অন্য পর্ব
কাউন্টার থেকে একটা ফরম নিয়ে তা পূরণ করতে বসলাম। ভাগ্যিস আমি একটা কলম নিয়ে গিয়েছিলাম। ফরমটিতে নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা, জাতীয়তা, কোন ট্রেনে ও ট্রেনের কোন শ্রেণীতে ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক, ট্রেনের নম্বর, প্রারম্ভিক ও সমাপ্তি স্টেশন ইত্যাদি তথ্য ইংরেজিতে পুরণ করতে হয়। আমার ইচ্ছা ছিল সেদিনের ট্রেনেই রওনা দেবার। কারণ একদিনও কলকাতায় থাকতে গেলে অযথা কিছু টাকা খরচ হবে। আমার গন্তব্য ছিল কালকা মেল ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশন থেকে কালকা যাওয়া।
এটি ভারতের প্রথম দুরপাল্লার আন্তঃনগর ট্রেন। ১৮৬৬ সাল থেকে এটি চলাচল করছে। ট্রেনটির নম্বর হচ্ছে ১২৩১১। ফরমের সবকিছু পূরণ করে বসে রইলাম। ঘরটিতে দেখি দু’য়েকটা সাদা চামড়া আর বাকি সব বাংলাদেশী যাত্রী। আর এই বাংলাদেশী যাত্রীদের মধ্যে হুজুর শ্রেণীর লোকের সংখ্যা বেশি। যারা দিল্লীর বিভিন্ন মসজিদে যাবে। বসে বসে তাদের সাথে গল্প শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক পরে আমার পালা এলো।
গিয়ে বসলাম কাউন্টারের সামনে রাখা চেয়ারে। ফরম জমা দেবার পর লোকটা কম্পিউটারে চাপাচাপি শুরু করলো। আল্লাহর রহমতে সেদিন সন্ধ্যার কালকা মেলের বিদেশীদের সিট খালি ছিলো। তবে সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। হোটেলের ঠিকানা না দিলে টিকিট দেবার নিয়ম নেই।
কিন্তু আমি যেহেতু ঘন্টাখানেক আগে কলকাতায় এসেছি আর সন্ধ্যার ট্রেনেই কালকা যেতে চাই একথা শুনে ভদ্রলোক আমার জন্য ব্যাবস্থা করে দিলেন। আর এই ব্যাবস্থা করার জন্য তাকে ২০ রুপি উপঢৌকন দিতে হলো। ভারতের একটা আন্তর্জাতিক অফিসের রেলের অফিসার আমার কাছ থেকে ২৫ টাকা ( ২০ রুপি ) ঘুষ নিলো। ছিঃ ঘেন্না! এর চাইতে যদি ২০০রুপিও চাইতো তবু আমি খুশি হতাম।
হাওড়া থেকে হরিয়ানা প্রদেশের শহর কালকা পর্যন্ত ১,৭১৩ কিঃমিঃ দূরত্বের ৩৪ ঘন্টার কালকা মেইলের স্লীপার ক্লাসের ভাড়া ৬৮০ রুপি। থ্রী-টায়ার এসিতে গেলে এর ভাড়া ১,৮০০রুপি। আমি গরীব মানুষ, আমার জন্য স্লীপারই ভালো। কালকা যাবার কারণ হচ্ছে কালকা থেকে সিমলা পর্যন্ত ৯৬কিঃমিঃ পাহাড়ি টয় ট্রেন আছে। যেটাতে চড়ার আমার বহুদিনের শখ।
কাউন্টারের লোকটা আমাকে কালকা থেকে সিমলা যাবার কালকা মেইলের সংযুক্ত টয় ট্রেনের টিকিটও কেটে দিতে চাইলো । অর্থাৎ কালকা মেল ট্রেনটি কালকা স্টেশনে পৌছালে এর যাত্রীরা এই টয় ট্রেনে করে সিমলার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। কারণ সংযুক্ত টয় ট্রেনটির সবগুলি সিট চেয়ার। আমার যদি উল্টোমুখ চেয়ারে সিট পড়ে তাহলে কিছুই ঠিকমতো উপভোগ করতে পারবো না। ভাবলাম কালকা স্টেশনে পৌছে যে টয় ট্রেনের বেঞ্চওয়ালা সিট খালি পাবো সেটাতে উঠে পড়বো।
টিকিট সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ড শেষে বের হলাম ফেয়ারলি প্লেস থেকে। তারপর বিবাদি বাগ স্টেশন পার হয়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে হাওড়া স্টেশনে যাবার ফেরীর টিকিট কাটলাম। একটা ফেরী দাড়িয়ে ছিলো উঠে পড়লাম সেটাতে। কিছুক্ষণের মাঝেই ফেরী চলা শুরু করলো।
একপাশে বিখ্যাত হাওড়া ব্রীজ, আর অন্যপাশে কিছুটা দূরে বিদ্যাসাগর সেতু।
মাঝের জায়গা দিয়ে ফেরী এগিয়ে চলেছে। চলন্ত ফেরীতে বাতাসের ঝাপটা এতো আরামদায়ক যে বলার মতো নয়। তবে সবথেকে ভালো লাগে দূর থেকে হাওড়া স্টেশন দেখতে।
লাল রঙের কতোগুলি বড় বড় ভবনের সমন্বয়ে গঠিত হাওড়া স্টেশন। জানা না থাকলে মনে হবে বিশাল কোন রাজপ্রাসাদ। আমিও প্রথমবার কলকাতায় এসে তাই ভেবেছিলাম।
ফেরী থেকে নেমে মাটির নিচের রাস্তা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করলাম।
ভারতের স্টেশনগুলিতে ক্লকরুম বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে লাগেজ জমা রাখা যায়। আমার ব্যাগটা চালান করে দিলাম সেখানে। ফেরত নেবার সময় লাগেজ জমা রাখার ভাড়া হিসাবে ২০রুপি দিতে হয়েছিলো। ব্যাস এবার ঝাড়া হাত-পা। দৌড়ে গেলাম খাবার ঘরে। ভারতের স্টেশনগুলিতে কম দামে ভালো খাবারের ব্যাবস্থা আছে। জন আহারে ঢুকে রুপি জমা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করে খাবার নেবার লাইনে দাড়ালাম। ৬১রুপিতে দুটো দিম, তরকারি, ডাল আর ভাত খেতে অমৃতসম লাগলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পুরো স্টেশনটা চক্কর দিতে লাগলাম। আমি আগেও যতোবার স্টেশনটিতে এসেছি ততোবার অবাক হয়েছি। এবারো তার ব্যাতিক্রম হলোনা। ২৩টি প্ল্যাটফর্মের বিশাল এই স্টেশনটিতে সবসময় কোন না কোন ট্রেন এসে থামছে। আর তাতে চড়ে আছে গাদা গাদা মানুষ। প্রতিদিন নাকি গড়ে ১২লাখ লোক এই স্টেশন ব্যাবহার করে। স্টেশনটিতে একগাদা টয়লেট আর গোসল করার ব্যাবস্থা আছে। আর রয়েছে হাজার হাজার খাবার পানির কল, যেখানে স্বাভাবিক আর ঠান্ডা দু’রকম পানিই পাওয়া যায়। স্টেশনটিতে কিছুদূর পরপর ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড রয়েছে, যেখানে সকল ট্রেনের আসা যাওয়ার তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। তাছাড়া মাইকে বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দিতে এনাউন্স করছে।
লিফটে করে স্লিপার ক্লাসের ওয়েটিং রুমে এসে বসলাম। দেখি পুরুষেরা সব বড় জাঙ্গিয়া অথবা গামছা পড়ে মেঝেতে ঘুমাচ্ছে অথবা গোসলখানা থেকে বের হচ্ছে। মহিলাদের অবস্থাও তথৈবচ। কেউ কেউ মোবাইলে চার্জ দিচ্ছে। নিজেদের ট্রেনের সময় হলে এরা প্যান্ট পড়ে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ওয়েটিং রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
এই জায়গাটা আমার কাছে অসাধারণ লাগে। স্টেশনের সামনে রাস্তা, তারপর বিশাল নদী যেখানে গাদা গাদা জলযান ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর ওপারে সিটি অফ জয় কলকাতা শহর আর নদীর বুকে কলকাতার স্মারক চিহ্ন হাওড়া ব্রীজ তার বিশাল লোহার পরিকাঠামো নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ ফটোসেশনের পর বের হয়ে এলাম ওয়েটিং রুম থেকে।
স্টেশন থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম হাওড়া ব্রীজের উপর। ব্রীজের দুপাশে হাটার জায়গা। সেখানে দাড়িয়ে কতোগুলি ছবি তুললাম।
তবে জায়গাটা আমার কাছে নিরাপদ লাগলো না। একজন আবার আমার হাতে ক্যামেরা দেখে সাবধানও করলো। তাড়াতাড়ি আবার স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। এক খোলা জায়গায় দেখি ইউরেনাল রাখা আছে আর সবাই সেখানে দাড়িয়ে প্রসাব করছে। ধুতি পড়ে দাড়িয়ে প্রসাব করার ব্যাপারটি যেকোন বাংলাদেশীর কাছেই হাস্যকর। চুপিসারে সেখানেও একটা ছবি তুলে ফেললাম।
এরপর গেলাম তালা কিনতে। ইন্ডিয়ার ট্রেনে নাকি মালপত্র চুরি হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এজন্য শিকল দিয়ে ব্যাগ বেঁধে রাখতে হয়। দরদাম করে শিকল আর তালা কিনলাম। সেখান থেকে গেলাম বালিশ কিনতে। ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের সীট মানে একেক জনের জন্য একটি করে শোবার জায়গা। এসি বগিতে ট্রেন থেকে বালিশ দিলেও স্লিপার ক্লাসে সে ব্যাবস্থা নেই। ফু দিয়ে ফোলানো যায় এমন একটা বালিশ কিনলাম। পরে বালিশটিতে শুয়ে দেখেছি, খুবই আরামদায়ক।
বালিশ কেনা শেষে আবার স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ফেরত এলাম। চুপচাপ বসে রইলাম ঘন্টা দেড়েক। তারপর ক্লক রুম থেকে আমার ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম। তারপর দোকান থেকে পাউরুটি আর মিষ্টি কিনলাম রাতের খাবার হিসাবে। পানির বোতলগুলো ভরে নিলাম।
যেহেতু আজ শনিবার এজন্য হাওড়া থেকে দিল্লী পর্যন্ত যুবকদের জন্য কম খরচের একটা ট্রেন আছে। নাম ইউভা (যুব) এক্সপ্রেস। ট্রেনটি দেখার খুব শখ ছিল। এটি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানো মাত্র ছুটে গেলাম সেটি দেখতে। একেক সারিতে ৬টা করে চাপাচাপি ভাবে চেয়ার বসানো পুরো এসি ট্রেনটি দেখতে খুব সুন্দর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এই ট্রেন থেকে নেমে এসে আমার কালকা মেইলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পৌনে সাতটার দিকে মাইকে কালকা মেইলের আগমন বার্তা ঘোষিত হতে লাগলো। দৌড় লাগালাম নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের দিকে।
খরচঃ১৯শে সেপ্টেম্বর’১৫
১। ট্রাভেল ট্যাক্স=৫০০ টাকা
২। বাংলাদেশ দালাল=১০০ টাকা
মোট=৬০০ টাকা
১। ইন্ডিয়ান দালাল=১০০ রুপি
২। কুলি=৫০ রুপি
৩। ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ=১০ রুপি
৪। বর্ডার থেকে বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত অটো ভাড়া=২৫ রুপি
৫। বনগাঁ স্টেশন থেকে বিবাদি বাগ স্টেশন পর্যন্ত লোকাল ট্রেন ভাড়া=২০ রুপি
৬। হাওড়া থেকে কালকা পর্যন্ত ১,৭১৩ কিঃমিঃ ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের ভাড়া=৬৮০ রুপি
৭। টিকিট কেনার ঘুষ=২০ রুপি
৮। ফেয়ারলি প্লেস থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত নদী পার হবার ফেরী ভাড়া=৫ রুপি
৯। ক্লক রুম ভাড়া=২০ রুপি
১০। দুপুরের খাওয়া= ৬১ রুপি
১১। শিকল ও তালা কেনা=৯০ রুপি
১২। বালিশ কেনা=৭০ রুপি
১৩। রাতে খাবার পাউরুটি ও মিষ্টি=৪২ রুপি
মোট=১,১৯৩ রুপি। ১০০টাকায় ৮২ রুপি হিসাবে ১,৪৫৫ টাকা।
১৯শে সেপ্টেম্বর’১৫ তারিখে মোট খরচ ৬০০+১,৪৫৫=২,০৫৫ টাকা।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৩