কম খরচে কলকাতা দিল্লী আগ্রা-২
২৯-১২-২০১৪
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হলো। কারণ আজকে আমার গন্তব্যস্থান হচ্ছে ভালোবাসার শহর ‘আগ্রা’। দিল্লী থেকে আগ্রা অনেকভাবে যাওয়া যায়। বিশেষ করে দিল্লী থেকে আগ্রা পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৪টি ট্রেন আছে। তবে আমার মনে হয় সবথেকে সহজ এবং কম ঝামেলাপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে ‘টুরিস্ট বাস’। আগের দিন হোটেল থেকেই আমি এর টিকিট কেটে রেখেছিলাম। ‘নিউ রাজধানী’ নামে একটি ট্রাভেল কোম্পানির বাস ভোর ছ’টায় দিল্লীর হোটেল থেকে টুরিস্টদেরকে তুলে নেয়। তাদের গন্তব্য ২০৬কিঃমিঃ দুরের শহর আগ্রা। সেখানে তারা প্রথমে নেয় আগ্রা দুর্গে। তারপর কিছু সুভ্যনির দোকানে, তারপর দুপুরে খাবার জন্য হোটেলে আর সেখান থেকে তাজমহল। তাজমহল দেখা শেষ হলে নিয়ে যায় ৩৭কিঃমিঃ দূরের ‘ফতেপুর সিক্রি’তে। ফতেপুর সিক্রি দেখা শেষ হলে আবার দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। রাত ১২টার দিকে নামিয়ে দেয় দিল্লীতে হোটেলের সামনে। হিসেব করে দেখলাম একদিনে প্রায় ৫০০কিঃমিঃ যাত্রা। টিকিট মাত্র ৫০০রুপি।
হোটেল থেকে বের হয়ে যখন বাসে উঠলাম তখন ভোর ৬টা। প্রচন্ড ঠান্ডা আর ভয়াবহ কুয়াশা। ঘন্টাখানেক ধরে বাস দিল্লীর এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে অপেক্ষারত যাত্রীদেরকে তুলে নিল। আর তারপর আগ্রার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস হাইওয়েতে উঠে আসলো। মুগ্ধ হবার মতো হাইওয়ে এটি। প্রতিটি রাস্তা ৮লেন করে প্রশস্থ। কোন কোন জায়গায় সেটি ২৪লেনে গিয়ে ঠেকেছে। তবে এ রাস্তায় কিছুদূর পরপর টোল পরিশোধ করতে হয়।
কুয়াশার পরিমাণ এতো বেশী যে সামনের ১ফুট রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ড্রাইভার বাস খুব দ্রুত চালাতে পারছে কারণ রাস্তাগুলো এভাবেই তৈরী। এদিন ছিল এই এলাকার ৩০বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। যা ছিল ২ডিগ্রীরও নীচে। যেহেতু সেখানকার তাপমাত্রা সম্পর্কে আমার কোন পূর্বধারনা ছিলনা, এজন্য আমি খুব বেশি শীত-পোশাক নিয়ে যায়নি। যার ফলাফল আমাকে হাড়ে হাড়ে ভোগ করতে হয়েছিল।
ঘন্টাখানেক পর বাস হাইওয়ের এক স্টপেজে থামলো। টয়লেটের ব্যাবস্থা খুবই ভালো। তবে খাবারের দাম অনেক বেশি। ২০রুপির চা খেয়ে কিছুটা প্রাণ ফিরলো। ২০মিনিট যাত্রা বিরতির পর আবার বাস চলা শুরু করলো। আরো ঘন্টা দুয়েক চলার পর পৌঁছলাম আগ্রাতে। সূর্য ততোক্ষণে উঁকি মারা শুরু করেছে। বেলা তখন ১২টা। বাস থামলো আগ্রা ফোর্টের সামনে।
সবার আগে বাস থেকে নেমে দৌড় দিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। ২০রুপির ভারতীয় টিকিট কেটে দু’দফার চেকিং শেষে ঢুকে গেলাম দুর্গের ভেতরে। যেখানে পুরো দুর্গ দেখতে সময় লাগে পুরো ২দিন, বাস থেকে সেখানে সময় দিয়েছে মাত্র ৪৫মিনিট। প্রথমে দুর্গের বাজার, তারপর পাথরের তৈরী অনেকখানি ঢালু পথ পেরিয়ে মূল দুর্গ। অনেকগুলি প্রাসাদ রয়েছে সেখানে। আর খুব সুন্দর করে সাজানো বাগান। ভিতরে অবশ্য সব জায়গায় যাবার অনুমতি নেই। দুর্গ থেকে নাকি দুরের তাজমহল দেখা যায়। কিন্তু কুয়াশার কারণে সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না।
আগ্রা দুর্গ দেখা শেষ হলে নিয়ে গেল এক দোকানে। যেখানে তাজমহলের ৫ফুট উঁচু এক হুবহু প্রতিকৃতি রয়েছে। এটাকে বেবিতাজ বলা হয়। পুরো ঘর অন্ধকার করে এই বেবিতাজের উপর বিভিন্ন শেপের আলো ফেলা হলো। ভোরের আলোয় অথবা চাঁদনি রাতে তাজমহল যে কতোটা ভয়াবহ আকর্ষণীয় হয় তা অবলোকন করলাম।
বেবিতাজ থেকে বের হয়ে দুপুরে খাবার জন্য এক হোটেলে নিয়ে গেল। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন ছিমছাম এক হোটেল। আমি আমার পুরো আট দিনের ভারত ভ্রমণে সবচেয়ে ভালো খাবার এই হোটেল থেকেই খেয়েছিলাম। এটি ছিলো ‘বাঙালি থালি’। ঘন্টাখানেকের মধ্যাহ্নভোজ বিরতির পর আবারো বাসে উঠলাম। এবারের গন্তব্য ‘তাজমহল’।
তাজমহলের টিকিট বাসের গাইড কেটে দিল। টিকিট ২০রুপি আর জুতোর উপরে পড়ার জন্য এক ধরনের বিশেষ মোজা যার দাম ১০রুপি। এটা ভারতীয়দের জন্য। বিদেশিদের জন্য তাজমহলের টিকিট ৭৫০রুপি। যেহেতু বাসে আমি কোন কথা বলিনি সেহেতু গাইড আমাকে ভারতীয় ভেবে ২০রুপির টিকিটই দিল। আসলে কম কথা বলার সুবিধা অনেক।
তাহমহলের গেটের ২কিঃমিঃ আগে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। সময় দিলো সোয়া এক ঘন্টা। এখান থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়ি অথবা ইজিবাইকে করে গেট পর্যন্ত যেতে হয়। এটা ছাড়াও শুনেছি অন্য আরেকদিকের প্রবেশ পথ আছে। দুরুদুরু বক্ষে গেটের কাছে হাজির হলাম। শুনেছি অনেক বাংলাদেশীরা টিকিটের দু’নম্বরী করতে গিয়ে এখানে ধরা খেয়ে প্রচুর অপদস্থ হয়েছে। গেটের কাছে দেখলাম পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রবেশ লাইন আর সেখানে খুব কড়া টিকিট চেকিং হচ্ছে। অনেক দর্শনার্থীকে লাইন থেকে বের করেও দিচ্ছে। খুব ভয়ে ভয়ে ২০রুপির টিকিট দেখালাম। টিকিট চেক করে ফেরত দিয়ে ভিতরে প্রবেশের ইঙ্গিত করলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে গিয়ে আবার দম আটকে আসলো। আবার চেকিং। এবার পুরো শরীর চেক করবে। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা পর্দাঘেরা জায়গা। সেখানে হাত আর যন্ত্রের সাহায্যে পুরো শরীর চেক করে। আমি আমার পাসপোর্ট নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। গার্ডরা এটা খুঁজে পেলে খবর ছিল। পাসপোর্টটা ছিলো আমার জ্যাকেটের ভিতরের বুক পকেটের মধ্যে। ওই জায়গাটার উপর হাত বুলিয়ে গেলেও মোটা কাপড়ের মধ্যে পাতলা পাসপোর্টটা গার্ড খুঁজে পেল না। পিছনে লাইন ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছিল বিধায় আমাকে ছেঁড়ে দিল। ব্যাপারটা যে মিটে গেছে তখনো আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি। যতো দ্রুত সম্ভব এই এলাকা ছেঁড়ে পালালাম।
গার্ডরুম থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে তাজমহলের দরজা। দরজা পার হলে পানির সুদৃশ্য ফোয়ারা আর তার দুপাশে সাজানো বাগান যার মাঝখান দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে। আশেপাশে বিস্তীর্ণ খোলা ঘাসের চত্ত্বর যেখানে শয়ে শয়ে কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলি পেরিয়ে তাজমহলের মূল বেদি। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জুতোর উপরে সাদা কাপড়ের মোজা পড়তে হয়। অবশেষে তাজমহল স্পর্শ করতে পারলাম আর নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হলো।
তাজমহলের রুপ যেন ধবধবে সাদা এক রাজহাঁস। মুকুট পরা রাজেন্দ্রাণীর মতো সে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের শীর্ণকায়া যমুনা দেখে অবশ্য খুব তৃপ্তি পেয়েছি। লম্বা লাইন ধরে ধীরে ধীরে আরো উপরের তলায় উঠলাম। একপাশের মিনারের সংস্কার কাজ চলছে। তাজমহলের সব কক্ষে প্রবেশ করা যায় না। তবে যে জায়গাগুলোতে যাওয়া যায় সেখানের সব জায়গার ছবি তোলা বা ভিডিও করা যায়, শুধুমাত্র যে ঘরটিতে শাহাজাহান আর মমতাজের কবরের ডেম্যু রয়েছে সেখানটি ছাড়া। ঘন্টাখানেকের লম্বা লাইন পেরিয়ে ঘরটিতে ঢুকতে হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ঘরের অপূর্ব কারুকার্যখচিত পাথরগুলিতে আলো ফেললে এই আলো পাথর ভেদ করে অপার্থিব আভার মতো ঠিকরে বের হয়ে আসে।
কিভাবে যে সময় পার হয়ে গেল একেবারেই টের পেলাম না। ততোক্ষণে সোয়া একঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আসলে লাইনে দাঁড়িয়েই বেশি সময় খরচ করে ফেলেছি। ঝেড়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। অনেক কষ্টে বাসস্টপে ফেরত আসলাম। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হলো এবার। বাস খুঁজে পাচ্ছি না। মানে বাস থেকে যে ঠিকানা দিয়েছিল সেখানে বাস নেই। প্রথমে মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো। কিন্তু একটু ভেবে দেখলাম বাসে শুধুমাত্র আমার একটা পানির বোতল আছে। তাছাড়া টাকা-পয়সা পাসপোর্ট সব আমার কাছে। আগ্রার স্টেশনে গিয়ে যেকোন ট্রেনে আমি দিল্লী ফেরত যেতে পারি। এবার একটু স্বস্তি পেলাম।
নতুন এডভেঞ্চারের চিন্তায় মশগুল হয়ে জলবিয়োগের জন্য আশেপাশে একটু জায়গা খুঁজতে গিয়ে বাসটা খুঁজে পেলাম। আসলে হয়েছিল কি বাসটা আমাদের যে জায়গার ঠিকানা দিয়েছিল সেই নির্দিষ্ট জায়গায় না দাঁড়িয়ে একটু পাশে অন্য জায়গায় পার্ক করেছিল। ভাগ্যিস আমার কাছে বাসের নম্বর প্লেটের ছবি তোলা ছিল। সেটা মিলিয়েই বাসটা খুঁজে পেলাম। যাক অবশেষে বাসটা খুঁজে পেলাম এবং এ উপলক্ষে একটা বড়সড় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বাসে উঠে দেখি দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও সবাই এখনো উপস্থিত হয়নি। অবশেষে আস্তে আস্তে সবাই আসলো আর বাস ছেড়ে দিলো। এবারের গন্তব্য ৩৭ কিঃমিঃ দূরের ফতেপুর সিক্রি।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর বাস এসে থামলো পাহাড়ের নিচে। মোঘল সম্রাট আকবরের একসময়ের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি। বাস থেকে নেমে অনেকগুলি খাড়া সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হয়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে প্রথমেই পড়ে বিখ্যাত ‘বুলওয়ান্দ দরওয়াজা’। এটি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দরজা। আর এই দরজা দিয়ে ভীতরে প্রবেশ করলেই যেন রুপকথার জগৎ। পাথরের দুর্গের যে এতো রুপ থাকতে পারে, আর তার উপরে যে এতো নকশার কারুকার্য করা সম্ভব সেটি এখানে না এলে বোঝা যাবে না। এখানে আছে খাজা সেলিম চিস্তির দরগা। কথিত আছে, নিঃসন্তান সম্রাট আকবর সন্তান কামনায় পীর খাজা সেলিম চিস্তির দ্বারস্থ হলে তার দোয়ায় সম্রাটের হিন্দু মহিষী যোধাবাই-এর গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। গভীর কৃতজ্ঞতায় সম্রাট আকবর পীর খাজা সেলিম চিস্তির সাধনভূমিতে গড়ে তোলেন ‘ফতেহপুর সিক্রি’। সব ধর্মের মানুষ দেখলাম টাকার বিনিময়ে এই দরগায় মানত করছে। ব্যাপারটি আমার কাছে ব্যাবসায়িক কর্মকান্ড বলে মনে হয়েছে।
এছাড়া এখানে রয়েছে যোধাবাইয়ের মহল, তানসেনের জলসা ঘর, অপূর্ব ডিজাইনের পিলারের উপর সম্রাটের আলোচনা কক্ষ যার চারদিকে চারজন মণিষির বসার জায়গা, অপরুপ কারুকার্যের মসজিদ, সুদৃশ্য কবর আর আরো অনেক কিছু। অনেকগুলি কবর পার হয়ে এক গুপ্ত কক্ষে যেতে হয়, যেখানে রয়েছে সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি খুব সহজেই তাজমহলে যাওয়া যায়। সুড়ঙ্গটির দরজায় বড় একটা তালা। আধাঘন্টার ভেতরে সবকিছু দেখতে হলো। কারণ ততোক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছে, আর ভয়ঙ্কর কুয়াশাও তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। তাজমহলের চাইতেও এই দুর্গটি আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে। শুধুমাত্র ‘ফতেপুর সিক্রি’ দেখার জন্য হলেও একবার আগ্রাতে আসা উচিৎ।
ফতেপুর সিক্রি দেখা শেষে বাস চলা শুরু করলো। জ্যামের কারণে আগ্রা শহর পার হতে অনেক সময় লাগলো। ঘন্টা দু’য়েক পর বাস এক ধাবায় এসে ঘন্টাখানেকের বিরতি দিলো। তারপর আবার শুরু হলো দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ভয়াবহ কুয়াশা পার হয়ে রাত এগারোটার পরে বাস দিল্লীতে আমার হোটেলের সামনে থামলাম। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকলাম। পরদিন আমার কলকাতায় যাবার ট্রেনটির নাম ‘দুরন্ত এক্সপ্রেস’। যেটিকে আমার কাছে ‘রাজধানি এক্সপ্রেস’ এর চাইতেও অনেক বেশি দুর্দান্ত মনে হয়েছিল।
কলকাতার গল্প অন্য কোন এক সময় হবে।
*নোট( আমি আমার তিনবারের ভারত ভ্রমণে দেখেছি, কোথাও এরা রুপি ভাঙ্গিয়ে দিতে চায়না। এমনকি ১৫রুপির জিনিস কিনে ২০রুপির নোট দিলেও বলবে ভাঙ্গতি নেই। দরকার হলে পণ্যের দাম পর্যন্ত নেবে না। অতএব কিছু কেনার আগে পুরো ভাংতি সংগ্রহে রাখুন।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:৩১