চারপাশে তুষারের পুরু আস্তরণ। সূর্যের আলো সেই তুষারে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। প্রচন্ড গর্জন করে ছুটে চলা বাতাস আবহাওয়াকে আরো চরমভাবে বিরূপ করে তুলেছে। কোথাও একটা জীবিত প্রাণীর স্পন্দন পর্যন্ত নেই। বরফের সুউচ্চ শৃঙ্গগুলো এই চরম প্রতিকূলতায় তাদের অস্তিত্বের মহিমা জাহিরে ব্যাস্ত। যেন তারা ঘোষণা দিচ্ছে, হে মানব সন্তান, দেখ আমরা কতো বিপুল আর তুমি কতো ক্ষুদ্র! তুমি পারবে না, কিছুতেই তুমি অতিক্রম করতে পারবে না। আমদেরকে অতিক্রম করতে যাবার তোমার এই ধৃষ্টতা ধূলার সাথে মিশিয়ে দেব। তোমার অহঙ্কার ছিন্ন ভিন্ন করে দেব। এতো স্পর্ধা কিসের তোমার? তুমি জানোনা, আমরাই এই বিপুলা পৃথিবীর ভারসম্য রক্ষা করে আছি! আর সামান্য মানুষ হয়ে সেই তুমি আমাদেরকে অতিক্রম করতে চাও!
তীব্র ঠান্ডাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে সে। আজ সকালেই বরফে চাপা পড়ে তার সব সঙ্গী মারা গেছে। কিন্তু প্রচন্ডভাবে আহত অবস্থায় ভাগ্যক্রমে কোনরকমে বেঁচে গেছে সে। ঠান্ডাতে তার পুরো শরীর নীল হয়ে গেছে। প্রচন্ড ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। কয়েক সপ্তাহের দুর্গম পথ চলার ক্লান্তিতে সে সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। সঙ্গী হারানোর মনোবেদনা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। তবুও তার উপরে অর্পিত দায়িত্ত্ব পালনে মনের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে সে। তাকে পালন করতে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্ত্বটুকু। তার হাতে ধরা আছে পবিত্র পুঁতি। এই পুঁতিতে আছে মহামতি বুদ্ধের পবিত্র বানী। বরফের এই সুউচ্চ চূড়াকে অতিক্রম করে পবিত্র পুঁতির এই জ্ঞান নিয়ে যেতে হবে সেইসব লোকের কাছে, যারা এই বাণীর মাধ্যমে নিজের মানব সত্ত্বাকে সঠিকভাবে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারবে।
কয়েক কদম যাবার পর সেও ঢলে পড়লো তার সঙ্গীদের মৃতদেহের পাশে। আশেপাশে ছড়ানো রয়েছে আরো অসংখ্য মৃতদেহ। আর এভাবেই গড়ে উঠলো মৃতদেহের স্তূপ।
আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলি
জায়গাটা ১৩,০৬০ ফিট উঁচু। রোথাং পাসের বাংলা মানে হচ্ছে মৃতদেহের স্তুপ। মানালি থেকে লেহ পর্যন্ত যেতে হলে যে কয়টি ভয়ঙ্কর পাস পার হতে হয় তার মধ্যে সর্বপ্রথমটি হচ্ছে রোথাং পাস। বাস যখন পাহাড়টা পার হচ্ছে তখন দেখলাম চূড়ার শীর্ষে বরফ জমে আছে। এতো কাছ থেকে এতো বরফ দেখা আমার জীবনে এই প্রথম। খুব অল্প পরিমানে ট্যুরিস্ট রয়েছে সেখানে। কিন্তু আফসোস আয়ত্তের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমাকে চলন্ত অবস্থায় শুধুমাত্র বরফের চূড়া দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
রোথাং পাস পার হয়ে বাস নিচের দিকে নামা শুরু করলো। রোথাং পাস পর্যন্ত প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে বলে এ পর্যন্ত রাস্তা ভালো ছিলো। কিন্তু এবার ভয়ঙ্কর রাস্তা শুরু হলো। ভয়ঙ্কর রাস্তা মানে রাস্তায় কোন পিচ তো দূরে থাকুক সলিংও নেই। গ্রামের কাদামাটির মতো রাস্তা। আর তার মাঝ দিয়ে আস্তে আস্তে হেলেদুলে বাস চলেছে। সেই হেলে দুলের পরিমান আরেকটু বেশি হলে বাস যে কতো হাজার ফুট নিচে গিয়ে পড়বে তা আল্লাহই জানে। কিন্তু আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছি। একসময় দেখলাম কয়েক হাজার ফিট নিচে দিয়ে চন্দ্রা নদী বয়ে চলেছে। এতো উপর থেকে নদীটাকে সরু ফিতের মতো লাগছে।
একে একে বিভিন্ন জায়গা পার হলাম। কোথাও কেউ নেই। আসলে এই জায়গাগুলো ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা থাকে। অর্থাৎ টুরিস্ট সিজনে ছ-সাতটা তাবু টাঙ্গিয়ে এই জনপদগুলো গড়ে ওঠে। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে যেহেতু অফ সিজন শুরু হয় এজন্য এই জনপদগুলো বিলীন হয়ে গেছে। আবার আগামী বছর জুন মাসে এগুলো জমজমাট হয়ে উঠবে।
রাস্তা একদম ফাঁকা। মাঝে মাঝে দুয়েকটা আরমির কনভয় অথবা বিশাল বড় বড় ট্রাক চলেছে। এই দুর্গম পেচিয়ে ওঠা রাস্তায় বিশাল বপুর ট্রাকগুলোর চলাচল দেখলে আত্মারাম খাচাছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে যে যেসব জায়গায় পাহাড় ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে বিশাল বিশাল ট্রাক্টর সেসব ধ্বসে পড়া পাথর আর মাটি সরিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য নূন্যতম জায়গা বের করার চেস্টা চালাচ্ছে।
বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বাস খোকশার এসে থামলো। এটি ১০,০০০ফিটেরও উপরের একটি জনপদ। এখানে আবার ২০মিনিটের বিরতি। বাস ততোক্ষণে প্রায় ফাঁকা। সব মিলে আমরা ৬থেকে ৭জন আছি। বাস থামার পর সবাই খাওয়া দাওয়া করার জন্য নামলো। আর আমি দৌড় দিলাম পাশে বয়ে যাওয়া এক ঝরনার দিকে। ঝরনার পাড় ধরে নদী পর্যন্ত গেলাম। দেখলাম সেখানে কতগুলি ঘোড়া চড়ে বেরাচ্ছে।
খোকশার বেশ বড় একটা জনপদ। বড় মানে এখানে ১৫-২০টা আধাপাকা বাড়ি আছে। একটা পুলিশ চেকপোস্টও আছে। আমি অবশ্য এটার ছায়াও মাড়ায়নি।
২০ মিনিট বিরতির পর আবার বাস চলা শুরু করলো। এখানে একটা ব্রীজ পার হতে হয়। কিন্তু বাসটা ব্রীজের গোড়ায় এসে আটকে গেল। কারণ ব্রীজ ধরে হাজার হাজার ভেড়া পার হচ্ছে। বাস থাকে নেমে ব্রীজ জুড়ে নেমে আসা এই ভেড়ার পালের ছবি তুললাম। ১৫মিনিট ধরে ভেড়াগুলোর পার হওয়া শেষ হলে আবার বাসে উঠে বসলাম আর বাস ছেড়ে দিলো।
সবাই তো দোকান থেকে টুকটাক খাবার খেয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই খাইনি। সেই ভোরে ব্রেড অমলেট খেয়েছিলাম। এতোক্ষণ এই পাহাড়ি পথে জার্নি করে কখন সেগুলো হজম হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আমার বাবা আমাকে গাদাখানেক গজা কিনে দিয়েছিল। ব্যাগ থেকে বের করে সেগুলোই চিবাতে লাগলাম। ড্রাইভার, কন্ট্রাকটারসহ আশেপাশের সবাইকে দিলাম। সবাই দেখি খুবই আগ্রহের সাথে বাংলাদেশের গজা চিবাতে লাগলো।
রাস্তা এই জায়গাটায় প্রচন্ড খারাপ। রাস্তার উপর দিয়ে কোমর সমান গভীর পানি প্রবল বেগে ধেয়ে চলেছে। বাস খুব সাবধানে এই এলাকাটা পার হলো।
এরপর আবার রাস্তা ভালো হওয়া শুরু হলো।
খোকশার পার হবার কিছুদূর পর দেখা মেলে ভাগা নদীর। এখানে চন্দ্রা নদীর সাথে ভাগা নদীর মিলন হয়েছে। চন্দ্রা আর ভাগা নদীর সঙ্গমে যে নদীর সৃষ্টি হয়েছে তার নাম হচ্ছে চন্দ্রভাগা নদী। যার হিন্দি নাম হচ্ছে চেনাব।
আমার ক্যামেরার চার্জ তখন শেষ। বাসে চার্জ দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার চারজারের পিন বাসে সেট হলো না। আর আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা শুরু হলো এবার। প্রচন্ড বেগে পাহাড়ি নদী ধেয়ে চলেছে। আর তার পাশ ঘেসে ৫০০/৬০০ ফিট উপর দিয়ে বাস এগিয়ে চলেছে। এক সেঃমিঃ এদিক ওদিক হলেই কর্ম সাবাড়। হায় আফসোস, একটা ছবিও তুলতে পারলাম না। তাই চোখ দিয়ে সব গিলতে লাগলাম।
অবশেষে বেলা দুইটার দিকে কিলং এসে পৌছালাম।
সাড়ে দশহাজার ফিটের চেয়ে বেশি উচ্চতার জনপদ কিলং। এটি হিমাচল প্রদেশের লাহল এন্ড স্পিতি জেলার একটা অংশ। বাস থেকে নামার সময় গেলাম সেই ফিরিঙ্গীটার সাথে কথা বলতে। ভেবেছিলাম এ ব্যাটাও নিশ্চয় লেহ যাবে। কিলং থেকে কিভাবে লেহ যাবে তাই শুনতে চাইলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেও আমার বাংলা মেশানো ইংরেজি বুঝতে পারলো না আর আমিও তার হিব্রু মেশানো ইংরেজি বুঝতে পারলাম না। মাঝখান থেকে বাসের ড্রাইভার আমাদের দুজনের ইংরেজিই বুঝলেন আর আমাদের বোঝালেন যে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখের পর থেকে কোন বাস কিলং থেকে লেহ এর উদ্দ্যেশে যায় না।
যাই হোক বাস থেকে নেমে আমি আমার মতো হাঁটা দিলাম। লেহ যাওয়া না হোক তাহলে আমি মানালি ফিরে যাবো। দরকার হলে অন্য কোথায়ও যেতে পারি। আর মানালি বা অন্য জায়গার বাস সকালে। অতএব আমাকে রাতে কোন হোটেলে থাকতে হবে। কিলং নিউ বাসস্ট্যান্ডে অনেকগুলো হোটেল আছে। তারই একটাতে গিয়ে উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে। হোটেলটির নাম হচ্ছে “KHANDROLING Guest House and Restaurant” গিয়ে দেখলাম দেখলাম হোটেলের একমাত্র কর্মচারী হোটেলের দ্বোতলায় অবস্থিত রেষ্টরেন্ট কাম অফিসটিতে বসে হা করে টিভিতে হিন্দী সিনেমা দেখছে। রুম খালি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই আমার দিকে না তাকিয়ে সে বললো এটাচট বাথরুম ৫৫০রুপি আর কমন বাথরুম ৪৫০রুপি। ভাবলাম এটাচট বাথরুম নিয়ে খামাখা বেশি টাকা কেন দেব। তারচেয়ে কমন বাথরুমের রুমই ভালো। তাকে বললাম, দেখিয়ে মে তো আকেলি হু, এক রাতকে বাত হো, থোরাসা কম নেহি হো সাকতা। টিভির দিকে তাকিয়ে সে ১০০রুপি কমিয়ে দিলো। তারপর রুমের চাবি ধরিয়ে দিয়ে আবার মনোযোগ সহকারে টিভি দেখতে লাগলো। তাকে আবার বললাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, কিলং এ থাকার ব্যাপারে আমার কোন বিধি-নিষেধ আছে কিনা। তা সে আমার কথা খেয়াল করে শুনলই না। আমিও আর চাপাচাপি করলাম না। কি ব্যাপার বাবা শুনে, যদি এই এলাকায় বাংলাদেশী এল্যাও না হয় তাহলে আমি এখন কোথায় যাবো! আর আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত যে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ আছে তা এ ব্যাটা জানেই না। সে টিভি দেখা নিয়ে এতো ব্যাস্ত যে বাধ্য হয়ে আমি নিজেই রেজিস্ট্রার খাতা খুঁজে বের করে নাম এন্ট্রি করলাম। তারপর চাবিতে দেয়া নম্বর দেখে রুম খুঁজে বের করলাম। কমন বাথরুমটাও খুঁজে বের করলাম। কর্মচারীটি তখনও টিভি দেখে যাচ্ছে।
রুমে ঢুকে মনটা বেশ প্রশান্ত হয়ে গেল। কোন আড়ম্বর নেই। কিন্তু আমার ট্যুরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন রুম ছিল এটি।
আমার হোটেলের নীচেই একটা খাবার হোটেল। ঢুকে গেলাম সেখানে। খুব সুন্দরী এক মহিলা আর তার অল্প বয়স্ক স্বামীর দোকান এটি। একটা ঘরে তারা একই সাথে রান্না করছে আর খাবার সারভ করছে। একপাশে আবার মুদিখানার মালপত্রও বিক্রি করছে। জিজ্ঞাসা করলো কি খাবো। দুজন কাস্টমার যা খাচ্ছিল দেখিয়ে দিলাম সেটায় খাবো। নিয়ে আসলো তারা গরম ভাত পালং শাকের তরকারি আর ডাল। গরম মানে খুবই গরম। এই শীত এলাকাগুলোর হোটেলে সবসময় হয় রান্না হয় অথবা খাবার গরম চুলায় বসানো থাকে।
ভাত আরো নেয়া যাবে। সঙ্গে শশা কাচামরিচ আর পেঁয়াজ। এই এলাকাগুলোতে কাচামরিচকে মিরচি আর লবণকে নিমক বলে। টেবিলে ছিল দুরকমের সস আর লবণ। সবকিছু মিলিয়ে দাম মাত্র ৬০ রুপি। খুব তৃপ্তি সহকারে খেলাম।
বিল দেবার সময় মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কিলং থেকে কিভাবে লেহ যেতে পারি। মহিলাটি আমাকে কিলং ওল্ড বাসস্ট্যান্ডে যোগাযোগ করতে বললো। কারণ সেখান থেকে ট্যাক্সি মিলতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৫