পরের পর্ব
সবগুলো পর্ব
অক্টোবরের ১ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ভারত ট্যুরে ছিলাম। ২১ দিনের অধিকাংশ সময়টাই কেটেছে হিমালয়ের সান্নিধ্যে। আমার এবারের ট্যুর ছিলো দেবভূমি খ্যাত উত্তরাখন্ড রাজ্যে। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যটি দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে গাড়োয়াল বিভাগ আর অন্যটি হচ্ছে কুমায়ুন বিভাগ।আমার ট্যুরটা ছিলো মূলত গাড়োয়াল অংশ কেন্দ্রিক। রুটটা ছিলো, কলকাতা>হরিদ্বার>জানকিচাট্টি>যমুনাত্রী>উত্তরকাশী>গঙ্গোত্রী>ভুজবাসা> গোমূখ>তপোবন>শ্রীনগর>শোনপ্রয়াগ>কেদারনাথ>চোপতা>তুঙ্গনাথ>চন্দ্রশীলা>
বদ্রীনাথ>হরিদ্বার>সিমলা>দিল্লী>কলকাতা। এই ২১ দিনে বিভিন্ন রকমের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
হিন্দুদের তীর্থস্থান সম্পর্কে আমার মনে একটা বিরূপ ধারণা ছিলো। আমি ভেবেছিলাম এই জায়গাগুলো নিশ্চয় খুব নোংরা হবে। আর যেহেতু তীর্থস্থান তাহলে সেখানকার স্থানীয় লোকেরা অবশ্যই খুবই টাউটবাজ হবে। ( ধর্মীয় স্থান সম্পর্কে আমার এই বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবার কারণ হচ্ছে খুব ছোটবেলায় আমি একবার বাগেরহাটে খান জাহান আলীর মাজারে গিয়েছিলাম। সেখানকার দীঘিতে কুমিরকে খাওয়ানোর নাম করে একটাই মুরগী ১০ বার করে বিক্রি হচ্ছিলো। এই ব্যাপারটা নিশ্চয় আমার মনে নেতিবাচক একটা প্রভাব ফেলেছিলো)। তাই এবারের দেবভূমি ভ্রমনে আমি আমার টাকা-পয়সা আর লাগেজ নিয়ে সবসময় খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যেহেতু আমি একা মানুষ, কোন কিছু খোয়া গেলে আমাকে চরমভাবে বিপদে পড়তে হতো। বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে দেশে ফেরত আসার পর আমি আমার এই বিরূপ ধারণার জন্য এখন লজ্জ্বা পাচ্ছি।
সুদীর্ঘ ২১ দিনে আমার সহযাত্রী হিসাবে ছিলো কখনো মায়ানমারীয়, কখনো নেপালি, কখনো সাউথ-আফ্রিকান, কখনো জাপানি, কখনো রাশিয়ান আর অতি অবশ্যই ইন্ডিয়ান। সেই ইন্ডিয়ানেও ভেরিয়েশন ছিলো। কেউ মহারাষ্ট্রীয়, কেউ কেরালার, কেউ বাঙালী, কেউ দেরাদুনের, কেউ লখৌয়ের, কেউ উত্তরপ্রদেশের, কেউ গাড়োয়ালের আবার কেউবা দিল্লীর।
আমি কখনো থেকেছি আশ্রমে, কখনো তাবুতে, কখনো যাত্রীনিবাসে, কখনো রিটায়ারিং রুমে আবার কখনো হোটেলে। কখনো আমার শয্যাসঙ্গী ছিলো কোন জটাধারী ভারতীয় সন্ন্যাসী, কখনো অতিরিক্ত সুদর্শন ফরাসী যুবক আবার কখনো নীলনয়না মোহনীয় লাস্যময়ী ইজরাইলী নারী। সত্যি বলছি, যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে যে আমার জীবনে এখনো পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবচাইতে আশ্চর্যজ্বনক ঘটনা কোনটি, তাহলে আমি অবশ্যই যে ঘটনাটি বলবো তা হচ্ছে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে আমার শরীরের সাথে কুন্ডলী পাকিয়ে এক ইজরাইলী নারী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। পুরো হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম আমি সেসময়।
একরাতে সহযাত্রী রাশিয়ানরাও আমাকে তাদের শয্যাসঙ্গী হবার আমন্ত্রন জানিয়েছিলো। কিন্তু সুদর্শন ফরাসী যুবক আর প্রিয়দর্শিনী ইজরাইলী তরুনীর পর দুটো রাশিয়ান হিপি!!! ওরে বাবা!! এতোটা আমার সহ্য হতো না। ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
কখনো কোন হোটেলওয়ালা আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আমি মুসলমান বলে, আবার কখনো কোন সাধু-সন্ন্যাসী আমার কাছে মাথা নিচু করে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে এই ঘটনা শোনার পর। বারবার সে আমাকে বলেছিলো, যারা এই কাজগুলো করে তারা কখনোই ধার্মিক নয়। আবার বাংলাদেশী হিসাবে আমি কখনো অতিরিক্ত সুবিধাও পেয়েছি, কখনো খাবারের নিমন্ত্রন, কখনো থাকার জায়গা।
হিমালয়ের এই অংশে এতো পরিমানে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় ট্যুরিস্টকে দেখে অত্যান্ত আশ্চর্য হয়েছি। ৮ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বুড়ি পর্যন্ত। আসলে পর্যটনে ভারত অনেক উন্নত। মোটকথা সে পৃথিবীর সবাইকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
যাত্রাপথে কখনো কোন সুইডিশ যুবক আমাকে শিখিয়েছে “ইয়োগ এলক্সার দে”, আবার কখনো কোন রাশিয়ানকে আমি শিখিয়েছি, “খানকির পোলা”। একবার এক মন্দিরের সন্ন্যাসী আমাকে বিকট জোরে ধমক দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে, “ধূর! চুদির ভাই” বলে সঙ্গে সঙ্গে পিছন ঘুরে চলে এসছিলাম। একসাথে হেঁটে আসার পথে কেদারনাথ মন্দিরের পুরোহিত আমাকে শুনিয়েছিলো পূজোর সংস্কৃত শ্লোক, বিনিময়ে আমি তাকে শুনিয়েছিলাম নজরুলের ইসলামিক বাংলা গজল।
আমি মোটামুটিভাবে ১২ টি নদীর আঁতুড়ঘর অথবা শৈশব দেখেছি। এগুলো হচ্ছে যমুনা, অমরগঙ্গা, আকাশগঙ্গা, রক্তগঙ্গা, দুধগঙ্গা, ধৌলীগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিন্ডার, বাসুকিগঙ্গা, মান্দাকিনী, স্বরস্বতী, অলোকানন্দা। আর দেখেছি একটা নদীর জন্মানো । পৃথিবীর সবচাইতে বিখ্যাত নদীগুলোর একটি। জন্মস্থানে সে ভাগীরথী নামে পরিচিত। ১৩,২০০ ফিট উঁচুতে মায়ের জরায়ু থেকে তার মুচড়ে মুচড়ে বের হয়ে আসার ভঙ্গিটা দেখা আমার কাছে ছিলো চরম বিস্ময়কর। আমি সত্যিকারভাবে অভিভূত হয়েছিলাম। সদ্য জন্মানো ভাগিরথী সেখান থেকে ২০৫ কিলোমিটার দূরের দেবপ্রয়াগে গিয়ে যখন অলকানন্দার সাথে সঙ্গমে ব্যাস্ত ঠিক সেখান থেকে তার নাম হয়েছে গঙ্গা। আমি কিশোর ভাগীরথী আর তরুণী অলোকানন্দার এই সঙ্গম দৃশ্যেরও সাক্ষী হয়েছিলাম। গাড়োয়াল রাজ্যের অনেককেই আমি বলেছি যে, তোমাদের এখানের ৩০ ফিট চওড়া গঙ্গা বাংলাদেশে ৬ কিলোমিটারের পদ্মা। মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশিরভাগ লোকই আমার কথা বিশ্বাস করেনি।
তপোবন ছিলো আমার দেখা আর একটা পরম বিস্ময়। গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের বরফ আর বড় বড় বোল্ডারের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সেখানে যেতে হয়। প্রায় ১৫ হাজার ফিট উচ্চতার প্রচন্ড দুর্গম আর আবহাওয়ার চরম ভাবাপন্ন প্রতিকূল এই স্থানে শুধুমাত্র একজন মহাত্মা বাস করেন। এটি শীতে ৩০ ফুট বরফের নীচে চাপা পড়ে। সবচেয়ে কাছের শহর যেখানে বছরে শুধুমাত্র ৬ মাসের জন্য মানুষ বাস করে সেটিও এখান থেকে যেতে পুরো দুটোদিন লাগে। আর জনমানবহীন এই রূপসুধায় তিনি শুধুমাত্র একা তপস্যা করেন। তার তপস্যার অনেকগুলো স্তরের একটি হচ্ছে যে তিনি ১২ বছর যাবত কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না। এই তপোবনে সেই মাহাত্মাকে ঘিরে আশ্রয় বেধেছে একপাল পাহাড়ী বন্য প্রানী। এই প্রাণিগুলোর কি যেন একটা স্থানীয় নাম আছে, আমি ভুলে গেছি। আমি অবশ্য এগুলোকে হরিণ বলতে বেশি আগ্রহী। তো অমরগঙ্গা নদীর পাশে এই একপাল বন্য পাহাড়ী হরিণের (আমার ভাষায়) মাঝে ছোটাছুটিতে যে এডভেঞ্চার তা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। চারপাশের বরফের চূড়া থেকে আলো ঠিকরে আসছে। বহুদূরে আরো উঁচু পাহাড়ের হাতছানি। কৈলাস, ভগিরথী ১, ভগিরথী ২, ভগিরথী ৩, মেরু, শিবলিঙ্গ, কুন্ডসহ আরো কয়েকটা বিখ্যাত পর্বত চূড়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকরষণ করে। কোন কোন উপন্যাসে স্বর্গের বর্ণনা বুঝি এভাবেই পেয়েছিলাম।
হিমালয় নির্মমও বটে। তাকে স্পর্শ করতে গিয়ে আমি প্রতিবন্ধকতারও সম্মুক্ষীন হয়েছি। আমি প্রচন্ড জ্বরে ভুগেছি, আমার পায়ে বড় বড় ঠোলা পড়েছে, আমার হাতের নখগুলো দিয়ে রক্ত পড়েছে, আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে, আমার পুরো মুখের চামড়া পুড়ে গিয়ে খসে খসে পড়েছে, দুবার আমি বুঝি অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবসময়ই বিস্মিতভাবে আমি ভেবেছি, ইয়াল্লা!!! হিমালয়ের এতো রূপ!!!!
হিমালয়ে পথ চলার সময় কখনো কোন ভারতীয় পুরুষ ঠোঁট বেকিয়ে তীব্রভাবে আমাকে ব্যাঙ্গ করেছে আবার কখনো কোন নেদারল্যান্ডের নারী উদাত্তকণ্ঠে প্রশংসা করে আমাকে বলেছে,”ইউ আর দ্যা রিয়েল হিরো।“ ( যদিও তার প্রশংসার যোগ্য আমি ছিলাম না, পরে তার ভুল ভাঙিয়েছিলাম।) তবু এই প্রশংসাটুকুই আমাকে পরবর্তী পথটুকু চলতে দারুনভাবে সাহায্য করেছিলো।
একবার সত্যিকারভাবে মন খারাপ হয়েছিলো। বিশাল হিমালয়ের একটা অংশ থেকে বের হয়ে আসার সময় সেখানকার প্রহরী আমার শরীর আর ব্যাগ চেক করেছিলো। তাকে দেখাতে হয়েছিলো যে আমি এই বিশাল অভয়ারণ্যের কোথাও এতোটুকু ময়লা ফেলে আসিনি। গুনে গুনে তাকে দেখাতে হয়েছিলো বিস্কুটের ছেঁড়া প্যাকেট আর পানির খালি বোতল। আচ্ছা কি হতো একটা বিস্কুটের প্যাকেট এই বিশাল পাহাড়ের কোন এক কোনে ফেলে আসলে! কিন্তু ভারত সরকার তাতে রাজী নয়। সে একটা প্লাস্টকের টুকরো ফেলেও হিমালয়কে কলঙ্কিত করার ব্যাপারে খড়্গহস্ত। অথচ আমরা আমাদের সুন্দরবনকে কিভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যাবহারের মাধ্যমে, আর সেই ধ্বংস সাধনের জন্যও কি বিশাল বিপুল মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে।
হিমালয়কে ভালোবাসি। সবকিছু সুষ্ঠভাবে শেষ হবার জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।
যশোরের বেনাপোল
কলকাতার বিবাদীবাগ
সকালে ইন্ডিয়ান ট্রেন থেকে আশেপাশে যা দেখা যায়
হরিদ্বারের হোরি কি পৌরি ঘাট। এখান থেকেই গঙ্গা সমতলে চলা শুরু করেছে।
বারকোট যাবার পথে পাইনের সারি
জানকিচাট্টি যাবার পথে যমুনা নদী
যমুনাত্রী মন্দিরে যাবার পথ
হিমালয়ে এক পথের মাঝে
যমুনা নদী যে কয়টা পাহাড়ি ঝরনা থেকে উৎপত্তি তারমধ্যে প্রধানতমটি আমার পায়ের নীচে
গঙ্গোত্রী যাবার হাইওয়ে
গঙ্গোত্রীতে ভাগীরথী গঙ্গা
ভাগীরথী গঙ্গার মাঝে
ভুজবাসা যাবার পথ
এই পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে ভুজবাসা যেতে হয়
গোমূখ, গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার থেকে গঙ্গা নদী তৈরি হচ্ছে। এখানে নদীটার নাম ভাগীরথী। এটি প্রায় ১৩ হাজার ফিট উঁচু।
এটা গঙ্গোত্রী হিমবাহ। এই বরফ আর বোল্ডারের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তপোবনে যেতে হয়। বরফ আর বোল্ডারগুলো সবসময়েই
ধ্বসে পড়ছে। স্থির নয় পুরোই অস্থির একটা পথ।
আহ!! তপোবন!!! এটি প্রায় ১৫ হাজার ফিট উঁচু।
তপোবনে পাহাড়ী বন্য ছাগল। (আমার কাছে অবশ্য এগুলো হরিণ।)
একপাল পাহাড়ী বন্য হরিণের মাঝে আমি
কেদারনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ
কেদারনাথ
চোপতা বুগিয়াল
আহা!! আমি গোধূলি বেলায় হিমালয়ের এই রূপের সাক্ষী হয়েছিলাম!!
বদ্রীনাথ মন্দির
প্রিয় শহর সিমলাতে
আমার সবচাইতে প্রিয় বাহন সিমলার টয় ট্রেন
দিল্লীর জামে মসজিদে
আমার মুখ কিভাবে পুড়েছিলাম তার ছোট্ট একটা নিদর্শন
বিঃদ্রঃ শয্যাসঙ্গী শব্দটার ভিন্নার্থ না করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:৫৫