যেহেতু এটা শেষ পর্ব, তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করবো যে এটা এখনই না পড়তে। প্রথম পর্ব থেকে শুরু করুন, আস্তে আস্তে ধারাবাহিকভাবে শেষ পর্বে আসুন। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ। আমি অনুরোধ করছি। প্রথম থেকে
লাদাখের সবচেয়ে বড় শহর লেহ। আর এই শহরের যেকোন প্রান্ত থেকে যে স্থাপনাটি অবশ্যই চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে লেহ প্যালেস। রাজপ্রাসাদ ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে যে দৃশ্যপট ভেসে ওঠে লেহ প্যালেস দেখতে মোটেই সেরকম না। মাটির তৈরী ৯ তলা এই ভবনটি আশেপাশের পাহাড়ের সঙ্গে নিজের শরীরের রঙ মিলিয়ে ফেলেছে।
এটি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত বিশেষ একশো স্থাপনার একটি। একারণে সরকার বেশ নড়েচড়ে বসেছে। ঐতিহাসিক এই রাজপ্রাসাদ আর পুরানো লেহ শহরটি সংস্কারের মাধ্যমে তার নস্টালজিক রূপটি ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৫৩৩ সালে তৈরী শুরু হওয়া এই প্রাসাদটি কয়েকশো বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসাবে বিবেচিত ছিলো।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে রওনা দিলাম রাজপ্রাসাদটি দেখার জন্য। বিভিন্ন অলিগলি পার হয়ে যেতে হয় সেখানে।
গলির বিভিন্ন জায়গায় দিক নির্দেশনা আছে প্রাসাদে যাবার পথের।
বিভিন্ন বাড়ির মাটির নীচ দিয়ে, সরু গলি-উপগলি দিয়ে পথ চলে গেছে। এই রাস্তাধরে হেঁটে যেতে খুবই মজা পাচ্ছি।
আলো-আধারীর রহস্যময় একটা পরিবেশ। আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝি কোন টাইম মেশিনে চেপে হুট করে মধ্যযুগের কোন শহরে পৌছে গেছি। সত্যিই ব্যাপারটা অসাধারণ।
।
পথটা কোন কোন জায়গাতে একেবারেই ধসে গেছে। হাচড়ে পাচড়ে সেসব জায়গা পার হচ্ছি, এই জায়গাগুলো খুবই রিস্কি।
কিন্তু যতোই উপরে উঠছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি।
আশেপাশের সকল দৃশ্য আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। রোদের আলোতে সবকিছু ঝলমল করছে।
পুরো শহরের সবগুলো ভবন যেন সবুজ ঘাসের অরন্যে হারিয়ে গেছে। তাদের সাথে আমিও কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলাম।
অবশেষে উপর পর্যন্ত উঠে এলাম আর কিছুটা বোকা বনে গেলাম। দেখি এখানে গাড়ি চলাচলের জন্য একটা রাস্তা আছে। ধনী পর্যটকরা গাড়িতে চেপে রাজপ্রাসাদের দোরগোড়ায় উঠে আসছে।
টিকিট কাউন্টারে টিকিট কাটতে গেলাম। বাংলাদেশীদের জন্য মাত্র ৫ রুপি। আমি ছাড়া অন্যান্য বিদেশীরা ১০০ রুপি দিয়ে টিকিট কাটলো।
টিকিট কাটার পর কিছুক্ষণ থমকে দাড়ালাম। আমি খুবই উত্তেজিত। কয়েক শতাব্দি ধরে টিকে থাকা একদা পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু ভবন আমাকে মোহবিষ্ট করে ফেলেছে। এটি এখন আমার ধরা-ছোঁয়ার সানিধ্যে।
অন্যরকম একটা অনুভূতি। অবশেষে রাজকীয় সিঁড়িতে পা রাখার সৌভাগ্য আমার হলো। আর তারপরই আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম।
সত্যি কথা বলতে কি এই রাজপ্রাসাদটিতে আসলে তেমন কিছুই নেই। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ভিতরের বৌদ্ধ মন্দিরটি তার ঝলমলে অস্তিত্ব কিছুটা টিকিয়ে রেখেছে।
বাকী সবকিছু ধুলিস্যাত। তবে আশার কথা হচ্ছে এই যে সবকিছুর সংস্কার চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এটি তার সুদূর অতীতের রূপ ফিরে পাবে।
কিন্তু আমি রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তূপের চোখে দেখিনি। আমি আমার কল্পনার চোখে দেখেছি। আমি দেখার চেষ্টা করেছি যে, পাঁচশো বছর আগে এই প্রাসাদটি কেমন ছিলো। এই প্রাসাদের রাজারা কিভাবে তাদের রাজ্য চালাতেন, রানীরা কিভাবে তাদের মহল সামলাতেন, প্রজারা কিভাবে সমাদৃত হতো, কিভাবে দূর-দূরান্ত থেকে রাজার দূতেরা তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতো, কিভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হতো, বছরের বেশিরভাগ সময় যখন পুরো রাজ্যটা বরফের তলায় চাপা পড়তো তখন এখানকার মানুষেরা কিভাবে তাদের দিন কাটাতো। এবং সত্যি কথা বলতে কি এভাবে দেখার চেষ্টায় আমি প্রচন্ডভাবে মুগ্ধ হয়েছি। আমার মনে হয়েছিলো যে আমি ঠিক সেই ৪০০ বছর পিছনে পৌছে গেছি।
খুব নীচু একটা প্রাসাদ এটি। ছাদ যেন আমার মাথায় ঠেকে যাচ্ছে, একটু নীচু হয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। ভবনটি মোট ৯ তলা। ছোট ছোট ঘর আর অলিগলিতে ভরা। কেমন যেন আলো-ছায়ার গোলক ধাধার পরিবেশ। ছোট ছোট কাঠের সিঁড়ি। ছাদগুলো গাছের ডাল দিয়ে তৈরী, আর দেয়ালগুলো মাটির। কোন কোন ঘরে রঙ্গিন আল্পনা আঁকা, সেগুলোতে কাঠের কাজ খুবই সুন্দর। লেখা রয়েছে যে এগুলো রাজকীয় কক্ষ।
ঝুলন্ত বারান্দাগুলি খুবই সুন্দর। এই বারান্দাগুলো থেকে পুরো শহরটা এক লহমায় দেখা যাচ্ছে।
যতোই ভবনের উপর তলার দিকে উঠছি ততোই ঘরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ৮ তলায় এসে দেখি মাত্র দুটো ঘর, আর পুরোটুকুই ছাদ। ৯ম তলায় যাবার সিঁড়ি খুঁজে পেলাম না।
৮ তলার ছাদের একটা কোনায় এসে বসলাম। আবহাওয়া সেইরকম চমৎকার আর চারপাশের দৃশ্য সেইরকম পাগলকরা।
মোবাইলে আমার খুবই প্রিয় একটা বাংলা গান ছেড়ে দিলাম। পা ছড়িয়ে-মেলিয়ে বসে আছি। অনেকখানি আনমনা, মন যেন সুদূরে ভেসে গেছে।
অনেকেই ভাবে যে একা বোধহয় ভ্রমণ করা যায় না। কিন্তু আমি পারি। আসলে আমি কখনোই একা থাকি না। আমার নিজস্ব ছোট্ট পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজনদের মধ্যে প্রিয় একজন মানুষ সবসময় আমার কল্পনায়, আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকে। আমি সবসময় তার উপস্থিতি অনুভব করি, তার সাথে কথা বলি, তার গান শুনি, তার সাথে খুনসুটি করি, অভিমান করি এমনকি তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত আমি টের পাই। আমি অনুভব করছি আমার জীবনের অসাধারণ এই মুহূর্তটাতে সে আমার পাশে ঘনিষ্টভাবে বসে আছে। তার শরীরের সৌরভ আমি উপভোগ করছি। মাথার উপরে ঘন নীল আকাশ, চারপাশের বিভিন্ন রঙের পাহাড়গুলো আকাশটাকে স্পর্শ করার তীব্র প্রতিযোগিতা করছে।
দূরের বরফের আস্তরণগুলি যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
সূর্যের ঝকমকে রোদ আর পায়ের নীচে আস্ত একটা শহর।
কানে বাজছে আমার সবচাইতে প্রিয় গানগুলি। মনে হচ্ছে আমিই বুঝি এই রাজপ্রাসাদের রাজা, আর আমার পাশে রাজ্যের মহামান্য রানী বসে আছে। আবেশে আমার চোখ বুজে আসছে। মনে হচ্ছে, আহ! আমার জীবনটা তো খারাপ না।
কতোক্ষণ বিভোরভাবে নিমগ্ন ছিলাম জানি না,হঠাত পরিচিত কিছু শব্দ কানে যাওয়াতে চোখ মেলে তাকালাম। কতোগুলি লোক বাংলায় কথা বলতে বলতে উপরে উঠে আসছে। বুঝতে পারলাম পশ্চীমবঙ্গের মানুষ এরা। পুরো একটা ফ্যামিলি। এর মধ্যে একটা ছেলেকে আলাদা ভাবে চোখে পড়ছে। ছেলেটা অসম্ভব রকমের সুন্দর। সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে পশ্চীমবঙ্গের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি সুন্দর কখনোই মনে হয়নি। গড়ে তারা বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের ( অতি অবশ্যই আমি বাদে) চাইতে কম সুন্দর এবং কম স্মার্ট । তবে এদের চোখেমুখে সবসময় অকালপক্কের একটা ছাপ থাকে, কেমন যেন চালবাজ ধরনের।
আর এরা নিজেদেরকে সবসময় অতিরিক্ত চালাক ভাবে। তবে এর ব্যাতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। পশ্চীমবঙ্গের কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা অতিরিক্ত সুন্দরী, ঠিক যেন দেবী দুর্গার মূর্তির মতো। কিন্তু সেই অর্থে সুন্দর ছেলে খুব বেশী চোখে পড়ে না। তবে এই ছেলেটা যেন সব দিক দিয়েই ব্যাতিক্রম। সৌন্দর্যে সে যে কোন বাংলাদেশী ছেলেকে টেক্কা দেবে। সে এতোটাই সুন্দর যে তার মুখে মেয়েলিসুলভ কমনীয়তা চলে এসেছে। ঠোটে একটা আলতো হাসি ঝুলিয়ে রেখে খুব দামী একটা ক্যামেরায় ছবি তুলে চলেছে সে।
যেহেতু আমি বেশ জোরে বাংলা গান শুনছি, এই গানে আকৃষ্ট হয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। হয়তো আমার সাথে কথাও বলতো, কিন্তু আমি কোনরকম আগ্রহ দেখাইনি। প্রয়োজন ছাড়া পশ্চীমবঙ্গের লোকের সাথে আমি যেচে কথা বলি না। তাদের সাথে খাস গল্প করার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি সবসময় দেখেছি যে বাংলাদেশী শুনলে তারা কেমন যেন দাদাগিরি ফলায়। একবার কলকাতা থেকে আমি দিল্লী যাচ্ছি রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে, সেবারই প্রথম আমার দিল্লী গমন। শীতকালে প্রচন্ড কুয়াশার কারনে ট্রেন কানপুর স্টেশনে থেমে আছে ৩ ঘণ্টা যাবত। সত্যিই এতো কুয়াশা যে তিন হাত দুরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
আমি ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে আছি। একজন টাকমাথা মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এলো আমার সাথে কথা বলতে। সেও একই ট্রেনের যাত্রী। আমাকে বললো, দেকেচেন দাদা কি কুয়াশা। আমি বললাম, হুম। আমাদের দেশে এতো কুয়াশা হয় না। জিজ্ঞাসা করলো, কোতা থেকে আশা হয়েচে। বললাম, বাংলাদেশ। আর সেটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখের ভাব একেবারে বদলে গেল। অবজ্ঞা সুলভ একটা ভঙ্গি নিয়ে আমাকে বললো, ও !! বাংলাদেশ থেকে। তারপর বেশ দাদাগিরির সুরে বললো, জানো আমাদেরও না বাংলাদেশে বাড়ি ছিলো। আপনি থেকে তুমিতে নেমে যাওয়া আর এই অবজ্ঞা ধরনের ভঙ্গি আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। তার সুর নকল করে বললাম, ও তোমরা বুজি ওকেনে জমিদার ছিলে। এটা বলে আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটা আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
সে ভাবতেই পারেনি যে আমিও তার সাথে এমন আচরন করবো। এই ঘটনার পর থেকে আমার কেমন যেন রোখ চেপে গেছে। পশ্চীমবঙ্গের যে কোন লোক আমাকে তুমি করে বললে আমিও তার সাথে তুমি করে বলি। কেউ আমার সাথে যেমন আচরণ করে আমিও ঠিক একই আচরণ করি। যস্মিন দেশে যদাচার।
প্রাসাদ দেখা শেষ হলে বিকালে হোটেলে ফেরত এলাম। একটা গল্পের বই নিয়ে এসেছিলাম সেটা খুব বেশি পড়াই হয়নি। বইটা হাতে নিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে গেলাম। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি একেবারেই টের পাইনি। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ঘুম ভাঙলো। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে, কিন্তু ঘরে পানি নেই। নীচে নামলাম পানি খাওয়ার জন্য। নিচতলার ঘরে দেখি একটা মেয়ে কাজ করছে। মনে হচ্ছে আস্তো একটা পরি। শুধু একাই রয়েছে সে সেখানে। এতো সুন্দর মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। খাওয়ার জন্য পানি চাইলাম তার কাছে।
জগ ভরা খাওয়ার পানি আর কাঁচের গ্লাস এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আর তারপর জানতে চাইলো যে আমি নাম এন্ট্রি করেছি কিনা। কিন্তু আমি ততোক্ষোনে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছি। একটা মেয়ের কন্ঠস্বর এতোটা সুন্দর হতে পারে কিভাবে! তার কথার প্রতুত্ত্যরে মাথা নেড়ে না জানাতে সে রেজিস্টার খাতা এগিয়ে দিলো আমার দিকে।
আমার সাথে টুকটুক করে কথা বলে চলেছে সে, আর আমি শুধু শুনেই চলেছি। তবু যেন আমি তৃপ্ত হচ্ছি না। তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে একটা আগুন রঙা টকটকে লাল ফুলে ভরা শিমুল গাছ থেকে নরম তুলা চারিদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। আর আমি দৌড়াদৌড়ি করে সেই তুলাগুলো শরীরে জড়াবার চেষ্টা করছি। যে মেয়ের কণ্ঠস্বর এতো সুন্দর তাহলে তার হাঁসির শব্দ না জানি কতো সুন্দর হবে! আমি অন্তত একবার হলেও তার হাসি শুনতে খুবই কৌতুহলী ছিলাম। কিন্তু আমাকে ভয়াবহ রকমের হতাশ করে সে একবারও হাসেনি। ভাগ্যিস সে হাসেনি! সে যদি হাসতো তাহলে আমি নির্ঘাত শারিরীকভাবে আহত হতাম!
এই বাড়িরই মেয়ে সে। তাদের পরিবারের সবাই মিলেই হোটেলটা দেখাশোনা করে। আরো টুকটাক বিভিন্ন ধরনের গল্প করছে । রেজিস্ট্রার খাতায় সব তথ্য পূরণ করে যখন পাসপোর্টের নম্বর লিখতে গেলাম তখন আমাকে বাঁধা দিয়ে সে বললো যে এটা নাকি শুধুমাত্র বিদেশীদের জন্য। বললাম আমি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছি। শুনে সে কিছুটা হতভম্ভ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, আমাকে দেখতে নাকি একেবারে ইন্ডিয়ানদের মতো লাগে, সে নাকি ভাবেইনি যে আমি বাইরের দেশের। পুরো রেজিস্ট্রার খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে দেখলাম। আবিষ্কার করলাম এই হোটেলে আমিই প্রথম বাংলাদেশী অতিথি।
সন্ধ্যার পর আবার বাইরে বের হলাম। শহরের বিভিন্ন রাস্তা আর অলিগলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মনোরম আবহাওয়া। পথে-ঘাটে দেখি গাধা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছোট ছোট আকারের এই প্রানীগুলো দেখতে বেশ লাগে। তবে এই শহরের কুকুরগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। সাইজেও বিশাল আর খুবই হিংস্র।
আলী ভাই কিন্তু আমাকে এই কুকুরগুলোর ব্যাপারে বারবার করে সাবধান করে দিয়েছিলেন। দেখলাম রাস্তায় যারা চলাফেরা করছে মোটামুটি তাদের সকলের হাতেই লাঠি রয়েছে। তারপরও কতোগুলো কুকুর যখন নিজেদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিচ্ছে তখন লোকজন ভেঙ্গেচুরে দৌড় দিচ্ছে। সত্যিকারের দেখার মতো দৃশ্য হচ্ছে সেগুলো।
দুপুরে যে রেস্ট্রুরেন্টে খেয়েছিলাম সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। গরুর মাংসের অর্ডার দিলাম। সেটা খেতে অবশ্য খুব বেশি ভালো লাগেনি। কেমন যেন বোটকা একটা গন্ধ। তবে সমস্যা করেছিলো তার স্তিতিস্থাপকতা। খুবই শক্ত, যতোই টানি একটুও ছিড়তে পারি না। শেষ পর্যন্ত শুধু ঝোল দিয়ে ভাত গলাধঃকরণ করলাম।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আগামীকালের পথের জন্য কিছু পাথেয় ক্রয়ে ব্যাপৃত হলাম। ইন্ডিয়াতে বিস্কুটের দাম খুবই কম। এখানে ৫ রুপিতেও বিস্কুট পাওয়া যায়, সেগুলো স্বাদে-গন্ধে আর আকারে অনন্য হয়। তাই কিনলাম কয়েক প্যাকেট, আগামীকাল জার্নিতে এগুলো কাজে লাগবে। আর তারপর আমার হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
পথে যেতে যেতে দেখি দূরের শান্তিস্তূপাটি রঙিন আলোতে ঝলমল করছে।
ঝকঝকে আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ফুটে আছে। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো এই নক্ষত্রের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। কেমন যেন গর্জন তুলে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে। আলো-আঁধারির মোহনীয় পরিবেশ। যে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি সে পথে আর একটা প্রাণিরও সাড়াশব্দ নেই। শুধু আমি একা। নিজের অজান্তেই মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে উঠলো। কেমন যেন উথাল-পাতাল, হাহাকারের অনুভূতি। হয়তো আজ রাতেও আমি মারা যেতে পারি, পৃথিবীতে এতো সৌন্দর্য টিকে থাকবে অথচ আমি দেখতে পারবো না এই ভাবনাটাই আমার মনকে প্রচন্ডভাবে বাষ্পাচ্ছন্ন করে তুলেছে। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, তিনি অসম্ভব দয়ালু। এই রূপসী পৃথিবীর অন্তত কিছুটা রূপ দেখার তৌফিক তো তিনি আমাকে দান করেছেন! তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
অন্য প্রসঙ্গঃ
কলকাতার লেখকদের বিশেষ করে সমরেশ-সুনীলদের লেখা পড়ে আমাদের ধারণা, আহা পশ্চীমবঙ্গের লোকেরা বুঝি বাংলাদেশিদের প্রতি কতো গদোগদো। যেন আয় ভাই বুকে মিলি, এইরকম একটা ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সেরকম না। অন্তত আমি সেরকম মনে করি না। পশ্চীমবঙ্গের লোকেদের সম্পর্কে আমার ধারণা আগেও ভালো ছিলো না, এখন দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। অবশ্য ব্যাতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।
পশ্চীমবঙ্গের তরুণ-তরুণীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে কেমন যেন অবজ্ঞার ভাব। অথচ ওরা বাংলাদেশ সম্পর্কে এতো কম জানে, আর যেটুকু জানে তার অধিকাংশই ভুল। কিন্তু পশ্চীমবঙ্গের তুলনায় যে বাংলাদেশ কতোখানি উন্নত, বিশেষ করে মানসিকতার দিক দিয়ে, এগুলো সঠিকভাবে যদি ওরা জানতে পারতো!! এর উদহারণ হিসাবে খুব বেশি দূর যেতে হবে না, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বাংলা ব্লগগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
ফেসবুকে বিবিসি বাংলার একটা পোস্টে মন্তব্য করেছিলাম। অনেক পশ্চীমবঙ্গীয় লোক সেখান থেকে আমাকে ইনবক্স করেছে। তাদের বলার ধরণ প্রথম থেকেই রুক্ষ ছিলো, কিন্তু দিন দিন সেগুলো অসভত্যায় পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা এতো আজেবাজে মন্তব্য করে যে কল্পনা করা যায় না। আমি বাধ্য হয়েছি তাদেরকে ব্লক করতে। দু’একজন যে ভালো ছিলোনা তা নয়, কিন্তু তারা আসলে খারাপের তোড়ে হারিয়ে গেছে।
আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতার মুসলমানেরা বাংলাদেশ পছন্দ করে না। সবাই না, তবে অধিকাংশ। একটা ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক রাজাকার কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলো। তাদের অধিকাংশ কলকাতার খিদিরপুরে ঘাটি গেড়েছে। তাই বলে এ ব্যাপারে আমার কাছে তথ্য-প্রমাণ চাইলে আমি হাজির করতে পারবো না।
আমি সবচাইতে অবাক হয়েছি পশ্চীমবঙ্গের কিছু লোক আমার সাথে যখন ফেসবুকে চ্যাট করছিলো তারা একেবারেই বাংলা অক্ষর ব্যাবহার করেনি। পুরোটাই রোমান হরফে। তারা নাকি বাংলা লিখতে পারে না, আর এ ব্যপারে তাদের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। বরঞ্চ তারা যে খুব ভালো হিন্দি জানে সে ব্যাপারে তারা খুবই গর্বিত। হায় আফসোস!!
আমি তো আসলে ভারত খুবই কম ঘুরেছি, তবে যেটুকু দেখেছি আমার মনে হয়েছে ভারত হচ্ছে একটা জিরাফের মতো। এই জিরাফটার মাথা হচ্ছে কিছু বড়বড় শহর। যে শহরের লোকেরা খুব উন্নত জীবন যাপন করে। তারা এতোটাই উন্নত যে অবাক হতে হয়। কিন্তু এই কিছু বড় শহর ছাড়া পুরো ভারতটা হচ্ছে জীরাফের শরীর। এই জীরাফের পুরো শরীরটা অনেক, অনেক, অনেক পিছিয়ে আছে। তারা এতোটাই পিছিয়ে আছে যে অবাক হতে হয়।
তবে একটা কথা কষ্টকর হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে অনেক কম খরচে ভ্রমন করা যায়। আর ওদের ওখানকার লোকেরা বাংলাদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি পর্যটনমনষ্ক। ওরা পর্যটন ব্যাপারটাকে যেভাবে ধরতে পেরেছে আমরা সেভাবে পারিনি। আমাদের ট্যুরিস্ট এলাকার লোকেদের মধ্যে কেমন যেন খাই খাই ভাব, যেন কোন ট্যুরিস্ট পেলে তাকে সর্বস্বান্ত করে দিতে পারলেই লাভ। অথচ ভারতীয় ট্যুরিস্ট এলাকার লোকেরা অনেক প্রফেশনাল। তারা ট্যুরিস্টদের সেবার উপরেই জোর দেয় বেশি, অন্তত তারা টাকাগুলো হালাল করে নেয়। ওদের ওখানে কোন হোটেলের দালালকে ২০ রুপি দিলেই তারা খুশি, অথচ কক্সবাজারে কোন দালালকে ২০০ টাকার নীচে অফার করলে মারধোর খাবার প্রবল সম্ভবনা আছে।
আমার জন্য আরেকটা কষ্টদায়ক অনুভূতি হচ্ছে, ওদের প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংরক্ষনের ধরণ দেখা। এগুলো দেখলে কেমন যেন হিংসা লাগে। আমি যতোবারই পুরানো ঢাকার রুপলাল হাউজ দেখতে যায় ততোবারই বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার জাগে। দিল্লীর কুতুব মিনার, হুমায়ুন্স টম্ব অথবা আগ্রার তাজমহলে কতো যে কাঠবিড়ালী, টিয়া পাখি, অথবা বানর নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি আমি দিল্লীর মাটির ৪০/৫০ ফুট নীচের মেট্রো স্টেশনে দেখেছি যে কবুতরেরা বাসা বানিয়ে থাকছে। হায় আফসোস, আমাদের দেশের প্রত্নত্তাত্বিক স্থাপনার উপর দিয়ে এখন বোধহয় কোন কাকও উড়ে যায় না!
উপরুক্ত কথাগুলি সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব মতামত। আমি পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের কোন লোককেই আঘাত দিতে চাইনি। আমি যে কথাগুলো বলেছি, নিশ্চয় এর ব্যাতিক্রম আছে।
কৈফিয়তঃ
কৈফিয়ত ১, দেরী হওয়া প্রসঙ্গঃ
এই পর্বটা দিতে অনেক দেরী হয়ে গেল। আমি সত্যিই দুঃখিত। তবে আমি ইচ্ছা করে এটা করেছি, তা নয়। আমার পিসি থেকে সামুতে ঢোকা যাচ্ছে না। আমি সামুর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা আমাকে খুবই হেল্প করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমস্যা বোধহয় আমার নেট প্রতিষ্ঠানে। আমি সেখানে অনেকদিন ধরে যোগাযোগ করেছি, অথচ তারা আমাকে নূন্যতম সাহায্য করেনি। আমি এখনো পর্যন্ত সামু ব্লগে ঢুকতে পারছি না, এই পর্বটা আমি আমার বন্ধুর বাসায় তার পিসি থেকে দিতে বাধ্য হচ্ছি।
কৈফিয়ত ২, শেষ পর্ব প্রসঙ্গঃ
এটা সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। হা হা হা ।
কোন ভ্রমণের ১ মাসের মধ্যেই সেই ভ্রমণের কাহিনী তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আমার ভ্রমণ কাহিনী ১ বছর ধরে চলতেছে। কেমন যেন ইন্ডিয়ান অসুস্থ সিরিয়ালের মতো, শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। হা হা । আর এটাকে টেনে বেড়ানোর মানে হয়না। মোটামুটি ৩০ পর্ব হয়ে গেছে। এরপরও লিখলে সেটা বাহুল্য হয়ে যাবে।
আমার এই ইন্ডিয়া ট্যুরের মূল লক্ষ্যটা ছিলো কালকা থেকে সিমলা যাবার টয় ট্রেনটা ঘিরে। আমি পাহাড় খুব ভালোবাসি, ট্রেন খুব ভালোবাসি। আর দুটো যদি একসাথে হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। টয় ট্রেনটা চড়া ছাড়া বাকী যা কিছু ঘুরেছি সবকিছু আমার জন্য বোনাস। কিন্তু যেহেতু আমি লাদাখ অঞ্চলটার কিছু অংশে গিয়েছি, আর বাংলাতে লাদাখ নিয়ে লেখা বোধহয় কমই আছে, সেজন্য আমি ভেবেছি যে আমি যা দেখেছি সেগুলো লিখে ফেললে পরবর্তীতে যারা সেখানে যেতে ইচ্ছুক তারা বোধহয় আমার লেখাটা পড়তে আগ্রহী হবে। আশার কথা হচ্ছে, বেশ কজন আমার লেখাটা পড়ে ওই অঞ্চলটাতে গিয়েছে। আমরা আর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের লেখা সামুতে দেখতে পারবো। নিশ্চয় তারা তথ্যবহুল মজাদার ভ্রমণকাহিনী লিখবে।
সর্বোপরি আমার মেজমামী আমার লেখা পড়তে পছন্দ করেন বলেই এই সিরিজটা এতোদিন ধৈর্য সহকারে চালিয়ে এসেছি। কিন্তু একটা সিরিজ এতোদিন ধরে টেনে চলেছি দেখে আমার মেজমামীই আমার উপর বেশ বিরক্ত। তবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার ছিলো এটা যে, আমার মা আমাকে বলেছিলেন যে আমার বাবা নাকি লুকিয়ে নিয়মত আমার লেখা পড়েন। এটা আমার জন্য সবচাইতে বড় পাওয়া। সবশেষে আমি অশেষ ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবংধন্যবাদ জানাচ্ছি সবাইকে যারা এতো দিন ধৈর্যসহকারে আমার লেখাগুলো পড়েছেন, বিশেষ করে যারা আমার লেখাগুলোতে মন্তব্য করেছেন আর এর মাধ্যমে সিরিজটা চালিয়ে নিতে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
তবে সিরিজটা এভাবে হুট করে শেষ করলে আমার কোন কোন শুভার্থী বিরক্ত হতে পারেন। আচ্ছা তাহলে এক কাজ করা যাক। সিরিজের এই অংশটা পর্যন্ত প্রথম খন্ড হিসাবে নামায়িত করে বলা যাক প্রথম খন্ডের সমাপ্তি। এরপর দ্বিতীয় খন্ডের শুরু হবে। তবে দ্বিতীয় খন্ডটার লেখার ধরণ আলাদা হবে। সেখানে ধারাবাহিকতা থাকবে না। সেখানে শুধু ঘটনাগুলো প্রাধান্য পাবে। শেষ করছি কারগিল শহরের একটা ছবি দিয়ে। এটা সেই শহর যার সম্পর্কে আলী ভাই আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন, কিন্তু শহরটিতে গিয়ে আমার সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। দেখা যাক, দ্বিতীয় খন্ডের প্রথম পর্বটা কোন ঘটনাকে কেদ্র করে গড়ে ওঠে। সবাই ভালো থাকবেন।
অন্য পর্বগুলো
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:১২