আমি কখনোই লটারিতে বিশ্বাস করি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার টুকটাক লটারি ভাগ্য কিন্তু খারাপ না। তাই বলে এমন না যে কোন হাতি ঘোড়া পেয়ে গেলাম। খুবই ছোটখাট জিনিস পাই, কিন্তু এই ছোটখাট উপহারই হুটহাট করে অনেকগুলো আনন্দের মুহূর্ত তৈরী করে ফেলে।
শেষবারের ইন্ডিয়া ট্যুরে গিয়ে সিমলা যাবার সময় ট্রেনের মধ্যে দুজন বাংলাদেশী রাজপুত্রের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। সেখানে বেশ কয়েকটা দিন আমরা একসাথে ছিলাম। দেশে ফেরত আসার পর তাদের সাথে আমার সম্পর্কটা আরো জোরালো হয়েছে। তো ইন্ডিয়াতে থাকাকালীন একদিন কেনাকাটার জন্য কলকাতায় আমরা একটা শপিং মলে গিয়েছি। শপিং মলটিতে কি যেন একটা উৎসব হচ্ছিলো। আর এ উপলক্ষে কোন জিনিস কিনলে তার সাথে একটা করে ফ্রী কুপন পাওয়া যাচ্ছে।
এই রাজপুত্র দুজন নাকি দুলাখ টাকা নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলো। আল্লাহই জানে এরা এতো টাকা কিভাবে উড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেশে আসার সময় তারা আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছিলো। যাই হোক দোকানদারের সাথে অনেক ছ্যাচড়ামি অনেক অনুনয় অনেক বিনয় করে তারা দোকানদারটিকে রাজি করাতে পেরেছিলো যে একটা জিনিস কিনে তারা তিনটা কুপন নিবে যেহেতু আমরা তিনজন মানুষ। অসহায় দোকানদার শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলো।
তো একটা জিনিস কিনে আমরা তিনটা কুপন পেলাম। প্রথমে প্রথম রাজপুত্র তার কুপনের স্ক্র্যাচ কার্ডের কালো অংশ ঘসে ঘসে তুললো। দেখা গেল সে ১০ রুপি ছাড় পেয়েছে। এটা দেখে সে তো খুবই খুশি। কলকাতায় ১০ রুপি কিন্তু কম না, একবেলা খাবার হয়ে যায়।
তারপর দ্বিতীয় রাজপুত্রের পালা। তিনিও তার স্ক্যাচ কার্ডের কালো অংশ ঘসে ঘসে তুললেন। দেখা গেল তিনিও ১০ রুপি ছাড় পেয়েছেন। তবে প্রথমজনের মতো অতো খুশি হলেন না তিনি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন কার্ড ঘসে তিনি প্রথমজনকে টেক্কা দেবেন।
এবার আমার পালা। আমি হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম দোকানের মালিক, তিনজন কর্মচারী আর রাজপুত্র দুজন আমার দিকে খুবই কৌতুহলভরে তাকিয়ে আছে। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। একটা স্বাভাবিক বিষয়কে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে দেখার কি আছে! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর যা হয় হোক ভেবে ঘসা দিলাম স্ক্যাচ কার্ডে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি ৩০ রুপি ছাড় পেয়েছি। দোকানদার নিজেও অবাক। কারণ সে ভাবতেই পারেনি যে প্রতি কুপনে ১০ রুপির বেশি ছাড় থাকতে পারে, কারণ দোকান মালিক সমিতি থেকে সে মোটামুটি এরকমই খবর জানতো। রাজপুত্র দুজন ছুটে এলো আমার দিকে। অভিনন্দন জানাতে নয়, ছোটখাট চড় থাপ্পড় দিতে। তাদের রাগ একারণে যে কেন আমি সবসময় তাদের চাইতে বেশি পাই।
ঢাকাতে যখন কোন ট্যুর ফেয়ার হয়, সবসময় আমি আমি খবর পাই মেলা শেষ হবার পরেরদিন। পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বাণিজ্য পাতায় এই সংক্রান্ত খবরের সারাংশ দেখতে পাই। তবে এবার আমি যেহেতু খুবই সচেতন ছিলাম, এজন্য মেলা শেষ হবার দিনে আমি সেখানে যেতে পেরেছিলাম। ভাগ্যিস পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে এইরকম অনুষ্ঠান হয়। নাহলে আমার মতো লোকেরা জীবনেও এই ধরনের হোটেলের বারান্দায় যাবার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। যাই হোক আমার এক ট্যুর পিপাসু বন্ধু রিয়াজকে রাজি করিয়েছিলাম আমার সাথে সোনারগাঁ হোটেলের ট্যুর ফেয়ারে যাবার জন্য। আসলে আমি তো কখনো এরকম দামী হোটেলে যাইনি, যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তাহলে দুজন থাকলে এই অপমান দুজনের মধ্যে সমান ভাগ হয়ে যাবে।
ভয়ঙ্কর গরমকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নামলাম। বাপরে বাপ কি রোদ। মনে হচ্ছে নিজের ছায়ার মধ্যে নিজের শরীরকে লুকিয়ে ফেলি। কষ্ট মষ্ট করে বন্ধুর এলাকায় কোনরকমে পৌছালাম। কিন্তু রিয়াজের কোন দেখা নেই। রোদের মধ্যে আধা ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি এলেন। আর তারপর ভয়ঙ্কর রোদ আর ট্রাফিক জ্যামের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত দুঘন্টা পর কিভাবে সোনারগাঁ হোটেলে পৌছালাম তা আল্লাহই জানে।
মেলায় প্রবেশ মূল্য ২৫ টাকা। দয়াপরবশ হয়ে রিয়াজ আমার টিকিটের টাকাটাও দিয়ে দিলো। নাম আর মোবাইল নম্বর লিখে টিকিট জমা দিলাম। আর তারপর মেলার ভিতরে ঢুকে গেলাম। বাকী দু ঘণ্টা পুরোই ইতিহাস।
মেলা থেকে যখন বের হয়েছি ততোক্ষণে রিয়াজের খিদে লেগে গেছে। আমারও লেগেছে কিন্তু সেটা একেবারেই প্রকাশ করছি না। তাহলে তো বিল দেবার সময় ভদ্রতা করে আমাকেও শেয়ার করতে হবে! তো রিয়াজ শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাকে টেনে হিচড়ে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে নিয়ে গেল। বাইরে বিরক্তি দেখিয়ে আর ভিতরে চরম উৎফুল্ল হয়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। আমি তো জানি রিয়াজের মন কতোটা দরাজ! গাদাখানেক খাওয়া দাওয়া শেষে যখন বাসায় আসছি সেই বাস ভাড়াটাও রিয়াজ দিয়ে দিলো।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু কিভাবে যেন হলো না। পরদিন দুপুরে আরো ভয়ঙ্কর রোদের মধ্যে হেঁটে আসছি এসময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই বেশ সুললিত কন্ঠে জানলো যে সোনারগাঁ হোটেল থেকে বলছি, আপনি ট্রাভেল ফেয়ার থেকে আমাদের ১৬ নম্বর পুরষ্কারটা পেয়েছেন। আমি ‘ও আচ্ছা’ বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ওই নম্বরে ফোন করলাম। তারা আমাকে আবারো জানালো যে আমি ট্রাভেল ফেয়ার থেকে ১৬ নম্বর পুরস্কার পেয়েছি আর এটা হচ্ছে সোনারগাঁ হোটেলে দুজনের ব্যুফে লাঞ্চ।
একদিন সময় করে আমি আর রিয়াজ বের হলাম টিকিটটা জমা দেবার উদ্দেশ্যে। রিয়াজ বেশ সেজেগুজে বের হয়েছে। বেচারা ভেবেছে সেদিনই বুঝি আমরা সোনারগাঁ হোটেলে বুফে লাঞ্চ করতে যাচ্ছি। যখন তার ভুলটা ভাঙ্গালাম তখন সে খুবই মর্মাহত। সে নাকি বাসায় বলে এসেছে দুপুরে সোনারগাঁ হোটেলে খাবে। বেচারা।
দুজনে অনেক কষ্ট করে রোদের মধ্যে নয়া পল্টন পৌছালাম। না বিএনপির অফিসে না, মনিটর অফিসে। এটি হচ্ছে ট্রাভেল বিষয়ক ইংরেজি পাক্ষিক পত্রিকা। এই পত্রিকাটিই আমাদের পুরষ্কারের স্পন্সর। সেখানে গিয়ে আমার টিকিটটা জমা দিয়ে এলাম। অফিসটা থেকে বের হবার পর রিয়াজ আমাকে একটা হোটেল থেকে ভরপেট বিরিয়ানি খাওয়ালো।
মাঝে বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে গেছে, রোদের তীব্রতা আরো বেড়ে চলেছে। আর আমি সবকিছু বেমালুম ভুলে গেছি। হঠাত একটা এসএমএস পেলাম সোনারগাঁ হোটেল থেকে। তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে একটা থ্রী স্টার হোটেলে পুরষ্কারটা আনার জন্য। আমি তো ভাবলাম এটাই বুঝি নিমন্ত্রণ। আর আমার নানী তো দেখি আমার চাইতেও বেশি খুশি। তার নিশ্চিত ধারণা এই হোটেলে গেলে যে খাবার দেবে সেখান থেকে আমি টুকটাক খাবার আমার পকেটে করে নিয়ে আসতে পারবো। তারপর সে আমাকে বোঝাতে লাগলো ঠিক কি কি পক্রিয়ায় আমি টুকটাক খাবার আমার পকেটে করে সরিয়ে আনতে পারি।
নির্দিষ্ট দিনে বেশ পরিপাটি সেজে গেলাম গুলশানের বেঙ্গল ইন হোটেলে। দেখি আজ পুরস্কার বিতরণ করা হবে। বিভিন্ন কোম্পানি যারা এই পুরষ্কারগুলোর স্পন্সর করেছে তাদের হোমড়া চোমড়ারা উপস্থিত। আর আছে ১৭ জন ভাগ্যাবান যারা এই পুরস্কারগুলো জিতেছে। প্রথমেই সভাপতি বক্তব্য দিলেন। তার ধারণা আমরা খুবই ভাগ্যবান, কারণ আমরা সেই ১৪,০০০ দর্শনার্থীর মধ্যের বিশেষ ১৭ জন। কারণ আমরাই পুরস্কার জিতেছি।
কিছুক্ষণ পর পুরস্কার বিতরণ শুরু হলো। প্রথমে শুরু হলো স্বান্তনা পুরস্কার থেকে, ১৫, ১৬, ১৭ নম্বরগুলোকে এর বেশি আর কিই বা বলতে পারি! আমি পেলাম ২য় স্বান্তনা পুরস্কার। আমার পুরস্কার দিলেন সোনারগাঁ হোটেলের সিইও না কি যেন বলে তিনি। বেশ হাসি হাসি মুখে আমার পুরস্কারটা নিলাম। তারপর আমার জায়গায় এসে বসে পড়লাম। বাকী সময়টা বেশ বিরক্তিকর। অন্যরা পুরস্কার নিচ্ছে আর আমি হাতে তালি দিচ্ছি।
যখন ৩য় পুরস্কারের এনাউন্স করা হলো তখন আমার শরীরের ভিতরে কেমন যেন করে উঠলো। আমি ঠিক বুঝিনি যে আমার মনে এতো হিংসা আর ঈর্ষা মজুদ আছে। রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলো আমার শরীর। এই পুরস্কারটা ছিলো ঢাকা ইয়াঙ্গুন ঢাকা এয়ার টিকিট। পুরস্কার প্রাপ্ত ছেলেটা যখন তার পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলো তখন আমার মনে হলো ছেলেটারে কামড়ে দিয়ে আসি।
স্বপ্নটা আমি মনের মধ্যে অনেকদিন থেকেই পুষে রেখেছিলাম। একটা উপন্যাস পড়েছিলাম অনেক আগে। উপন্যাসটার নায়ক থাকে একটা ১২/ ১৩ বছরের ছেলে। আমি যখন সেটা পড়ি আমিও ঠিক সেই বয়সী ছিলাম, তাই সেটার সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েছিলাম। গল্পের একটা বিষয় থাকে এরকম যে, ছেলেটার বড় চাচী রেঙ্গুন শহরে থাকে। যেটি এই মহাদেশের সবচেয়ে বেশি নারী অধিকার সম্বলিত দেশের সবচেয়ে বড় শহর। তার চাচী কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়ে, শাড়ির আচল থাকে ছোট, খোপায় ফুলের মালা জড়িয়ে আর রঙিন বার্মিজ ছাতি হাতে নিয়ে রোজ বিকালে ঘুরতে বের হয়। তো এই দৃশ্যটা আমার মনে সেই ছোটবেলাতেই গেথে গেছে। এজন্যই আমার খুবই মায়ানমার যাবার শখ। আমি জানি সেখানে কোন বাঙালি রমনীকেই আমি ছোট আঁচলের কুঁচি দিয়ে পড়া শাড়ি, খোপায় গোঁজা ফুল আর রঙিন বার্মিজ ছাতি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখবো না, কিন্তু সত্যিই তেমন কিছু আছে কিনা শুধুমাত্র তা খোজার জন্য মায়ানমার যাবো।
৩য় পুরস্কার ঢাকা ইয়াঙ্গুন ঢাকা এয়ার টিকিট পেল যে ছেলেটা আমি নিশ্চিত তার এরকম কোন স্বপ্ন নেই। সে যদি কখনো মায়ানমার যায়ও তাহলে বোধহয় তার মূল লক্ষ্য থাকবে লাল পানি আর নীল নারীর দিকে। হায় আফসোস! কেন সবসময় এরকম হয়!
পুরস্কার বিতরণি অনুষ্ঠান শেষে টুকটাক খাওয়া দাওয়াও হলো। তবে আমি আমার নানীর আদেশ মতো কর্ম করতে সমর্থ হলাম না। কারণ চারপাশে এতো সিসি ক্যামেরা!
যাই হোক, কুপনটা আমার কাছে। এই বছরে যে কোনদিন গিয়ে খেয়ে আসতে পারি। তবে ব্যাপারটা আমি রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে চাই, এজন্য মেয়াদের একেবারে শেষ দিন যাবো খেতে। বাংলাদেশের প্রথম এই পাঁচ তারকা হোটেলের অন্দরমহলে ঢোকার জন্য আমি বেশ উদ্রগ্রীব হয়ে আছি। তবে মজাটা অন্যখানে। যে মেলার টিকিটটা পর্যন্ত আমি নিজের পয়সায় কিনিনি, সেটার বদৌলতে অলরেডী আমার তিনদিন খাওয়া হয়ে গেছে। আর মূল খাবারটা এখনো বাকী।
লেখাটা লিখতে লিখতে আরেকটা সুখবর পেলাম। যদি ব্যাপারটা সত্যি হয় তবে অবশ্যই আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৯