অন্য পর্ব
আমার ক্লাসের পোলাপান এতো খারাপ যে চিন্তাই করা যায় না। পরীক্ষার ডেট দিলে তারা পিছাতে পিছাতে এমন সময়ে নিয়ে আসে যে আমার ট্যুরগুলো মাঠে মারা যায়। এবার অবশ্য আমি ঠিক করেছিলাম যে দরকার হলে পরীক্ষাই দেব না। তবে এবার উল্টো ব্যাপার ঘটলো। পরীক্ষার ডেট তারা টেনেটেনে দু’মাস এগিয়ে নিয়ে আসলো। পাচ-ছজন বিশিষ্ট ভদ্রমহিলা যে পরীক্ষা পেছানোর বিশেষ চেষ্টা করেনি তা নয়। তবে তারা আর হালে পানি পায়নি।
যেহেতু ইন্ডিয়া যাবার ইচ্ছা এজন্য ভিসা করাতে হবে। আর ইন্ডিয়ান ভিসা করতে হলে ই-টোকেন মাস্ট। কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানলাম ই-টোকেনের সর্বনিম্ন মূল্য ২,৫০০টাকা। কি আর করা যাবে! গেলাম ফরম পূরণ করতে। কিন্তু বিধি বাম! কারেন্ট নেই। রোজার মধ্যে আর কতক্ষণ বসে থাকবো? দোকানে কাগজ-পত্র জমা দিয়ে এলাম।
পড়ালেখা শেষ হয়নি, কিন্তু স্টুডেন্ট কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অস্থায়ী ঠিকানা ভুল করে ফেলাছি। এজন্য এডিট করে নতুন স্টুডেন্ট কার্ড আর বিদ্যুৎ বিল তৈরী করে দিল আমার বড়মামী। এবার ডলার এনডোরস এর পালা। ভেবেছিলাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতিঝিল শাখা থেকে ডলার এনডোরস করাবো। তাহলে নাকি ভিসা পাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তো সেখানে গিয়ে শুনি তারা নাকি এখন আর ডলার এনডোরস করেন না। তার বদলে ট্রাভেল চেক ইস্যু করেন। আরে বাবা ট্রাভেল চেক দিয়ে আমি কি করবো? আমার তো ডলারও দরকার নেই। দরকার শুধু ডলারের সার্টিফিকেট।
যাই হোক কৃষি ব্যাঙ্কে কর্মরত আমার মেজ মামী জানালেন যে তাদের ব্যাঙ্ক খুব কম খরচে, প্রায় বিনা পয়সায় ডলার এনডোরস করে থাকে। তো গেলাম সেখানে। ডলার কেনার জন্য টাকা জমার লাইনে দাড়ালাম। ১০ জনের পিছনে ১১ নম্বর সিরিয়ালে। আড়াই ঘন্টা পর কাউন্টারে যখন পৌছালাম তখন দেখি সেখানে কর্মরত ভদ্রমহিলাটি সন্তান-সম্ভবা। তিনি একই সাথে টাকা জমা নিচ্ছেন আবার টাকা প্রদান করছেন। এগারো জন গ্রাহকের জন্য তার সময় লাগলো আড়াই ঘন্টারও বেশি। সত্যি এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলি যে কবে আরো উন্নত হবে! তো টাকা জমা শেষে সার্টিফিকেট সহ ডলারগুলো হাতে এলো। দেরি না করে তক্ষুনি ছুটে গিয়ে ডলারগুলো বিক্রি করে দিয়ে এলাম। আর টাকাগুলো দিয়ে এলাম মেজ মামীকে। কারণ তিনিই তো এই অর্থের জোগানদাত্রী। এই কাজগুলো শেষ করতে আরো একটা রোজার দিন পার হয়ে গেছে।
এবার ইচ্ছা ছিল সিমলা, মানালি, কাশ্মিরের লাদাখ, শ্রীনগর, জম্মু এই অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখার। এই জায়গাগুলো সম্পর্কে জানার জন্য ইন্টারনেট থেকে ভালো উপায় তো আর নেই। কারণ আমার পরিচিত কেউই সেখানে যায়নি। তো এই তথ্যগুলো জানতে চেয়ে ব্লগে পোস্ট দিলাম। তা এই পোস্ট দেখে একজনের সে কি রাগ! তার মন্তব্য হচ্ছে, এইসব ব্যাক্তিগত বিষয় নাকি পোস্ট করা উচিৎ নয়। আরে বাবা ভ্রমণ ব্লগগুলো তো ব্যাক্তিগত তথ্যেই ভরপুর। তবে জহিরুল ভাই আমার খুব উপকার করেছেন।
১০ দিনের মধ্যেই ভিসার এপয়েন্টমেন্ট ডেট পেয়ে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। দেখি ফরমে একগাদা ভুল। ব্যাটা দোকানদার ঠিকমতো চেক না করে আমার ফরম ভুল পূরণ করেছে। তাকে চেপে ধরতেই সে আমাকে প্রবোধ দিলো যে এসব ভুল নাকি কোন সমস্যাই না, এগুলো নাকি ভিসা অফিসের লোকজন খেয়ালই করে না, আরো হাবিজাবি কতো কি! কিন্তু আমার এসব প্রবোধ বাক্যে মন গলে না। অথচ কিই বা আর করার আছে! এতোগুলো টাকা নষ্ট। একদিকে রোজার মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, আর অন্যদিকে এইসব সমস্যা। এসব চিন্তায় একেবারে অস্থির হয়ে গেলাম আমি।
পরীক্ষা শেষ হলে মাথা থেকে চাপ কিছুটা কমলো। ভাবলাম যাই আবেদনপত্রটা জমা দিয়েই আসি। টাকা তো এমনিতেই নষ্ট হচ্ছে। দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে ২৭শে রমজান ভোরবেলা বের হলাম ফরম জমা দিতে। গুলশান অফিসে গিয়ে দেখি বিরাট লম্বা লাইন। আর লাইনে শুধু গুজবের ছড়াছড়ি। এই করতে হবে নাহলে ভিসা হবে না, ওই করতে হবে নাহলে ভিসা হবে না,দালালদের টাকা দিলে আগে ঢোকা যায়, আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আগেও এগুলোতে কান দিইনি, এখনো দিলাম না। আমার সময় ছিলো সোয়া আটটায়। আটটা থেকে ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। শরীর বাঁচানোর কোন জায়গা নেই, পুরোই ভিজে গেলাম। ততোক্ষণে অনেকের পাসপোর্ট পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ভাগ্যিস প্লাস্টিকের ফাইলে করে পাসপোর্ট আর কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলাম বলে রক্ষা।
সাড়ে আটটার দিকে ভিতরে ঢুকতে পেলাম। ভিতরে ঢুকে প্রথমে লাইন থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। সেটি নিচতলার ঘরে জমা দিয়ে অন্য আরেকটি টিকিট নিলাম। আমার সিরিয়াল পড়লো দোতলায়। আগে ভিসা প্রসেসিং ফি ছিল ৪০০টাকা, এখন ৬০০। এই টাকা জমা দেবার জন্য ফরম পূরণ করে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলতে হলো। তারপর সেই একাউন্টে U cash এর মাধ্যমে টাকা জমা নিল। এসব কাজ শেষে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমার ফরম জমা দেবার পালা এলো এক মহিলার কাছে। সে দেখি অন্যদের খুব ঝাড়ি দিচ্ছে আর ফরমে ভুল খুঁজে বের করে পাসপোর্ট জমা না নিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়ে ভয়ে ভয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমি সবসময় ভিসার জন্য একগাদা কাগজ জমা দিই। এমনকি আমার রেজিস্ট্রেশন কার্ড পর্যন্ত। তো সেটি দেখেই ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন যে, আমি কোথায় পড়ি। জানালাম জগন্নাথে পড়ি। কোন সাবজেক্টে জিজ্ঞাসা করায় বললাম,সাইকোল্যজিতে। তো সেটা শুনেই মিষ্টি একটা হাঁসি দিয়ে তিনি জানালেন যে তিনিও সাইকোল্যজিতে ইডেন থেকে পাশ করেছেন। আরি শালা , আমি তো ভাবতাম এগুলো সব ইন্ডিয়া থেকে আসে! এখন তো দেখি সব বাংলাদেশের জিনিস। তা এরা এতো খটমট ব্যাবহার করে কেন আল্লাই জানে। যাই হোক ভদ্রমহিলা আমার সবগুলো তথ্য যাচাই না করে আমার সাথে গল্প করতে করতে আমার ফাইলে সই করে দিলেন। পাসপোর্ট ফেরতের সময় দিলেন ঈদের ছুটির চারদিন পর। মনোবিজ্ঞানে পড়ি শুনলে সবাই কেমন যেন নাক সিটকায়। জীবনে বোধহয় এই প্রথম মনোবিজ্ঞানের কারণে পার হয়ে গেলাম।
নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যা ছ’টার দিকে ভয়াবহ বৃষ্টি উপেক্ষা করে গেলাম পাসপোর্ট আনতে। আমি কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিত যে আমার ভিসা হবে না। গিয়ে দেখি পুরো অফিস ফাঁকা। শুধু একজন দুঃখ কাতর মানুষ বসে আছে যার ভিসা হয়নি। আনেকক্ষণ ধরে কাউন্টারে শব্দ করার পর একজন এসে বিরক্ত সহকারে আমার পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে গেল। খুব ভয়ে ভয়ে পাতা উল্টালাম। প্রথম ও দ্বিতীয় ভিসার পাতা উল্টে দেখি আমার জন্য খুব সুন্দর একটা উপহার অপেক্ষা করছে। নিজের বদখত ছবিটাও কি সুন্দর দেখাচ্ছে। এতোক্ষণে শরীরে প্রাণ ফিরে এলো। অফিস থেকে বের হয়ে দৌড়ে এক মসজিদে গিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম।
কিন্তু সমস্যা তো কেবল শুরু হলো সেখান থেকে। সব মামা মামীরা আমার উপর প্রচন্ড বিরক্ত। আমি নাকি কোন কাজ তো দূরে থাক, এমনকি পড়াশোনা পর্যন্ত করি না! শুধূ ঘুরে বেড়ানোর ধান্দায় থাকি! তারা সম্মিলিত ভাবে আমার এই ট্যুর প্রতিহত করার চেষ্টা শুরু করলো। বিশেষ করে আমার মেজ মামী সন্দেহ প্রকাশ করলো যে, ইন্ডিয়াতে নিশ্চয় আমার বিয়ে করা কোন বউ আছে! নাহলে আমি এতো ঘনঘন ইন্ডিয়া যাই কেন?
এদিকে আমার ব্যাবহারিক পরীক্ষা শেষ হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা ছিল লাদাখের দিকে যাবার। লাদাখে যাবার রাস্তা নাকি বছরে সাড়ে তিন মাসের জন্য খোলা থাকে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাডামকে অনেক রিকোয়েস্ট করে পরীক্ষার ডেট নিলাম। অনেক সাধ্য-সাধনার পর ব্যাবহারিক আর ভাইভা শেষ হলো। এবার যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হবার পালা। আমার মামাতো বোন ডাক্তারি ভর্তি পরীক্ষা দেবে। ওর সীট পড়েছে যশোরে। সেও আমার সহযাত্রী হলো।
২০১৫’র সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ পয়সা ও সময় বাঁচানোর জন্য আমরা দু’ভাইবোন গাবতলী থেকে সকাল সাড়ে আটটায় দ্রুতি পরিবহনের লঞ্চ পারাপারের বাসে উঠে বসলাম। ভাড়া ২৫০টাকা করে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু সমস্যা হলো পাটুরিয়া ঘাটের ১০ কিঃমিঃ আগে। ভাগ্যিস আমি বাসা থেকে বের হবার আগে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে এসেছিলাম! কারণ আমাদের বাসটা ভয়াবহ এক্সিডেন্ট করেছিল এবং আমি ছাড়া বাসের অন্য সকলেই আহত হয়েছিল। বাসের সামনের অংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে উঠেছিল। আল্লাহর রহমতে সে সময় বৃষ্টি পড়ছিল বলে কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিভে গেল। যারা বাসের জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছিল তারা আহত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। তবে কেউ মারা যায়নি।
আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম আমার মামাতো বোন ভারি ভারি তিনটি ব্যাগ নিয়ে আমাকে মাড়িয়ে হুড়মুড় করে নেমে গেল দেখে। পরে দেখি পায়ের যন্ত্রণায় ও দাড়াতেই পারে না। কিন্তু তখন লাফিয়ে নামলো কিভাবে! যাই হোক অন্য একটা লোকাল বাসে করে আমরা ঘাট পর্যন্ত এলাম। লঞ্চে নদি পার হবার পর দৌলতদিয়া ঘাটে এসে পৌছালাম। এপাশে আরেকটি বাস অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। সেটাতে চড়ে বসলাম। আল্লাহর রহমতে আর কোন দুর্ঘটনা ছাড়ায় দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে যশোরে এসে পৌছালাম। বাড়ি পৌছে দেখি মা উদ্বিগ্ন মুখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৯