আগের পর্ব
পরের পর্ব
সবগুলো পর্ব
অনেক আগে একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, যেটার নায়ক থাকে ১১/১২ বছরের একটা ছেলে। আমি যখন সেটা পড়ি তখন আমিও সেই বয়সি ছিলাম, তাই উপন্যাসটার সাথে একেবারে মিশে গিয়েছিলাম। কাহিনীটা ছিলো ব্রিটিশ আমলের। গল্পের বিষয়টা থাকে এরকম যে, ছেলেটার বড় চাচী রেঙ্গুন শহরে থাকে। যেটি এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বেশি নারী অধিকার সম্বলিত দেশের সবচেয়ে বড় শহর। তার চাচী অপূর্ব কারুকার্যখচিত সুদৃশ্য কাঠের বাক্সে গহনা রাখে, কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে, শাড়ির আচল থাকে ছোট। খোপায় ফুলের মালা জড়িয়ে আর রঙিন বার্মিজ ছাতা হাতে নিয়ে রোজ বিকালে ঘুরতে বের হয়।
তো এই দৃশ্যটা আমার মনে গেথে গেছে, আর এটিই আমাকে বার্মার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলো। আমি জানি সেখানে কোন বাঙালি রমনীকেই আমি ছোট আঁচলের কুঁচি দিয়ে পড়া শাড়ি, খোপায় গোঁজা ফুল আর রঙিন বার্মিজ ছাতি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখবো না, কিন্তু সত্যিই তেমন কিছু আছে কিনা শুধুমাত্র তা খোজার জন্য মায়ানমার যাবো।
এবং অবশেষে একটা পর্যায়ে আমার ইয়াঙ্গুন শহরে যাবার সুযোগ এসেছিলো। পর্যটন মেলা থেকে এক বন্ধুর বদৌলতে এই সুযোগটা পেয়েছিলাম। আমার প্রথমে ঠিক বিশ্বাস হয়নি!! কৈশরের স্বপ্নটুকু একেবারে হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছিলো! আমি খুবই খুশি ছিলাম, প্লেনের টিকিট পর্যন্ত কনফার্ম হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু হঠাত করে আমার বাবা বেঁকে বসেছিলেন, তিনি আমাকে কিছুতেই মায়ানমার যেতে দিতে রাজী হননি।
যেহেতু তিনি রাজী হননি এজন্য ইয়াঙ্গুন যাওয়াটা আমার পক্ষে অসম্ভবপর হয়ে দাড়িয়েছিলো। ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুবই মনোকষ্টে পড়েছিলাম।আমার বাবা আমার এই দূরাবস্থা দেখে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন পর তিনি আমাকে বলেছিলেন যে মায়ানমারের বদলে আমি অন্য কোথাও যাতে পারি। আমি আর সময়ক্ষেপণ না করে তাকে বলেছিলাম,”ঠিক আছে, আমি তাহলে হিমালয়ে যাবো।“ স্মিথ হেঁসে বাবা আমাকে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
আমার পক্ষে ভারতে যাওয়ায় সবথেকে সুবিধাজ্বনক ছিলো। কিন্তু ভারতে যাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে অসুবিধা সেটি হচ্ছে ভিসার জন্য ইটোকেন পাওয়া। ভিসা সহজে পাওয়া যায়, কিন্তু ই টোকেন সহজে পাওয়া যায় না। একটা ট্রাভেল কোম্পানিকে দিয়েছিলাম ই টোকেন করতে। কিন্তু মাসখানেক পার হয়ে যাবার পরেও সেটি না হওয়াই আমি রিপন ভাইয়ের দারস্থ হলাম।
রিপন ভাই হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যিনি আমার যতো অপ্রয়োজনীয় কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং আমার যতো অপ্রয়োজনীয় কাজ খুবই গুরুত্বের সাথে করে থাকেন। এই মানুষটা ৫ দিনের মাথায় আমাকে ই টোকেন করে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু মাঝের চারটি দিন আমি তাকে প্রচন্ড ভাবে বিরক্ত করেছি, আসলে আমিও তখন অস্থির হয়ে ছিলাম। রিপন ভাইয়ের মেয়েটা হাসপাতালে অথচ আমি তখন তাকে ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি, এই ব্যাপারট ভাবলে এখন আমি সত্যিকারভাবে অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। রিপন ভাই, আমি আপনার কাছে সেই সময়টার জন্য ক্ষমা প্রাথনা করছি।
ই টোকেন হয়ে গেল, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক এখন শুধু নির্দিষ্ট দিনে জমা দিতে পারলেই হলো। হঠাত কি মনে হওয়াতে একদিন বিকালে কৌতুহলবশত ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে কল দিলাম, তখন সেখান থেকে আমাকে জানালো যে ডলার এন্ডোসমেন্ট লাগবে ২ সপ্তাহের মধ্যকার তারিখের।
আমার ৬ মাস আগে থেকে এন্ডোস করা ছিলো, কিন্তু সেটাতে নাকি চলবে না। নূতন করে করা যেতেই পারে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কি কারনে যেন সরকারি আর সাপ্তাহিক মিলিয়ে টানা তিনদিনের ছুটি, আর তারপরেই আমার জমা ডেট। এখন এন্ডোস করাই কোথা থেকে!! সে সময় হাজির হলেন আমি গাডডুর বাপ । আমার দেখা সবচাইতে বুদ্ধিদিপ্ত মানুষদের একজন। (আগের ভ্রমন সিরিজটাতে আমি একটা ধাধা ধরেছিলাম, তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম সঠিক উত্তর প্রদানকারী। আরো কয়েকটি ব্যাপারে তার চটজলদি মন্তব্যে আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছি। তবে তিনি সবসময়ই আক্ষেপ করেন, কারণটা হচ্ছে ভাবী নাকি তার মেধার একেবারেই মূল্যায়ন করতে চায় না। আমি সবসময় তাকে স্বান্তনা দিই এই বলে যে ভাবীর আইকিউ নিশ্চয় তার থেকেও বেশি। তিনি কি ভাগ্যবান!! এরকম বুদ্ধিমতি বউ কজনের ভাগ্যে জোটে?) তো গাড্ডুর বাপই কিভাবে কিভাবে যেন আমার ডলার এন্ডোস করে দিলেন।
সব ঝামেলা শেষ, নির্দিষ্ট দিনে গুলশানে গেলাম ফর্ম জমা দেবার জন্য। কি বোকা আমি!! আমার সিরিয়াল পড়েছে তিনতলায়, আর আমি দু ঘণ্টা যাবত দোতলায় বসে আছি!! দোতলার কাউন্টারের লোকটা আমার উপর চরম বিরক্তি প্রকাশ করলো। আবার গেলাম তিনতলায়, সেখানে একেবারেই সময় লাগেনি। মাঝখান থেকে এতোক্ষন সময় নষ্ট হলো।
সপ্তাহখানেক পরে গেলাম পাসপোর্ট ফেরত আনতে। এক বছরের ভিসা হয়েছে, কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গাতে। অমানিশার কালো মেঘ আমার মুখে প্রতিফলিত হইলো, তলপেট চিনচিন করিয়া উঠলো, আর অনাগত ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দুশ্চিন্তায় অস্থির হইয়া উঠিলাম আমি। মানসপটে ভাসিয়া উঠিলো বিশালবপুর বাড়িওয়ালি আন্টির মুখখানি। এবার ভিসা ফরমের সাথে বিদ্যুৎ বিলের আসল কপি জমা দিয়েছিলাম। ইন্ডিয়ান এম্বাসি সেটা ঝেড়ে দিয়েছে!!! (এই ঘটনার পর থেকে আমি এখনো পর্যন্ত আর আমার বাড়িওয়ালি আন্টির মুখোমুখি হইনি)।
ভিক্ষা দাও হে পুরবাসী
এই ব্যাপারে প্রথম ঝাপটা গেল আমার মামাতো ভাইয়ের উপর দিয়ে। আমার ঘ্যানঘ্যানে অস্থির হয়ে সে একদিন আমাকে উত্তরাতে নিয়ে গেল। তারপর অসাধারণ একটা ট্রাভেল ব্যাগ কিনে দিলো। ব্যাগ কেনা শেষে আমাকে খাওয়ালো। তারপর একগাদা ঝাড়িঝুড়ি আর উপদেশ দিয়ে আমাকে বিদায় দিলো। আমি তার ঝাড়িঝুড়িতে কিছুই মনে করিনাই। কারণ আমার মন জুড়ে তখন আছে শুধুই অসাধরন ব্যাগটা। বড় ব্যাগটার একটা ছোট বাচ্চাও আছে। ব্যাগ যে এরকম হতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিলো না। আমি বাচ্চা ব্যাগটা নিয়ে খুবই আপ্লুত ছিলাম। (এই বাচ্চা ব্যাগটা পরে আমাকে হিমালয়ের গহীনে সত্যিকারভাবে সাহায্য করেছিলো।)
হেঁটে হেঁটে উত্তরা থেকে মিরপুর আসছি ( সেদিন এক অপ্সরীর স্বর্গ থেকে মর্তে আরোহণ উপলক্ষ্যে এয়ারপোর্ট থেকে দুপাশের রাস্তা পুরো বন্ধ ছিলো) মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দেখি সামনে সেতু আর নিয়ন। ( এই বাংলাদেশী রাজপুত্রদ্বয়ের সাথে আমার কলকাতাতে পরিচয়, যা আগের সিরিজে বিস্তারিত আছে)। তবে লস হয়নি এদের সাথে এই হঠাত সাক্ষাৎকারে। আমি ইন্ডিয়াতে যাবো এই উপলক্ষ্যে তারাও কিছু দান করলো (অবশ্যই কিছু স্বার্থের বিনিময়ে)। একফাকে ১০০ টাকার বিনিময়ে আমি আমার পুরানো সানগ্লাস সেতুকে গছিয়ে দিলাম (রাতের অন্ধকারে বেচারা বোঝে নাই নূতন নাকি পুরাতন সানগ্লাস)।
এবার আমার মামা-মামীর পালা। মামারা রাগে গজগজ করতে করতে আমাকে কিছু ধরিয়ে দিলো। অবশ্য যা ধরিয়ে দিলো তার থেকে বেশি শুনিয়ে দিলো। মামীরা অবশ্য খুব খুশিমনেই দিলো। একগাদা টাকার সাথে একগাদা ফরমায়েশও দিলো।(তাদের ফরমায়েশি জিনিসপত্র আনতে আমার খুবই কষ্ট ও হ্যাপা সহ্য করতে হয়, সকরুণ ভাবে এটা বোঝানোতে অনুদানের পরিমাণ আরো বাড়লো।)
একদিন বড় খালা বাড়ি বেড়াতে গেছি, খালাম্মা আমাকে চুপিসারে একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার ট্যুর উপলক্ষ্যে একটা বড় নোট দিয়ে বললেন যে খালু যেন টের না পায়। তারপর খালু আমাকে চুপিসারে আলাদা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে তিনটে বড় নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন যে খালাম্মা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়।(আমি অবশ্য কাউকেও কিচ্ছু টের পেতে দিইনি।)
এতো জায়গা থেকে টাকা সংগ্রহ করলাম, তারপরেও অনেকখানি কম। কিছুটা মন খারাপ, কারণ যতো বেশি টাকা ততো বেশিদিনের ট্যুর। ঢাকা থেকে রওনা দেবার আগেরদিন বিকালে আশিক আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আশিক হচ্ছে আমার অসম্ভব প্রিয় একজন সহপাঠী ও বন্ধু। অসম্ভব ভালো এই মানুষটা জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি। (আমি বেশ কয়েকবার ওকে দিয়ে মিথ্যা বলানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। হুজুর মানুষ, খুব ভালো গজল গাইতে পারে। আমার ক্লাসের অধিকাংশ সময় এই ছেলেটার পিছনে দুষ্টুমিতে কাটে।) একগাদা ডেঙ্গু জ্বর গায়ে নিয়ে সে উপস্থিত। তারপর একতোড়া ঝকঝকে নোট আমার দিকে এগিয়ে দিলো। (আল্লাহ নিশ্চয় ওর এই সাহায্যের খুব ভালো প্রতিদান দেবেন, আমীন)।
ঢাকার সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ করে যশোরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য যশোরে বাড়িতে গিয়ে দুদিন বিশ্রাম নেব, তারপর কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৫৯