঝা যেত। (রন্ধনশিল্পী নিয়ে কাল্পনিক ভালোবাসার অতিরিক্ত অসাধারণ একটা লেখা আছে, আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছি তার লেখাটি পড়ে। যদিও আমার ব্যাক্তিগত মতামত হচ্ছে লেখাটি আরো অনেক বড় হওয়া উচিৎ ছিলো)। বাবুর্চি কথনঃ বাবুর্চি, রন্ধনশিল্পী এবং শেফ।
এনটিভিতে যখন রান্নার এই প্রোগ্রামটি সম্প্রচার হতো সে বয়সটাতে শারমিন লাকি আরো সুন্দর ছিলেন, তার উপস্থাপনা অনুষ্ঠানটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছিলো। একদিন সিদ্দিকা কবির আর শারমিন এই দুই মহারথী মিলে সৃষ্টি করেছিলেন লালমোহন নামের অসাধারণ এক মিষ্টি। লালমোহন প্রধানত অপ্রচলিত একটা নাম, আমরা একে মূলত কালোজাম হিসাবেই চিনি। এর আরেকটি নাম হচ্ছে গুলাব জামুন। আমি যদিও কোন রান্নার অনুষ্ঠানের প্রতি একেবারেই আগ্রহী ছিলাম না, কিন্তু আমার বড় আপু আমাকে এটা দেখতে বাধ্য করতো। কারণ অনুষ্ঠানে রান্নার যে উপকরণগুলো প্রয়োজন সেগুলো মনে রাখার দায়িত্ব ছিলো আমার। তবে আমি এই লালমোহন তৈরীর রহস্য পর্বটা প্রচন্ড মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। কতো সহজে, কতো কম উপকরণ দিয়ে, আর কি অবলীলায় এটি তৈরী করা যায়। শহরে ছানা অথবা মাওয়া সহজে পাওয়া যায় না বলে দর্শকদের সুবিধার জন্য সিদ্দিকা কবির এবং শারমীন ময়দা ব্যাবহার করেছিলেন। যখন ময়দাগুলোকে মিষ্টির আকৃতিতে ভেজে চিনির রসে ডুবানো হয়েছিলো তখন আমার মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি এর সুঘ্রাণ পাচ্ছি। আমার এখনো জ্বিভে পানি চলে আসে এই অসাধারণ মিষ্টিগুলোর কথা ভাবলে।
বাঙ্গালির সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টির নাম বোধহয় রসোগোল্লা। রসগোল্লা খেতে ভালোবাসে না এমন কোন মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি। ছোট ছোট সাদা গরম রসগোল্লা গরম ঝোল থেকে দু’আঙ্গুলে উঠিয়ে মুখের ভিতর ঢুকিয়ে গভীর আবেশে চোখ বুজে ফেলা আর তারপর মুখের মধ্যে নরম গরম এবং কোমল একটা অনুভূতি!!! ঠোঁট বেয়ে তখনো দুফোটা গরম রস গড়িয়ে পড়ছে!! উফ!!! ভাবলেই শরীর ঝিমঝিম করে উঠে!!
রসগোল্লার ইতিহাস কতোদিনের তা কে জানে। তবে এই রসোগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে বেশ ধুন্ধুমার কান্ড বেঁধে গেছে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য বলে যে তারাই নাকি রসগোল্লার আবিষ্কর্তা। পুরীর জগন্নাথ দেবতা তার স্ত্রী লক্ষী দেবীর মানভঞ্জন করাতে তাকে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন। তাদের সম্মানার্থে জগন্নাথের মন্দিরে রথযাত্রার সময় রসগোল্লা ভোগ দেয়া হয়। তবে উড়িষ্যার রসগোল্লার স্বত্ব পাবার দাবী মোটামুটি অগ্রাহ্য করা যায়। কারণ আমরা যে রসগোল্লা খেয়ে থাকি তা ছানার তৈরী, আর উড়িষ্যার মিষ্টি তৈরী হয় ক্ষীর থেকে।
১৮৬৮ সালে কলকাতার নবীন চন্দ্র দাস প্রথম রসগোল্লার আবিষ্কার করেন এরকম দাবী নিয়ে মাঠে নেমেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নবীন চন্দ্র দাস নাকি প্রথম ছানার মন্ডকে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরী করেছিলেন রসগোল্লা। তার ছেলে কে সি দাস কৌটজাত করে বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর মাধ্যমে রসগোল্লাকে বিশ্বজনীন করে তোলেন।
পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার রসগোল্লা নিয়ে বিতর্ক শেষ পর্যন্ত আইনি লড়ায়ে গড়িয়েছে। উড়িষ্যা ৩০শে জুলাই রসগোল্লা দিবস হিসাবে পালন করা শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আপিল করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয়ে ৩টি কমিটি গঠন করেছে। প্রথম কমিটি রসগোল্লার ইতিহাস নিয়ে গবেষনা করবে, ২য় কমিটি উড়িষ্যার রসগোল্লার দাবী নিয়ে অনুসন্ধান করবে এবং ৩য় কমিটি পশ্চীমবঙ্গের রসগোল্লার দাবী নিয়ে অনুসন্ধান করবে।
তবে কলকাতা ও ভুবনেশ্বরের রসগোল্লা নিয়ে টানাটানির ভিড়ে আরেকজন দাবীদার হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি শেষাক্ত এই মতবাদের সমর্থক। বিশেষজ্ঞদের মতে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চল। বরিশালের যে অঞ্চলটাতে পর্তুগীজদের আধিক্য ছিলো সেখানকার বাঙালী ময়রাগণ ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে গোলাকার একধরনের মিষ্টি তৈরী শুরু করে। এই নূতন ধরনের মিষ্টি তৈরীতে পর্তুগীজ জলদস্যু বাহিনীর হাত ছিলো।
একটা সময় এই ময়রাগণের বংশধরেরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। যাদের অধিকাংশই ঘাটি গাড়ে তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক শহরগুলির একটি, কলকাতায়। বিলাসবহুল নগরীর একটি প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে খাদ্য।
খাদ্য হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিল্পের একটি যার প্রাধানতম শাখা হচ্ছে মিষ্টি শিল্প। মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে পৃথিবীতে যে পরিমান এক্সপেরিমেন্ট চলে তা বুঝি আর অন্য কোন খাবার নিয়ে হয় না। আর শিল্প তো সবসময়ই পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হবার নিয়ম মেনে চলে। শিল্পের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের অনুষঙ্গে সংযোজন ও বিয়োজনের এই খেলায় সৃষ্টি হয়ে উঠেছে রসনাবিলাসের অপ্সরীসম এই মিষ্টান্ন, রসগোল্লা।
বাঙালীকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে পর্তুগীজরা। এই জলদস্যুরা বাঙ্গালিদেরকে এতো বেশি অত্যাচার করেছে অথচ বাঙ্গালীরা তা একেবারেই মনে রাখেনি। অত্যাচারী হিসাবেও মনে রাখেনি অথবা পরিবর্তনকারী হিসাবেও মনে রাখেনি। পর্তুগিজরাই তো আমাদেরকে আলু আর মরিচ খাওয়া শিখিয়েছে। এই দুটো জিনিস ছাড়া তো আমরা এখন আমাদের একটা দিনও কল্পনা করতে পারিনা। ভেবে দেখুন তো আলুর তরকারি ছাড়া আমরা ভাত খাচ্ছি, আর এই তরকারিটা রান্না হয়েছে গোলমরিচ দিয়ে!! এখন তো অনেকে গোলমরিচ জিনিসটা কি তাই জানে না।
অন্যান্য আরো নূতন খাবারের সাথে পর্তুগীজরা আমাদের শিখিয়েছে বিভিন্ন ধরনের আচার আর দুধের ছানা তৈরীর প্রক্রিয়া। জলদস্যুরা যখন ভেতো বাঙ্গালীকে নষ্ট দুধ খাওয়া শেখালো তখন থেকে বাঙ্গালিরা ভালো দুধ নষ্ট করে খাওয়া শুরু করলো।
বাঙ্গালীর মিষ্টি তৈরীর ইতিহাসকে আমরা মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করতে পারি, দুধের ছানা তৈরীর আগে ও পরে। দুধের ছানা বাংলার মিষ্টি তথা খাদ্য পরিবর্তনে অসাধারণ এক বিপ্লব এনে দিয়েছিলো। দুধ নষ্ট হয়ে গেলে যে সেটা থেকে ছানা তৈরী করা যায়, এটা বাঙ্গালীদেরকে শিখিয়েছিলো পর্তুগীজরা। তার আগ পর্যন্ত দুধ নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দেবার রেওয়াজ ছিলো। তবে যেদিন থেকে বাঙ্গালীরা দুধের ছানার ব্যাবহার শিখলো সেদিন থেকে তারা পর্তুগীজকে টেক্কা দিয়ে গেল। দুই হাজার বছরের পুরানো মতিচূর লাড্ডু থেকে লাফ দিয়ে বাঙালী পৌছে গেল ভুবনমোহিনী রসগোল্লাতে। শুধু কি রসগোল্লা!! রসমালাই, চমচম, কালোজাম, গোপালভোগ, রাজভোগ, কমলাভোগ, ছানার জিলাপী, সন্দেশ আরো কত্তো কি! তবে সবগুলোকে ছাপিয়ে রসগোল্লার আবেদনই বাঙ্গালীর কাছে চিরন্তন। ভাবগতিক দেখে কে বলবে, যে রসগোল্লার বয়স দুইশো বছরের কম! সেটা বরঞ্চ প্রাগৈতিহাসিক লাড্ডুর থেকে মানুষের কাছে বেশি আপন।
লেখাটার এই পর্যন্ত কাল্পনিক ভালোবাসা ভাইকে উৎসর্গ করা হলো।
রম্য এবং ভ্রমণ কাহিনী লেখক শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত “রসগোল্লা’’ গল্পটি দশমশ্রেণিতে আমাদের অবশ্য পাঠ্য ছিলো। আমি নিশ্চিত যে এই গল্পটি দশম শ্রেণির স্টুডেন্টদের কাছে সবচাইতে জনপ্রিয়। অসাধারণ এই ছোটগল্পটিতে রসগোল্লার রসকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা বর্ণনাতীত। আমি যতোবার গল্পটা পড়েছি ততোবার আবার জিহ্বায় পানি জমে গেছে। গল্পটিতে রসগোল্লার রস আস্বাদন করে বিশ্বজনীনতার যেরূপ অভিব্যাক্তি হয়েছিলো তা তিনি অসাধারণ করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন,
“ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’
‘জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’
ইতালিয়ানরা, ব্রাভো!’
স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো,দেলিচজো।’
আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!"
তবে গল্পটা শুধুমাত্র রসগোল্লা নিয়েই ছিলো না। বরঞ্চ কাস্টমস নিয়ে বিড়ম্বনার কথাও ছিলো। “রসগোল্লা’’ গল্পটি থেকে আরো খানিকটা,
“চুঙ্গিঘর কথাটা বাঙলা ভাষাতে কখনও বেশি চালু ছিল না বলে আজকের দিনে অধিকাংশ বাঙালী যদি সেটা ভুলে গিয়ে থাকে তবে তাই নিয়ে মর্মাহত হবার কোনো কারণ নেই। ইংরেজিতে একে বলে ‘কাস্টম্ হাউস’, ফরাসিতে ‘দুয়ান, জার্মানে ৎস্ল্-আম্ট্, ফার্সিতে ‘গুমরুক্’ ইত্যাদি। এতগুলো ভাষাতে যে এই লক্ষ্মীছাড়া প্রতিষ্ঠানটার প্রতিশব্দ দিলুম, তার কারণ আজকের দিনে আমার ইয়ার, পাড়ার পাঁচু, ভূতো সবাই সরকারি, নিম-সরকারি, মিন-সরকারি পয়সায় নিত্যনিত্যি কাইরো-কান্দাহার প্যারিস-ভেনিস সর্বত্র নানবিধ কনফারেন্স করতে যায় বলে আর পাকিস্তান হিন্দুস্থান গমনাগমন ত আছেই।“
২০১৬ সালের ১লা অক্টোবর ইন্ডিয়ান সময় যখন সকাল ৯ টা তখন আমি ইন্ডিয়ান চুঙ্গিঘর তথা কাস্টমস পার হচ্ছিলাম। একজন কাস্টমস আমাকে এককোনে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট ছো মেরে তুলে নিয়ে গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল। সৈয়দ মুজতবা আলীর বন্ধু ঝান্ডুদা ইতালিয়ান চুঙ্গিওয়ালা দ্বারা বিড়ম্বিত হয়েছিলেন। আর ইন্ডিয়ান চুঙ্গিওয়ালা আমার চকচকে ৫০০ টাকার একটা নোট, যার অভিমূখে বঙ্গবন্ধুর জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি সেইখানা ডাকাতি করলো। ক্ষোভে, দুখে, হতাশায়, গ্লানিতে চরমভাবে অপমানিত বোধ করলাম আমি।
কাস্টমস থেকে বের হয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে চললাম। একজায়গা থেকে ইমিগ্রেশন ফর্ম সংগ্রহ করে সেটি পূরন করলাম। ফর্মের দুটো জায়গা বুঝতে পারিনি বিধায় সেটা খালি রেখে দিলাম। আসলে প্রতিবারই আমার ইমিগ্রেশন ফর্ম দালাল পূরন করে দেয়, কিন্তু এবার দালালের সাহায্য না নিয়ে আমিই সেটা পূরন করেছি। বাঁশের বেড়ার একপাশে দেখি দালালেরা ১০/২০ টাকার বিনিময়ে ফর্ম পূরন করে দিচ্ছে। আমি অবশ্য সেদিকে আর গেলাম না। সোজা অফিসে ঢুকে গেলাম।
ইমিগ্রেশন অফিস দেখি পুরোই খালি। অনেকগুলো অফিসার নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। একটা খালি কাউন্টারে এগিয়ে গিয়ে ফর্ম জমা দিলাম। ফরমের সবগুলো অংশ পূরন করা হয়নি দেখে অফিসারটি একটু হাসলো। তারপর নিজেই সেই অংশগুলো পূরন করে দিলো। ছবি তোলা, পাসপোর্টে সীলা মারা সবমিলে এক মিনিটও লাগিলো না। ইমিগ্রেশন অফিসারটির ছোট্ট হাঁসিটা ততোক্ষণে আমার মন অনেকটাই ভালো করে দিয়েছে।
কিন্তু মাঝে মাঝে আমার বেশ ইগো প্রব্লেম কাজ করে। এই মুহূর্তে আমার প্রচন্ড পরিমানে রোখ চেপে গেছে। এটা সামলানো দরকার। বদমাশ কাস্টমসটা খামাখা আমার ৫০০ টাকা ঝেড়ে দেবে কেন!! এটার একটা বিহিত হওয়া দরকার। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বের হয়ে অফিসের পিছন দিক দিয়ে অনেক ঘুরে সরু একটা গলি দিয়ে আবার এসে উপস্থিত হলাম কাস্টমসে। খুঁজে খুঁজে বের করলাম সেই বদমাইশ চুঙ্গিওয়ালাকে। আমাকে দেখে সে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। তারপর সে আমাকে আবারও নির্জন একটা ঘরের একপাশের কোনে নিয়ে গেল।
এই বদমাইশটার সাথে আমি হাতাহাতি ছাড়া সবকিছু করেছি। হুমকি-ধামকি থেকে অনুনয়-বিনয় পর্যন্ত সবকিছু। সে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছিলো, আমিও তাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছি। ব্যাটা অবাঙ্গালী ছিলো, সে যেন বুঝতে না পারে এরকম দুয়েকটা বাংলা গালাগালিও দিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা একটা নেগোসিয়েশনে এসেছিলাম। আমি অনেকখানি নরম হতে বাধ্য হয়েছিলাম, আর সে অল্পখানি নরম হয়েছিলো। ৫০০ টাকা থেকে সে আমাকে ১০০ টাকা ফেরত দিতে রাজী হয়েছিলো। যাক বাবা!! কুমিরের মুখ থেকে মুরগীর একটা মরা ঠ্যাং উদ্ধার করাও বা কম কি!!
সমস্যা হচ্ছে তার কাছে একশো টাকা নেই। আমার কাছেও ভাঙ্গতি নেই। আমি আবার সরু গলি দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে আসলাম। এখানে ডলার, রুপি, টাকা ভাঙানোর অনেকগুলো দোকান আছে। পরিচিত একটা দোকান থেকে চারশো টাকা ধার নিলাম। তারপর আবার পিছনের সরু গলি দিয়ে কাস্টমস অফিসে ফেরত আসলাম।
বদমাইশ ব্যাটা দেখি হাসিমুখে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সেও ভাঙ্গতি জোগাড় করতে পেরেছে। তার হাতে ১০০ টাকার চকচকে একটা নোট। আমি নিশ্চিত যে ব্যাটা এই টাকাটা কোন বাংলাদেশী যাত্রীর কাছ থেকে ঝেড়েছে। তার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে দাঁত কেলিয়ে আমিও একটা হাসি দিলাম। তারপর পিছন ফিরে সমান তালে তার চৌদ্দ গুষ্টিকে গালাগালি দিতে দিতে আবার পিছনের গলিটা দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসের সামনের দিকে চললাম। ভাগ্যিস ব্যাটা টের পায়নি, টের পেলে আমার যে কি হতো তা আল্লাহই জানে!! টাকার ক্যাচালের যন্ত্রনায় ততোক্ষনে প্রায় ৪৫ মিনিট পার হয়ে গেছে।
ইমিগ্রেশন অফিসের বাইরের দরজায় দেখি আমার বাংলাদেশী সাহায্যকারীটি দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দেরী দেখে তিনি কিছুটা চিন্তিত। কাস্টমসের কথা শুনে তিনি খানিকক্ষন হাসলেন। তারপর কে পি ঘোস থেকে টাকা ভাঙ্গিয়ে দিলেন। এরা সবসময়ই আমাকে টাকার কম রেট দেয়। কিন্তু পরিচিত বলে কখনো কিছু বলতেও পারি না। আসলে বর্ডারে জাল রুপির ব্যাপার থাকতে পারে, এই আশঙ্কায় আমার বাবা অন্য কোথা থেকে টাকা ভাঙ্গাতে দিতে চান না। তবে এবার আমি বুদ্ধি করে এদের কাছ থেকে সব টাকা ভাঙ্গাইনি। আমার সাহায্যকারী তখনো আমার পিছু ছাড়েনি। তার ফোন থেকে আমার বাবার সাথে ক্ষানিকক্ষণ কথা বললাম, জানালাম যে আমি ভালো আছি কোন সমস্যা নাই। তারপর পাসপোর্ট ফটোকপি করবো আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, এই বাহানা দিয়ে সাহায্যকারীটিকে ভাগালাম।
যেখানে পাসপোর্ট ফটোকপি করেতে গিয়েছি তার পাশে দেখি টাকা ভাঙানোর জন্য ডাকাডাকি করছে। আমি প্রথমে ফটোকপি করলাম। ইন্ডিয়াতে ফটোকপিকে জেরক্স বলে। বিল আসলো মাত্র ৮ রুপি। অথচ একবার বাংলাদেশ অংশের বেনাপোলে ৫ পাতা ফটোকপি করার জন্য দোকানদার আমার কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়েছিলো। ফটোকপি শেষে বাকী টাকাগুলো ভাঙ্গাতে চললাম।
যে টাকা ভাঙানোর কথা বলেছিলো সে আমাকে একটা গলির ভিতর তার সাথে যেতে বললো। আমি প্রথমে গলির মধ্যে ঢুকতে রাজী হচ্ছিলাম না। কিন্তু সেখানে বেশকয়েকজন লোককে দেখে শেষ পর্যন্ত ঢুকলাম। বর্ডারের এরকম গলিতে একা ঢোকা একেবারেই ঠিক না। যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে। এরা প্যাচে ফেলে যাত্রীদের কাছ থেকে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। বিদেশ বিভুয়ে এর চাইতে বড় বিপদ আর কি হতে পারে।
তবে গলির খুব বেশি ভিতরে ঢুকতে হলো না। ওখানের একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানদার আমাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহন করলো। কতো টাকা ভাঙ্গাতে চাই সেটা শুনে নিলো। তারপর সেটা ক্যালকুলেটারে হিসাব করে আমার সামনে শো করলো, মুখে কিছু বললো না। আসলে পাশাপাশি এতো দোকান যে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রতোযোগিতা চলে আসে। যদি সে মুখে কিছু বলে তাহলে পাশের দোকানদার সেটা শুনে ফেলতে পারে, এজন্যই হয়তো ক্যালকুলেটরে শো করে।
যাই হোক, রুপির এম্যাউন্ট যেটা পেলাম সেটা কে পি ঘোস থেকে অনেক বেশি। আমার টাকাগুলো ভাঙ্গিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমি সন্দেহ প্রকাশ করলাম যে তাদের রুপিগুলো জাল কিনা। কারণ আমি শুনেছি যে বর্ডার থেকে বিভিন্ন দোকান অনেক সময়ই জাল রুপি গছিয়ে দেয়। ইন্ডিয়াতে জাল রুপি সহ ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি। দোকানদার তখন হেঁসে আমাকে জাল রুপি চেনার উপায়গুলো
বোঝালো। আমি তাকে বললাম যে আপনি তো ভুজুং ভাজং যা কিছু আমাকে বোঝাতে পারেন। শুনে সে জোরে হেঁসে উঠলো। আসলে অনেক সময় অনেক কিছু ইচ্ছা না থাকলেও জোর করে বিশ্বাস করতে হয়। টাকা ভাঙ্গানো শেষে আমি যেন সেগুলো খুব সাবধানে রাখি সে ব্যাপারে দোকানদার বারবার আমাকে সাবধান করে দিলো, কারণ প্রায়ই নাকি লোকাল ট্রেনে পকেটমার হয়। একখানা কার্ড দিলো যেন পরেও আমি সেখানে আবার আসতে পারি।
টাকা ভাঙ্গানো শেষে অটোতে উঠলাম। এই অটোগুলো বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করে। ২০ মিনিট মতো সময় লাগে। ভাড়া আগে ছিলো ২৫ রুপি, এবার দেখি ৩০ রুপি করে চাচ্ছে। দরদাম না করে উঠে পড়লাম, ৫ রুপিরই তো ব্যাপার।
আমি বসা মাত্রই অটো চলা শুরু করলো। যশোর রোডের এপারের অংশ। এখানকার গাছগুলো আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি মোটামোটা। এইপাশের রাস্তা চওড়া করা হয়েছে গাছগুলোকে সংরক্ষন করে। বিশাল মোটা গাছগুলোকে মাঝখানে রেখে দুপাশ দিয়ে চার লেনের রাস্তা। ডালপালার কারণে কিছুটা পথ অন্ধকার অন্ধকার, মনে হয় যেন সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
বনগাঁ শহরের বাড়িগুলোর সাথে যশোরের একটু পুরানো বাড়িগুলোর দারুন মিল। মনে হয় যেন যশোরের কেশবলাল রোড দিয়ে যাচ্ছি। তবে এখানকার মেয়েদের দেখলে খুবই ভালো লাগে। তারা খুব স্বাধীনভাবে সাইকেল বা স্কুটি চালিয়ে চলাফেরা করে। অন্তত বাংলাদেশের মেয়েদের মতো তাদের মধ্যে ন্যাকামো ব্যাপারটা নেই।
পৌছে গেলাম বনগাঁ স্টেশনে। অটো থেকে নেমে কাস্টমস ব্যাটাকে আবারো কতোগুলো গালি দিলাম মনে মনে। ইন্ডিয়ান সময় অনুযায়ী এখন বাজে সকাল ১০ টা ২০ মিনিট। আমি সবসময়ই বনগাঁ থেকে ৯’৫০ এর মাঝেরহাট লোকাল ধরি। এই ট্রেনটা একেবারে বিবাদীবাগ পর্যন্ত যায়। বদমাইশটার সাথে ক্যাচাল না বাধলে আমি সহজেই সেই ট্রেনটা ধরতে পারতাম। এখন আমাকে এই ভারী ব্যাগটা টেনে কয়েকবার ট্রেন আর বাস বদলে বদলে বিবাদীবাগ যেতে হবে। অসহ্য!
টিকিটের জন্য বিরাট লাইন। লাইনের পিছনে দাড়ালাম, কিন্তু একেবারেই সময় লাগলো না। এই ব্যাপারগুলোতে অটোম্যাটিকলি কম্পেয়ার চলে আসে। বাংলাদেশে কোন ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য কতোক্ষন করে লাইনে দাঁড়াতে হয়, তারপরেও লাইন পার হলে কাউন্টারে গেলে বলে টাকা ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসেন। অথচ এখানে খুব দ্রুত টিকিট দিয়ে দিতে পারে, খুচরা নিয়েও কোন সমস্যা করে না। এখানকার টিকিট বিক্রেতার অধিকাংশই দেখি নারী। আমাদের দেশেও রেলে এখন নারী এমপ্লয়ী দেখা যাচ্ছে, যদিও সংখ্যায় তা বেশ কম।
দমদম পর্যন্ত টিকিট কাটলাম। ৭০ কিলোমিটারের ভাড়া ১৫ রুপি। সময় লাগে ট্রেনভেদে দেড় ঘণ্টা থেকে পৌনে দু ঘণ্টা। ১ ও ২ দুটো প্ল্যাটফর্মেই ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিলো। ১ ও ২ নম্বর থেকে যে ট্রেনগুলো ছাড়ে সেগুলো সাধারণত রানাঘাটে যায়। আর ৩ নম্বরেরটা কলকাতার দিকে। তবে শুনলাম দুনম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনটা নাকি শিয়ালদা যাবে। উঠে পড়লাম সেটাতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৫৫