আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলি
২৪শে সেপ্টেম্বর’১৫
ভোর পাচটায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে গোসল করে নিলাম, অবশ্যই ঠান্ডা পানি দিয়ে। কারণ শরীরে একবার গরম পানি ঢালা শুরু করলে তা থেকে বের হয়ে আসা খুবই মুশকিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি তখনো সূর্য ওঠেনি আর বাইরে কোন লোকজনও নেই। খুবই ঠান্ডা , শরীরে দুটো সোয়েটার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কয়েকবার পুরো ম্যাল চত্ত্বর চক্কর দিলাম। মানালিতে সবুজের পরিমাণ অনেক বেশি। তারপরও আমার কাছে মনে হচ্ছে মানালির চেয়ে সিমলা অনেক বেশি সুন্দর ছিল।
প্রচন্ড গর্জন শুনে ছুটে গেলাম সে ধারার দিকে। মানালির বিপাশা দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর। সাদা পাহাড়ের পানি সবুজ পাহাড়কে ডিঙিয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে চলেছে। আর তার গর্জনে কান পাতা দায়।
কিছুক্ষণ বিপাশার খেলা দেখে চললাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ভাবলাম লাদাখের রাজধানী লেহ যাবার খোজখবর নিয়ে মানালির অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে দেখব। বিশেষ করে হিড়িম্বা দেবির মন্দিরটা দেখার আমার খুবই ইচ্ছা।
ম্যালের সঙ্গেই বাসস্ট্যান্ড। এখানেও দেখি যাত্রীদের জন্য ভালো ব্যাবস্থা। এমনকি লাগেজপত্র জমা রাখার জন্য ক্লক রুমও আছে। তো সেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আমার মাথায় বাজ পড়লো। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখের পর থেকে নাকি মানালি থেকে লেহ যাবার সব বাস বন্ধ হয়ে যায়। তখন নাকি লেহ যাবার উপায় হচ্ছে মানালি থেকে চণ্ডীগড় গিয়ে সেখান থেকে প্লেনে করে লেহ যাওয়া।
আমি একজন গরিব মানুষ। আমি কিভাবে প্লেনে উঠবো! তাছাড়া কষ্ট মষ্ট করে প্লেনে উঠলেওতো আশেপাশের কিছু দেখা যাবে না। আমার তো লেহ শহর দেখার ইচ্ছা নেই। আমার ইচ্ছা মানালি থেকে লেহ যাবার পথটা দেখার। কিন্তু এখন সেটি সম্ভব নয় শুনে খুবই মন খারাপ হয়ে গেল।
আল্লাহর উপর ভরসা করে আশেপাশে খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। উপরওয়ালার অসীম করুনায় জানতে পারলাম কিছুক্ষণের মধ্যে কিলং এর উদ্দেশ্যে একটা লোকাল বাস ছেড়ে যাবে। কিলং হচ্ছে লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে যাবার পথে পড়ে লাহুল এন্ড স্পিতি জেলার ছোট্ট একটা শহর। ভাবলাম লেহ পর্যন্ত যেহেতু যাওয়া হচ্ছে না, তাহলে তার অর্ধেক পথ কিলং থেকেই ঘুরে আসি।
দৌড়ে গেলাম নাস্তা করতে ম্যালের দিকে। দুটো ডিমের অমলেট আর চার পিস পাউরুটি। গরম গরম খাবারটা অমৃত মনে হল। খেয়ে হোটেলের রুমে ফিরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে আবার দৌড় দিলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি তখনো কিলং এর বাস আসেনি।
মানালির বাসস্ট্যান্ড খুবই ছোট। খুবই খারাপ লাগছে যে মানালির কিছুই দেখা হলো না। আসলে সেতুদের জন্য সিমলাতে আমার পুরো একটা দিন নষ্ট হয়ে গেছে। সিমলাতেও আমি ঠিকমতো কিছু দেখতে পারিনি আবার মানালিতেও কিছু দেখা হলো না। একটা দিন এখানে স্টে করতে পারলে আমি পুরো মানালি কভার করতে পারতাম। তবে বেশি খারাপ লাগছে কাল রাতে মানালির মিষ্টি খায়নি বলে। এখন এই সকালে কোথাও সেই মিষ্টি খুঁজে পেলাম না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কিলং এর বাস চলে এলো। আমি ঝাপিয়ে আগে উঠে পড়লাম। বাসের বাম সারিতে দুটো করে আর ডান সারিতে তিনটে করে সিট। এতো ভালো লোকাল বাস আমি জীবনেও দেখিনি। আমাদের ঢাকার লোকাল বাসের কথা ভেবে প্রায় কান্না চলে এলো। আস্তে আস্তে দু-চারজন যাত্রী এলো। তাদের মধ্যে গেরুয়া পোশাক পড়া বৌদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। দেখলাম এক সাদা চামড়ার ফিরিঙ্গিও উঠলো। তার বিশাল ব্যাগপ্যাক আমার পায়ের কাছে রেখে পিছনের সিটে গিয়ে বসলো। তার এই ব্যাগপ্যাক দেখে আমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগলাম!
আমি কিন্তু আগেই বাসে উঠে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়েছি। একদম সামনের সিটটা অবশ্য কন্ট্রাকটারের। তার পিছনের দুই সিটে আমি একা। আমার বামপাশে জানালা আর সামনে বাসের সামনের বিশাল কাঁচ। মনে হচ্ছে আমি 3D সিনেমা দেখছি।
ঠিক সাড়ে সাতটায় বাস ছেড়ে দিলো। বাস তখন অর্ধেকও ভরেনি। কন্ট্রাকটার বাসের দরজা বন্ধ করে বাঁশি বাজালো আর ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। বাস প্রথমেই বিপাশা নদী পার হলো আর তারপর ছুটে চললো বরফের পাহাড়গুলোর দিকে। কন্ট্রাকটার এসে ছোট হাত মেশিন থেকে টিকিট বের করে দিল আর আমিও ভাড়া চুকিয়ে দিলাম। টিকিটে ছাপানো অক্ষরে লেখা রয়েছে মানালি থেকে কিলং এর দূরত্ব ১১৫কিঃমিঃ, ভাড়া ১৭০ রুপি।
এবার কিছু জ্ঞান দান করা যাক। মানালি থেকে কিলং যাবার রুটটি হচ্ছেঃ-
মানালি—মারি—রোথাং পাস—গ্রামফু—খোকশার—শিশু—টান্ডি—কিলং।
এদের উচ্চতাগুলি হচ্ছেঃ-
মানালি ৬,৪০০ফিট
মারি ১০,৮০০ফিট
রোথাং পাস ১৩,০৬০ফিট
গ্রামফু ১০,৫০০ফিট
খোকশার ১০,২৭০ফিট
শিশু ৮,৪৩০ফিট
টান্ডি ১০,১০০ফিট
কিলং ১০,০০০ফিটের উপরে।
*** আমার তথ্যে কিছুটা ভুল থাকতে পারে। তবে মোটামুটি উচ্চতাগুলি এরকমই। বরফের কারণে কিছুটা কমবেশি হয়।
বাস চলা শুরুর কিছুক্ষণ পর আমি যেন মারা গেলাম। ও আল্লাহ! এত্তো সুন্দর জায়গা! গাদা গাদা পাহাড়ি ঝরনা আর প্রত্যেক বাড়িতে আপেল গাছ। গাছে গাছে লাল টসটসে আপেল ধরে আছে।
পাহাড়ি ঝরনার পরিমান এতো বেশি যে আমার মনে হচ্ছে প্রত্যেক বাড়িতে কমপক্ষে একটি করে প্রাইভেট পাহাড়ি ঝরনা আছে।
পাহাড়ের গা পেচিয়ে পেচিয়ে রাস্তা চলে গেছে। বাস সেই রাস্তা ধরে উঠে চলেছে। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। তার মাঝে ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ইয়ক দেখতে পেলাম।
বরফের চুড়াগুলো যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর আকাশটা ভয়ঙ্কর ঘন নীল।
মাঝে মাঝে দেখছি রাস্তায় ধ্বস নেমেছে। খুব সাবধানে বাস সেখানে পার হচ্ছে।
সোয়া আটটার দিকে দেখি সোলং ভ্যালিতে যাবার রাস্তা। সেদিকে না গিয়ে বাসটা ডানদিকে রোথাং পাসের দিকে ঘুরে গেল।
যতোই সামনে যাচ্ছে অপরুপ দৃশ্যের পরিমান ততোই বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করছে।
ঠিক নটার দিকে বাস পাচ-ছটা দোকান আছে এমন জায়গায় এসে থামলো। এখানে বিশ মিনিটের জন্য বিরতি। এটি রোথাং পাসের নিচের অংশ।
বাস থেকে নেমে দেখি ভয়ঙ্কর বাতাসে প্রায় উড়ে যাচ্ছি। আশেপাশে যে কয়টা দোকান আছে সবগুলিই খাবারের দোকান। আর সেগুলোতে সব সাদা চামড়ার ট্যুরিস্টে ভরা। পাশেই দেখি একটা মন্দির। উঠে পড়লাম সেটাতে। মন্দিরটিতে দেখি লাল হলুদ নীল সবুজ সহ বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট কাপড় ঝুলানো রয়েছে। কোনরকমে কয়েকটা ছবি তুলে দৌড়ে বাসে উঠে পড়লাম। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা বাতাসে বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। অথচ কি ঝকঝকে রোদ চারিদিকে। বাসে বসেই সবকিছু দেখছি। সব ট্যুরিস্টরা জীপ গাড়ি রিজার্ভ করে এসেছে। খাবারের দোকানগুলিতে দেখলাম টয়লেটের ভালো ব্যাবস্থা রয়েছে, এবং অবশ্যই তা ঐ দোকানের কাস্টমারের জন্য বরাদ্দ।
২০মিনিট বিরতির পর বাস আবার চলা শুরু করলো। পেচিয়ে পেচিয়ে উঠে যাওয়া পথ বেয়ে রোথাং পাসে পৌছালো।
জায়গাটা ১৩,০৬০ ফিট উঁচু। রোথাং পাসের বাংলা মানে হচ্ছে মৃতদেহের স্তুপ। মানালি থেকে লেহ পর্যন্ত যেতে হলে যে কয়টি ভয়ঙ্কর পাস পার হতে হয় তার মধ্যে সর্বপ্রথমটি হচ্ছে রোথাং পাস। বাস যখন পাহাড়টা পার হচ্ছে তখন দেখলাম চূড়ার শীর্ষে বরফ জমে আছে। এতো কাছ থেকে এতো বরফ দেখা আমার জীবনে এই প্রথম। খুব অল্প পরিমানে ট্যুরিস্ট রয়েছে সেখানে। কিন্তু আফসোস আয়ত্তের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমাকে চলন্ত অবস্থায় শুধুমাত্র বরফের চূড়া দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
এই পোস্টে ছবি বেশি হয়ে গেছে। আপনারা কেউ বিরক্তি প্রকাশ করলে পরের পর্ব থেকে ছবি কম দেব।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৮