আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলি
২৫শে সেপ্টেম্বর’১৫
রাত তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে বসে আছি। প্রচন্ড ঠান্ডা। টয়লেটে যাবার সাহস করে উঠতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় টয়লেট পর্যন্ত গেলাম। কল খুলে দেখি পানি তো নয় বরফ বের হচ্ছে। গোসল তো দূরে থাকুক হাতমুখ কিভাবে ধোব তাই বুঝে উঠতে পারছি না। কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে দৌড়ে এলাম ঘরে। দুটো মোটা উলের পাজামা তার উপরে প্যান্ট আর গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি তার উপরে টি শার্ট তার উপরে শার্ট তার উপরে চামড়ার জ্যাকেট আর তার উলের একটা জ্যাকেট পড়ে কোনরকমে ঠান্ডা ঠেকালাম। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে বাইরে বের হলাম। সব ভারী কাপড় বের করে নেয়ার জন্য আমার ব্যাগ একেবারে হালকা হয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাচটা বাজে।
রুমে তালা দিয়ে চাবি দিতে গেলাম অফিসরুমে। কিন্তু দেখি অফিসরুম বন্ধ। হোটেলের কর্মচারী বোধহয় টিভি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে এখন ঘুমাচ্ছে। আশেপাশে কোথাও কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। শেষ পর্যন্ত আমার রুমের তালার সাথে চাবি ঝুলিয়ে রেখে বের হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস সদর দরজা খোলা ছিলো। নিউ বাসস্ট্যান্ডে এসে সেখানকার কল থেকে দু বোতল পানি ভরে দুটো স্যালাইন গুলিয়ে নিলাম। এই স্যালাইন আমাকে সারাদিনে প্রচন্ড উপকার করেছিলো। এরপর হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
গিয়ে দেখি ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের সব কিছু বন্ধ। কোন দোকান খোলেনি। একটা দোকানের বারান্দায় বসে বাংলাদেশ থেকে আনা গজা চিবাতে লাগলাম। এক মহিলা এসে দোকান খোলা শুরু করলো। সে দোকান থেকে একটা চেয়ার এনে বসতে দিলো আমাকে। আমি পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে আশেপাশের পাহাড়গুলো দেখছি। কিছুক্ষণ পর সূর্য ওঠা শুরু হলো। আর সূর্যের আলোগুলো গিয়ে পড়লো বরফের চূড়াগূলোর উপরে। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশগুলো ঝলসে উঠলো। আর আমি পুরোপুরি থ হয়ে গেলাম। দার্জিলিঙয়ের টাইগার হিলে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর প্রচন্ড কুয়াশার কারণে সূর্যের আলো পড়ার দৃশ্য দেখতে না পারার আফসোস এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। কিলংয়ের সূর্য তখন এক পাহাড়কে ডিঙ্গিয়ে অন্য পাহাড়ের উপর আছড়ে পড়া শুরু করেছে। আর অন্যদিকের পাহাড়গুলো তখন পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন। আশেপাশের সৌন্দরয্যের রুপ তখন ঝলসে উঠছে। আমি একেবারেই চোখ ফেরাতে পারছি না। এখানকার মানুষগুলো কি ভাগ্যবান! প্রতিদিন এরকম রোদ পাহাড়ের খেলা দেখে তাদের দিন শুরু হয়।
বোধহয় হা করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। কারণ এদিকে কখন যে ওল্ড বাসস্ট্যান্ড জমজমাট হয়ে গেছে আমি একেবারেই টের পায়নি। দোকানগুলোও সব খোলা শুরু করেছে। দু-য়েকটা বাস বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া শুরু করেছে। বাজারের সব লোক এসে আমার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। আসলে গতকাল আমি এতোবার পুরো ওল্ড বাসস্ট্যান্ডটা চক্কর মেরেছি যে তারা একই সাথে আমাকে চিনে গেছে আর আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জেনে গেছে। তারা সবাই আমাকে আশ্বস্ত করলো যে নিশ্চয় লেহ যাবার একটা না একটা উপায় হয়েই যাবে।
একসময় মানালির দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আসা শুরু হলো। এবং আমি প্রচন্ড বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে পুরো ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের সমস্ত লোক আমার জন্য লেহ যাবার গাড়ি খুজতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেছে। শরীরের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। পাহাড়ের মানুষগুলো এতো ভালো হয় কিভাবে। আমি বান্দরবানের পাহাড়িদেরও একই কান্ড দেখেছি। অথচ পাহাড়িরা সবসময়ই সবদিক দিয়ে বঞ্চিত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় পাকিস্তানি জানোয়াররা আমাদের সাথে যেমন আচরণ করতো আমরা বাঙ্গালিরা এখন একই আচরণ আমাদের দেশের পাহাড়িদের সাথে করছি না তো!
যাই হোক কিছুক্ষণের মধ্যে JK10 নম্বর প্লেটের একটা ট্রাক এলো। ট্রাক মানে বড় লরি। আমি সেটাতে উঠতে যেতে চাইলে সবাই একসাথে নিষেধ করলো। কারণ এইসব ট্রাকগুলোতে গেলে আমাকে আর্মি চেকপোস্ট গুলোতে খুব সমস্যার মুখে পড়তে হবে। তার উপর আমি আবার বাংলাদেশী। ইন্ডিয়ান আর্মিরা অন্যান্য দেশের পর্যটকদের মতো বাংলাদেশী পর্যটকদের মূল্যায়ন করে না। বরঞ্চ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। তার উপর আমি আবার একা। একা কোন বাংলাদেশী এই এলাকায় বেড়াতে আসে না। এসবের জন্য আমাকে অনেক বেশি প্রশ্ন বা ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে। আর এই ট্রাকগুলোও খুব আস্তে আস্তে চলে। কিলং থেকে লেহ পর্যন্ত ৩৮০ কিঃমিঃ যেতে এই ট্রাকগুলোর এক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। অগত্যা কি আর করবো। চেয়ারে বসে অন্য কোন ধরণের গাড়ি আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আজ পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। এবং আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমার জন্য একটা ঈদ উপহার পাঠিয়ে দিলেন। JK10 নম্বর প্লেটের একটা জীপ মানালির দিক দিয়ে আসছিল। বাজারের সবাই মিলে সেটাকে থামালো। একদম ফাঁকা একটা গাড়ি, শুধু হাসিমুখের একা ড্রাইভার, আর গাড়িতে কোরআন তেলওয়াতের ক্যাসেট বাজছে। গাড়ীটি লেহতে যাচ্ছে।
ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের সব লোককে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা আর ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। পিছনের সিটে ব্যাগ রেখে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া জিজ্ঞাসা করায় সে বললো ওয়ান ফাইভ হানড্রেড। গাড়ি চলা শুরু করলো। পিছনে ফিরে ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের দিকে একবার তাকালাম। এখানকার লোকগুলো আমার স্মৃতিতে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। এটা কি আমি কখনো ভুলতে পারবো যে আমাকে বিদায় জানাতে পুরো একটা বাজারের সব মানুষেরা হাজির হয়েছিলো।
ড্রাইভারকে আমার পরিচয় দিলাম। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে প্রথমেই কথা হলো ক্রিকেট নিয়ে। কাশ্মীরের লোকেরা ক্রীকেট বলতে একেবারেই পাগল। তাদের সবচেয়ে প্রিয় টিম হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে তারা সাকিব-আল-হাসানের অন্ধ ভক্ত। ড্রাইভারটি সাকিব আল হাসানকে এতোটা পছন্দ করেন যে কিছুদিন আগে ভূমিষ্ট হওয়া তার ভাইপোর নাম রেখেছেন সাকিব আল হাসান। আমি পুরোপুরি চমকে উঠলাম।
এবার ড্রাইভার তার পরিচয় দিলেন। তার নাম আলী। তিনি একজন লাদাখি শিয়া মুসলমান। আলী ভাই ইন্ডিয়ান আর্মির একজন কর্পোরাল। এখন তিনি এক মাসের ছুটিতে আছেন। এই গাড়িটা তার নিজের। একজনকে লেহ থেকে মানালিতে পৌছে দিতে তিনি বের হয়েছিলেন। রাস্তায় তাকে দুরাত বরফে আটকে থাকতে হয়েছিলো। অবশেষে কাল সন্ধ্যায় তিনি মানালিতে পৌছান। রাত্রে তিনি মানালি শহরের বাইরে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়েছিলেন। কারণ মানালি শহরে অন্য অঞ্চলের গাড়ি ঢুকতে গেলে ট্যাক্স দিতে হয়। ভোর তিনটার দিকে তিনি মানালি থেকে লেহ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। সকাল সাড়ে সাতটায় কিলং এ আমার সাথে তার মোলাকাত হয়েছে।
হায়রে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে করতে শেষে নিজে যেচে এসে ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়িতেই উঠলাম! কিন্তু উপরওয়ালার মনোভাব নিশ্চয় অন্যরকম ছিলো। নাহলে হিন্দী সিনেমার মতো আমার এরকম অবস্থা হবে কেন! আসলে আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। নাহলে আমি একজন মুসলমানের গাড়িতে উঠলাম কিভাবে। যেখানে আশেপাশের কোন এলাকাতেই কোন মুসলমান নেই। তার উপর সে আবার একজন আর্মি। আর সবচাইতে মজার ব্যাপার সে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের একজন ফ্যান। নিজের একমাত্র সন্তান মেয়ে বলে একমাত্র ভাইপোর নাম রেখেছেন সাকিব আল হাসান।
আর বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হবার কারণে এটি তাদের কাছে খুবই প্রিয়। অবশ্য কাশ্মীরি মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে কারগিল। কারণ সেখানে শতকরা একশো ভাগ লোকই মুসলমান। পাকিস্তান সম্পর্কেও তার ধারণা নেতিবাচক। অবশ্য এ ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুব সাবধানে প্রায় কূটনৈতিকের মতো কথা বললেন। তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কৌতূহল প্রচুর। বিশেষ করে ক্রিকেট টিম সম্পর্কে। বাংলাদেশ বেড়াতে যাবারও ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু সে সন্দিহান একজন মুসলমান আর্মি হবার কারণে ভারত আর বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশি ভিসা দেবে কিনা। এসব শোনার পর মানুষ হিসাবে আমি তাকে খুবই পছন্দ করে ফেললাম। যে বিদেশী লোকটা বাংলাদেশ পছন্দ করে, তাকে পছন্দ না করে পারা যায়!
এ-কয়দিন আমি হুক্কাহুয়া টাইপের হিন্দী জানতাম। কিন্তু সারাদিন আলী ভাইয়ের সাথে প্রচুর বকবক করে দিন শেষে আমার হিন্দীর প্রচুর উন্নতি হয়েছিল। যাই হোক সে মুসলমান শুনে ঈদের উছিলায় তার গায়ে আতর মাখিয়ে দিলাম। আতরটা আমি এনেছিলাম আমার খুব প্রিয় সহজ সরল এবং ধর্মপ্রাণ বন্ধু আশিকের কাছ থেকে। কারণ আমি শুনেছিলাম ইন্ডিয়ান ট্রেনে অনেকে জুতা পড়ে ওঠে। আর সেসব জুতো খুললে তাদের মোজা থেকে বিকট দুর্গন্ধ আসে। সেই দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য আতরটা এনেছিলাম। অবশ্য আমি ইন্ডিয়ান ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের কাউকে জুতা পড়ে উঠতে দেখিনি, তবে এসি ক্লাসের বেশিরভাগ যাত্রীর পায়েই জুতা ছিলো।
এমনিতেও আতরের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে। খেজুর খুব এনারজেটিক খাদ্য, আমার ছোট মামা আমাকে এমন এনফরমেশন দেয়ায় আমার বাবা দেশ থেকে আসার আগে আমাকে গাদাখানেক গজার সাথে গাদাখানেক খেজুরও কিনে দিয়েছিল। সেগুলোও দিলাম আলী ভাইকে। আমার মোবাইলে কাজী নজরুল ইসলামের ‘হে মদীনাবাসী’ গানটি ছিলো। এই গানটি আমার খুবই প্রিয়। খুব জোরে চালিয়ে দিলাম সেটা। আর তারপর সেটার মানে বুঝিয়ে দিতে লাগলাম আলী ভাইকে। সেটা শেষ হলে আমাদের প্রিয় মসজিদের শহর ঢাকার গল্প শুনাতে লাগলাম তাকে। যে শহরের বেশির ভাগ অধিবাসীই মুসলমান আর কিছুদূর পরপরই মসজিদ। আলী ভাই একজন মুসলমান হিসাবে আমার মতো একজন নামধারী মুসলমানকে খুব সহজেই আপন করে নিলেন। তিনি নাকি বিদেশি মিশনে থাকার সময় একবার পবিত্র হজ্জ্ব পালন করে এসেছেন। কিন্তু হায় আফসোস, আমরা দুজনের কেউই সেদিনর ঈদের নামাজ পড়তে সক্ষম হয়নি। কারণ আশেপাশে কোন মসজিদতো দূরে থাকুক এমনকি কোন মুসলমান পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।
এবার একটু জ্ঞান দান করা যাক। কিলং থেকে ৩৮০ কিঃমিঃ দূরের লাদাখ অঞ্চলের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর লেহ যাবার রুটটি হচ্ছেঃ-
কিলং—জিসপা—দারচা—জিনজিগবার—বারলাচালা পাস—ভারতপুর—সারচু—নাক্বিলা পাস—লাচুংলা পাস—প্যাং—তাগলাংলা পাস—মোর প্লেনস—উপসি—সিন্ধু নদ—কারু—লেহ।
এদের উচ্চতাগুলি হচ্ছেঃ-
কিলং ১০,০০০ ফিটের উপরে।
জিসপা ১০,৮৬০ ফিট।
দারচা ১১,০২০ ফিট।
জিনজিগবার ১৪,০১০ ফিট।
বারলাচালা পাস ১৬,৫০০ ফিট।
ভারতপুর ১৬,০০০ ফিটের উপরে।
সারচু ১৪,১০০ ফিট। সারচু থেকেই জম্মু এন্ড কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ অঞ্চলের সীমানা শুরু। এর আগ পর্যন্ত হিমাচল প্রদেশের সীমানা। সারচু হিমাচল প্রদেশ আর কাশ্মীর রাজ্যের সীমান্ত।
সারচু থেকে নাক্বিলা পাস যাবার পথে পড়ে বিখ্যাত গাটা লুপ। এটির উচ্চতা ১৫,৩০২ ফিট।
নাক্বিলা পাস ১৫,৫৪৭ ফিট।
লাচুংলা পাস ১৬,৬১৬ ফিট।
প্যাং ১৫,২৮০ ফিট।
তাগলাংলা পাস ১৭,৫৮২ ফিট। এটি পৃথিবীর ২য় উচু সড়ক।
মোর প্লেনস ১৫,৪০০ ফিট।
লাদাখের রাজধানী লেহ ১১,৪৮৩ ফিট।
*** আমার তথ্যে কিছুটা ভুল থাকতে পারে। তবে পুরো ব্যাপারটি প্রায় এরকমই।
উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়ি চলছে। আমি খুব সংশয়ে ছিলাম যে এতো গুলো দূরগম উঁচু জায়গা দিয়ে আমি চলতে পারবো কিনা। কারণ এতো উঁচু জায়গায় অক্সিজেনের খুবই স্বল্পতা থাকে। তার উপর প্রচন্ড বাতাসের কারণে অক্সিজেন প্রায় থাকে না বললেই চলে। এজন্য অভিযাত্রীরা খুবই কাহিল হয়ে পড়ে। এই রুটে চলাচলকারী পর্যটকরা খুবই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা করে, শ্বাস-প্রশ্বাসে খুবই কষ্ট হয় বিশেষ করে যাদের এয়াজমা আছে তাদের অবস্থা চরমে পৌছে, আর খুবই বমি হয়। সময়মতো ব্যাবস্থা গ্রহন করতে না পারলে কেউ কেউ নাকি মারাও যায়। আর এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু সময় পরপর তরল আর এনারজেটিক খাবার খেতে হয়।
সিমলা থেকে মানালি আসার সময় আমার খুবই শরীর খারাপ করেছিল যেটা সাধারণত কারোরই হয়না। কিন্তু মানালি থেকে লাদাখ যেতে হলে সবাই অবশ্যই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে আমি আশায় বুক বেধেছিলাম, কারণ মানালি থেকে কিলং আসার পথে আমার এতোটুকু পর্যন্ত শরীর খারাপ লাগেনি। তবে আলী ভাই আমার পোশাক-আশাক দেখে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন কিছুক্ষণ পর থেকে বরফের মধ্যে দিয়ে তিন চার ঘন্টা পথ চলতে হবে, তখন মাথার টুপি আর হাতমোজা জরুরী হয়ে পড়বে। অবশ্য তার গাড়িতে কম্বল আছে, প্রয়োজনবোধে আমি সেটা ব্যাবহার করতে পারি।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর গাড়ি জিসপা পার হয়ে দারচা এসে থামলো। ভাগা নদীর উপর দিয়ে মাঝারি সাইজের লোহার একটা ব্রীজ পার হতে হয়। পাশেই বড় আকারের কংক্রিটের ব্রীজ তৈরি হচ্ছে। আশেপাশে বেশ কয়েকটা সাদা চামড়ার ট্যুরিস্ট আর তাদের বহনকারী গাড়ি দেখলাম। বিশাল বিশাল কতগুলো লরীও দেখলাম। এটা বেশ বড় একটা স্টপেজ। এ রুটে চলাচলকারী সব যানবাহন এখানে কিছুক্ষণ থামে। গাড়ি থেকে নেমে আমি নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। আর আলী ভাই ঢুকে পড়লেন তাবুর পাশে বানানো এক অস্থায়ী টয়লেটে। টয়লেট থেকে বের হয়ে পাহাড়ী ঝরণা থেকে প্লাসটিকের পাইপ দিয়ে টেনে নিয়ে আসা বরফ ঠান্ডা পানিতে গোসল শুরু করলেন। আসলে তিনদিন তিনি গোসল করতে পারেননি। তাছাড়া রাত তিনটার দিকে মানালি ছেড়ে বের হয়েছেন। ঠান্ডা পানিতে নিজেকে কিছুটা রিফ্রেশ করে নিলেন। তার গোসল শেষ হলে আমরা খাবার হোটেলে ঢুকলাম সকালের নাস্তা করার জন্য।
একেকটা তাবুর ভিতরে হোটেল। সেই তাবুর মধ্যে ঘুমানোর খাট রয়েছে লেপ তোষক সহ। খাবার খাওয়ার জন্য সামনে টেবিল আর তাবুর এককোনে রান্না বান্না হচ্ছে। টুকটাক মুদিখানার জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। এই দোকানগুলো বছরে চার থেকে পাঁচ মাসের জন্য বসে। তারপর ট্যুরিস্ট চলাচল বন্ধ হলে এরা তাবু গুটিয়ে চলে যায়।
দুজনে পেট ভরে সকালের নাস্তা করলাম। এইসব খাবারের দোকানে দাম অনেক বেশী। আসলে এই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কোন খাবারই সহজলভ্য নয়। সবকিছুই দেড়-দুশো কিঃমিঃ দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হয়। এজন্য দাম অনেক বেশী। বিশেষ করে চায়ের দাম। ভাগ্যিস আমার চায়ের নেশা নেই। এমনকি আমি অতিরিক্ত ঠান্ডার জায়গাতে গিয়েও চা খায়নি। দুজনের খাবার বিল আসলো ১৬০ রুপি। জোর করে বিলটা আমিই দিলাম।
ঘন্টা খানেক বিরতির পর আবার আমরা চলা শুরু করলাম। পেচিয়ে পেচিয়ে রাস্তা উপরে উঠে গেছে। রাস্তা বেশ ভালো। তবে খুব ধুলো উড়ছে। পথের পাশ দিয়ে চিকন পানির পাইপ চলেছে। মাঝে মাঝে ঝরনা। আর সেসব ঝরনার পানি রাস্তা উপছে খাদে প্রবাহিত হচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি শ্রমিকরা রাস্তা মেরামত করছে। অল্প পয়সায় বেশি কাজ করে বলে বেশিরভাগ শ্রমিক বিহার রাজ্য থেকে নিয়ে আসা হয়। বুঝতে পারছি যে বিহারের অধিবাসীরা খুবই গরীব হয়। নাহলে নিজের জায়গা থেকে দেড়-দুহাজার কিঃমিঃ দূরে দুর্গম এই পার্বত্য অঞ্চল যা প্রায় বছরে ১০ মাস বরফ চাপা থাকে সেখানে কাজ করতে আসতো না।
আবহাওয়া বেশ মনোরম। আকাশ ভয়াবহ ঘন নীল। বেশ ঠান্ডা আর প্রখর রোদ। এতো রোদ যে সানগ্লাস ছাড়া এক মিনিটের জন্যও তাকানো যাচ্ছে না। আর প্রকৃতি! সেটি যে এতো সুন্দর যে বর্ণনা করা সম্ভব না। শুধুমাত্র শশরীরে উপস্থিত থেকে অনুভব করতে হয়।
এসময় দেখি সাদা চামড়ার এক বিদেশী বুড়ো পর্যটক একা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাটা নিশ্চয় লাদাখ পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে যাবে। কি সাহস! সাহস না দুঃসাহস! ব্যাটাকে দেখে আমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগলাম!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৯