রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শর্মিলা ঠাকুরের সম্পর্কটা বেশ প্যাচানো। রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথের নাতনী লতিকা ঠাকুর, এই লতিকা ঠাকুরের নাতনী হচ্ছেন অসাধারণ সুন্দরী শর্মিলা ঠাকুর। ৭০ বছর বয়সের পতৌদি নবাবের এই বেগমকে দেখলে এখনো অনেকের চিত্ত চাঞ্চল্য হয়। ইমরান ভাইয়ের সাথে আমার যখন পরিচয় হলো দেখলাম যে তিনি এইরকম প্যাচানো ভাবে পূর্ব পরিচিত। ৫ বছর আগে বান্দরবানের কেওক্রাডাং, তাজিংডং যে গাইডের সাথে গিয়েছিলাম তার নাম হচ্ছে নূর ইসলাম ভাই। ইমরান হচ্ছে নূর ইসলামের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম পক্ষের স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বড় ছেলে। বাপরে!! থাক এই সম্পর্ক অনুসন্ধান। আমরা বরঞ্চ অন্য কিছু অনুসন্ধান করি।
চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম মানচিত্রের আমন্ত্রনে। মানচিত্র হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন ভ্রমণ বিষয়ক ম্যাগাজিন। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ সজল ভাই এটার একজন কর্ণধার। এই প্রথমবার আমি সজলভাইকে সামনাসামনি দেখলাম, তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা আরো বেড়ে গেছে। তবে মুগ্ধতা ছাপিয়ে গেছে সূর্য ভাই আর হাসান ভাইয়ের সাথে পরিচিত হতে পেরে। আমি এই তিনজনকে দেখে প্রচন্ড পরিমানে হিংসিত। (আমি এই তিনজন মানুষের সাথে বান্দরবানের গহীনে যেতে খুব বেশী পরিমানে আগ্রহী)। মানচিত্রের এই তিনজন মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা মোট ২৮ জন চমৎকার আতিথিয়েতায় অসাধারণ একটা রাত কাটিয়েছি। রাতে বাসের ছাদে জার্নি, সারা রাত তাবুতে ক্যাম্প করে থাকা, ক্যাম্প ফায়ার, বারবিকিউ, গান, হুল্লোড় আর আর অনেক কিছু।
মানচিত্রের তাবু
রাতের ক্যাম্প ফায়ার
অসাধারণ এক রাতের পর আমরা গেলাম বুড়বুড়ির ছড়া ট্রেইল করতে। সূর্য ভাইয়ের লবন তৈরির কারখানা দেখে, দুবার টেম্পুতে চেপে, প্রায় ঘণ্টা খানেক পাহাড়ি একটি ছড়া আর জঙ্গল ট্রেইল করে আমরা যেখানে পৌছালাম সেটা বোধহয় একটা প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র।
ট্রেইলটা এইরকম অসাধারণ
ঝিরিপথে
পাহাড় থেকে এইভাবে লেবু আসে বিক্রির জন্য
যাত্রাপথে ছোট্ট এক পাহাড়ি ঝরনা
এখানে কিছু অংশ জুড়ে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। বৃষ্টির সময়ও নাকি এই আগুন নেভে না। একপাশে পাহাড়ী ছড়া, চারপাশে উঁচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গল আর মাঝখানের কিছু জায়গা জুড়ে বিক্ষিপ্ত কিছু জায়গা জুড়ে ছোট ছোট অগ্নিকুন্ড। অস্থির একটা পরিবেশ।
ছোটছোট অগ্নিকুন্ড
এখানে বোধহয় অনেকেই আসে, এই আগুনে রান্না-বান্না করে খায়।
মানচিত্র আমাদেরকে পরিবেশ-বান্ধব পর্যটক হতে শিখিয়েছে। আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা তো দূরে থাকুক, যারা সিগারেট খেয়েছে তারা পর্যন্ত পকেটে করে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেরত নিয়ে এসেছে।
মানচিত্র
কি কথা থেকে কি কথায় চলে যাই!! শিরোনাম সমুদ্র নিয়ে আর আমি এসে পড়েছি আগুনে। যাই হোক, অসাধারণ এই ক্যাম্পিং আর ট্রেইলের পরে আরো একটা দিন হাতে সময় ছিলো। কিন্তু সমুদ্রের এতো কাছে এসে সমুদ্র না দেখলে বোধহয় পাপ হবে। রাত ১১টার সময় আমি পৌছালাম পতেঙ্গা সৈকতে।
সত্যি কথা বলতে কি পাহাড় আমাকে যেভাবে টানে সমুদ্রের প্রতি সেরকমভাবে জোরালো আকর্ষণ আমি কখনোই অনুভব করি না। আর সৈকত হিসাবে পতেঙ্গা বোধহয় একটু নিম্নমুখী। সিমেন্টের ব্লকের উপর বিরস মুখে বসে আছি, আর ঠিক এইসময়েই ইমরান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হলো। এই মানুষটা নাকি বিবাহিত, আমি সেটা শুনে একেবারেই বিশ্বাস করিনাই। আসলে তাকে দেখলে ক্লাস নাইন-টেনের স্টুডেন্ট মনে হয়। তবে আরো হতভম্ব হয়ে গেলাম যখন শুনি যে তার নাকি দেড় বছরের একটা বাচ্চাও আছে। ছোটখাটো এই মানুষটাই পরদিন আমাকে অসাধারণ এক সৈকতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সকাল বেলা প্রথমে ইজিবাইকে করে আসতে হলো ১৫ নম্বর ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলারে করে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে ওপারে সার কারখানার ঘাট থেকে উঠলাম সিএনজিতে। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা চলার মাঝে মোট তিনবার সিএনজি পরিবর্তন করতে হলো। শেষ পর্যন্ত যেখানে পৌছালাম সেটাকে বোধহয় বশিরমিয়ার ঘাট বা এরকম কিছু বলে। এইবার নাকি রিক্সায় উঠতে হবে। আমি অবশ্য রিক্সায় উঠতে রাজী হলাম না, এই পথটুকু হাটতেই ভালো লাগবে।
ট্রলারে করে প্রমত্তা কর্ণফুলী পার হবার সময়
সিএনজিতে যাবার সময় আশেপাশের দৃশ্য, একপাশে ছোট ছোট টিলা
কিছুদিন আগেই ধান কাঁটা হয়েছে। মাঠগুলোতে লালচে হলুদ একটা আভা।
একটা সুন্দর খাল পার হতে হয়
মাঠের বুক চিরে পিচঢালা রাস্তা এগিয়ে চলেছে সমুদ্রের পানে। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই পৌছে গেলাম।
অদ্ভুত এক অনুভূতি গ্রাস করলো আমাকে। এই সৈকতটার নাকি কোন নাম নেই। একদম নীরব একটা সৈকত, আমিই একমাত্র অতিথি। একপাশ ধরে ঝাউ গাছের বন। দূরে কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে জাল ঠেলে মাছ ধরছে। আর আরো অনেক দূরে দুজন কাকড়া শিকার করছে। বক আর বিভিন্ন পাখি ওড়াউড়ি করছে। বিভিন্ন গাছের শিকড় উপড়ে আছে সৈকতজুড়ে। ভাটার কারনে সমুদ্র অনেক দূরে। আমার মনে হলো পুরো পরিবেশটা আমাকে খুবই আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানাচ্ছে, কারণ আমি তাদের একমাত্র অতিথি।
কিছুক্ষনের জন্য আমি পুরো আস্তো এই সৈকতটার মালিক হয়ে গেলাম।
অনেক দূরে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে জাল ঠেলে ছোট ছোট মাছ ধরছে
দূরে কতগুলো পাখির ওড়াওড়ি
কোন এক সময় ঘূর্ণিঝড়ের ফলে এইরকমভাবে গাছ উপড়ে গেছে
সমুদ্র মন্থনের প্রস্তুতি
ছোট-খাটো সহজ সরল মানুষ ইমরান ভাই
লাল কাকড়ার সম্রাজ্য
কাকড়াগুলোকে ধরার আপ্রান চেষ্টা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে যে কাছে যেতেই এগুলো ছোট ছোট গর্তে লুকিয়ে পড়ে
দুটো কাকড়া গর্ত থেকে উঁকি মেরে আমাকে দেখছে
সুদূরের পাখিরা
দূরে একটা বাচ্চা মেয়ে মাছ ধরছে
সৈকতের একটা জীবিত গাছ
উল্টে পড়া গাছের রাজ্যে
কিছুক্ষনের জন্য আমিই ছিলাম এই সৈকতের মহারাজ
ফিরে চলা
বিদায় প্রিয় সৈকত
সমুদ্র মন্থন শেষে রওনা দিলাম ইমরান ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে। আমাদের পায়ে তখন প্রায় হাটু সমান কাদা। এইভাবেই হেঁটে চলেছি। অসাধারণ লাগছে।
গ্রামের মেঠো পথ
মেঠো পথের দুধার দিয়ে ক্ষেত, কৃষকরা সেখানে পানি দিচ্ছে।একটা শসার ক্ষেতে নেমে গেলাম। আমি এই প্রথম শষার গাছ দেখলাম, আমি প্রথম ভেবেছিলাম যে এগুলো বুঝি কুমড়ো গাছ।
শসা ক্ষেত
ক্ষেতে শসা ও কৃষক
নিজ হাতে একটা শসা ছিঁড়লাম। ক্ষেতের মালিক নিজেও কয়েকটা শসা তুলে দিলেন। তারপর আইলের কাদামাখা পানি দিয়ে শসাগুলো ধুয়ে সেগুলো খেতে খেতে আবার রওনা দিলাম। সদ্য ক্ষেত থেকে ছেঁড়া শসার স্বাদই আলাদা।
নিজ হাতে ক্ষেত থেকে তুলে আনা শসা খাচ্ছি
পথে দেখি একটা বরযাত্রীবাহি গাড়ি। চান্দের গাড়িতে চেপেও যে বিয়ে করতে যাওয়া যায় তা এই প্রথম দেখলাম।
যখন ইমরান ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে পৌছালাম তখন ইমরান ভাইয়ের কিশোরী বউ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ছুটে এলো। আমাকে দেখে সে কিছুটা লজ্জিত। বাচ্চাটা ঝাপিয়ে তার বাবার কোলে উঠে পড়লো। আর ইমরান ভাইয়ের শাশুড়ি আমাকে দেখে পিঠা বানাতে বসলো।
পিচ্চিটা তার বাবাকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দিত
ইমরান ভাই তার বাচ্চাকে কিছুক্ষন আদর করে নামিয়ে দিলেন। তারপর দৌড়ে একটা নারকেল গাছে উঠে পড়লেন। একগাদা ডাব পেড়ে তার বৌয়ের কাছে দিলেন সেগুলো কেটে আমাকে দেবার জন্য। আর তারপর আমরা পুকুরে গেলাম পায়ের কাদা ধোয়ার জন্য।
দৌড়ে নারকেল গাছে উঠে পড়া ইমরান ভাই
বাড়িতে ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা
ছাগলের বাচ্চা দুধ খাচ্ছে
হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি খাবার-দাবারের এক এলাহী কান্ড। দরিদ্র এই পরিবারটি আমার জন্য তাদের আতিথিয়েতরা সব ডালি নিয়ে বসেছে। আমি খুবই লজ্জ্বা পেলাম। বেচারাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত নেই। অথচ তাদের সবটুকু উজাড় করে তারা আমাকে গ্রহন করেছে। আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের বাইরে এইরকম উষ্ণতা আর কোথাও পাওয়া সম্ভব না।
যখন চলে আসছি তখন ইমরান ভাইয়ের শাশুড়ি আমাকে কি কি যেন বললেন। কিন্তু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আমি একেবারেই বুঝিনা, এজন্য ইমরান ভাইয়ের বউ আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তারা আসলে অনুনয় করছেন যে আমি যেন অন্তত একটা রাত এখানে থেকে যাই। আমি সত্যিই এই পরিবারের ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞ।
ফেরত পথে ইমরান ভাই আমাকে বিভিন্ন রকম গল্প করলেন। তিনি আগে বান্দরবানের গাইড ছিলেন। কিন্তু এখন চট্টগ্রামে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে ছোট্ট একটা চাকরি করেন তিনি। অথচ প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা অপরিসীম। এখন তিনি এই নামহীন সৈকতটা নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। তিনি চান যে এই সৈকতটাতে সবাই বেড়াতে আসুক।
এই সৈকতটাতে তাবু টাঙ্গিয়ে থাকা নিশ্চয় অসম্ভব দারুন অভিজ্ঞতা হবে। তবে লজ্জ্বার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সব জায়গা আমরা এখনো নিরাপদ হিসাবে গড়ে তুলতে পারিনি। এক্ষেত্রে সমুদ্রের খুব কাছেই ইমরান ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকা যেতে পারে। গ্রামীন পরিবেশে একটা অসাধারণ পরিবারের সাথে সময় কাটানো নিশ্চয় অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা হবে। বিশেষ করে জায়গাটা যেখানে এইরকম অসাধারণ।
ইমরান ভাই আমাকে আরো কয়েকটি বিশেষ জায়গার লোভ ধরিয়ে রেখেছেন, সেগুলো নাহয় গোপন থাকুক। অন্য কেউ আগ্রহী থাকলে তিনি তাদেরকেও সেখানে নিয়ে যেতে আগ্রহী।
ইমরান ভাই, মোবাইল নম্বর 01951076404
ছবিগুলোতে আমি বেশিবার এসে গেছি, সরি। আসলে দোষটা আমার না। পুরো সময় জুড়ে ক্যামেরা ইমরান ভাইয়ের হাতে ছিলো, তিনি
তাঁর ইচ্ছামতো ছবি তুলেছেন। পরে দেখি প্রকৃতির চাইতে আমার ছবিই বেশি।
কিছু ছবির জন্য মানচিত্র ও হাসান ভাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০৯