লেখক হুমায়ুন আজাদ যেদিন সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন, সেদিন আমরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে। আমি, কার্টুন শিল্পি বিপুলশাহ, রাশেদুল হুদা, কনক, আবু জাফর স্বপন, আবু সালেহ, গিয়াস আহমেদ, মেসবাহ য়াযাদ সহ প্রায় দশ-বারো বন্ধু বাংলা একাডেমীর একুশের বই মেলা থেকে ঘরে ফিরে চলেছি। যখন বই মেলা থেকে বের হই, তখনও হাস্যোজ্বল ড.হুমায়ূন আজাদ আগামী প্রকাশনীর সামনে ভক্ত পরিবেষ্ঠিত কিন্তু আমরা রাজু ভাস্কযের্র কাছে আসতে আসতে ঘটনা ঘটে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে খবর হয়ে গেল বাংলাদেশের একমাত্র প্রথা বিরোধী বহু মাত্রিক জ্যোতির্ময় লেখক ড.হুমায়ুন আজাদ সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ বিােভে ফেটে পরে। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে হামলার প্রতিবাদে বের হয় কফিন মিছিল। মিছিলটি শেষ হয়েছিল জাতীয় শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে। এর পরের ঘটনা সবার জানা!
ড.হুমায়ূন আজাদ ২৮শ্রাবন ১৪১১বাংলা সালে মিউনিখে মৃত্যুবরন করেন। এখনও প্রায় সময়ই রাজু ভাস্কর্যের কাছে এলে ড.হুমায়ূন আজাদের কথা মনে পরে। তেমনি এক ছুটিরদিন বাংলা একাডেমী অতিক্রম করার সময় নিয়ম মত হুমায়ূন আজাদের কথা মনে পরলো। সেদিন আবার তাঁর জস্মবার্ষিকী ছিল, ২৮ এপ্রিল। রাঢ়িখাল যাব মনস্থির করলাম। রাঢ়িখাল কোনও খাল নয়, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার একটি গ্রাম। লেখক ড.হুমায়ূন আজাদ এখানে জন্ম গ্রহন করেছেন। এখানে তাঁর শৈশব কেটেছে, কেটেছে কৈশর। চমৎকার সে সব বর্ণনা আমরা তাঁর লেখা ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা গ্রন্থে পাই। তাঁর সে লেখা পড়লে বোঝা যায়, রাঢ়িখাল তাঁর কাছে অনেক প্রিয় ছিল। তাঁর তনুমনু প্রান রাঢ়িখালের অপার সৌন্দর্যে কতটা মুগ্ধতা ছিল সেটা বোঝা যায়। আমরা জানতে পারি তাঁর দু‘চোখ ভরে দেখা কুমরোর ফুল, লাউয়ের ডগার কথা। কী অসাধারন বর্ণনা তিনি সাবলিল ভাবে করে গেছেন, কামাঢ় গাঁয়ের লেবুতলার গন্ধ, ঝিলিক দিয়ে ওঠা পদ্মার ইলিশ, সাদা সরপুঁটির লাফ, পাঁচ গায়ের পুবপুকুরসহ রাঢ়িখালের। সে সব স্মৃতি উপো করে তিনি একদিন আমাদের কংক্রিট নগরীতে চলে এসেছিলেন। আসলে কী হবে, তাঁর মন কিন্তু পরে থাকতো শৈশবের স্মৃতি ভরা রাঢ়িখালে। তাইতো তিনি সময় পেলেই রাঢ়িখাল চলে যেতেন। যেখানে তাঁর নাড়ি গাঁথা। শহর তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাঢ়িখাল তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে বারবার, সেখানেই তিনি এখন চির নিদ্রায় শায়িত। যেখানে আমরা ছুটে চলেছি।
বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী পেছনে ফেলে একঘন্টায় শ্রীনগর পৌঁছে যাই। তারপর স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউশন আর রাঢ়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা কিছুটা সময় কাটাই। রাঢ়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয় হুমায়ূন আজাদের প্রথম স্কুল। আর স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউশন থেকে তিনি মেট্রিক পাস করেন। এখান থেকে একটু এগিয়ে আমরা পেয়ে যাই হুমায়ূন আজাদের প্রিয় রাঢ়িখাল। এখানে সত্যি একটি খাল রয়েছে, তারপর একটা সরু পথ, সে পথ টুকু পেরিয়ে হুমায়ূন আজাদের বাড়ি। আমরা ধীর পদেেপ চলে আসি সেখানে, যেখানে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। এটি তাঁর পৈত্রিক ভিটা, এখানেই তিনি থাকতেন। আমরা এখন তার সেই টিনের দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, বাড়িটি শুন্য পরে আছে। তিনি যে ঘরটিতে থাকতেন তার সামনে একটি ব্যানারে লেখা, এভাবে মৃত্যুর জন্য তোমার জন্ম হয়নি! লেখাটা পড়ে ভাবি; বাস্তবতা বড়ই নির্মম!
আমারা এখন ‘জ্যোর্তিময় আঙিনা’র সামনে। এখানে শ্বেত পাথরের কবরে তিনি ঘুমিয়ে। যার পেছনে একটি খাল, আর পাশেই একটি পুকুর। সবুজ ঘেরা গাছ গাছলিতে ভরা রাঢ়িখাল। যার বুকের ওপর তারই লেখা বই ‘পাক সার জামিন বাদ সাদ’ আর মাথার ওপর তাঁর প্রিয় ফুলগাছ -হাস্নাহেনা। একটু পর পর তার মাথায় টুপটাপ করে যেন হাস্নাহেনার বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। রাঢ়িখালের বুকে শুয়ে তিনি সে বৃষ্টি উপভোগ করে চলেছেন!
জ্যোর্তিময় আঙিনার ডিজাইন ও পরিকল্পনা রিয়াজুল ইসলাম সোহেলের, ড.হুমায়ূন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুর কবির মতিন এর ত্বত্বাবধায়ক। যার বাস্তব রূপ পায় ২০০৮ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারী। জ্যোর্তিময় আঙিনার শুভ উদ্ভোদন করেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান। সেটা ২০০৮সালের দোসরা মে, শুক্রবার। আমরা হুমায়ূন আজাদের কবর ছুঁয়ে দেখি। অনুশোচনায় চোখে জল ভরে আসে। ভাবি, মানুষকে উজ্জিবিত করতে গিয়ে যে মানুষটির নিজেকেই নিথর হয়ে যেতে হল, কিছুই করতে পারলামনা আমরা সে মানুষটির জন্য! এর মধ্যে আমাদের দেখে হুমায়ূন আজাদের ছোট ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছেন, তিনি পুকুর পারে আমাদের বসার জন্য একটি বেঞ্চ পেতে দেন। তারপর কত কথা, আপে, অনুশোচনা আর ভাই হত্যার বিচার না হওয়াতে ােভ। আবার তিনি স্মৃতি কাতর হন। চোখ দিয়ে ঝরে পানি। আমাদের সে চোখ সহ্য হয়না, উঠে দাঁড়াই। আবার চলে যাই জ্যোতির্ময় আঙিনার কাছে। তখনও টুপটাপ ঝরছে হাস্নাহেনা। আর স্মৃতি ফলকে তাঁরই লেখা জ্বলজ্বল করছে- অমরত্ব চাইনা আমি, বেঁচে থাকতে চাইনা একশো বছর; আমি প্রস্তুত , তবে আজ নয়। চলে যাওয়ার পর কিছুই চাইনা আমি দেহ বা দ্রাা, ওষ্ঠ বা অমৃত, বা অমরতা: তবে এখনই যেতে চাইনা: তাৎপর্যহীন জীবনকে আমার ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে আমি আরও কিছু কাল তাৎপর্যপূর্ন ক‘রে যেতে চাই। হুমায়ূন আজাদ বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তার শরীরের সব কিছু অচল হয়ে গেলেও তাঁর কামনা ছিল , অন্তত তার হৃৎপিন্ডটি বেঁচে থাক। তিনি ভোরের শিশির ছুঁতে চেয়েছেন, ঘাসের গন্ধ পেতে চেয়েছেন, নত্র দেখতে চেয়েছেন। পানীয়র স্বাদ পেতে চেয়েছেন, আর বর্নমালা ও ধ্বনি পুঞ্জের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন আরও কিছু কাল। তিনি ঘুমিয়ে পরার আগে কিছু করে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু মানুষের জন্য লড়াই করে , শেষে নিজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। তিনি দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎস্বর্গ করেছেন। তিনি বলেছেন -
‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো।
ছোট্ট ঘাস ফুলের জন্য
একটি টলোমলো শিশির বিন্দুর জন্য
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি
পাপড়ীর জন্য।’
শেষ কথা
ড.হুমায়ূন আজাদ তাঁর প্রিয় রাঢ়িখালে ঘুমিয়ে আছেন। যেখানে এলে তিনি দুদন্ড শান্তি পেতেন, নিশ্চিত তিনি এখন শান্তিতে আছেন, শান্তিতে থাকুন! আমরা যখন তাঁর সে প্রিয় যায়গা ছেড়ে বের হই, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সোনাঝরা রোদ ছুঁয়েছে পুরো রাঢ়িখালকে। যা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জ্যোতির্ময় আঙিনায়।
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন