চাইরা সেতু , পাট এবং...
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
খুব সকাল সকাল বের হয়েছি। আগেরদিন খবরের কাগজে বাংলাদেশের সোনালী আঁশ পাট নিয়ে একটি লেখা পড়েছিলাম। বিষয় , পাটের ন্যায্য দাম পাচ্ছেননা চাষীরা। লেখাটি পড়ে মনে কিছু একটা হল। পরদিন আমি পাটের খোঁজে বের হলাম। কিন্তু ঢাকা শহরে পাট কোথায় পাবো ভাবতে ভাবতে চলে এলাম সাভারের কাছের ভার্কুতা ইউনিয়নের গ্রাম মোগরকান্দা। গত বছর এখানে পাট দেখেছিলাম। শরত মৌসুমে বর্ষাকালীন ফসল পাটের খোঁজ এখানে পাব সে আশায় আবার চলে এসেছি।
আমি আর শুভমিতা গত বছর বর্ষায় প্রথম ভাকুর্তার খোঁজ পাই। তারপর থেকেই এখানে যাতায়াত আমাদের। মজার ব্যাপার হল বুড়িগঙ্গার শাখা নদী ভাকুর্তার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে নি আকারে। ভাকুর্তা প্রবেশের সময় তুরাগনদ জলে টলমল। আর গ্রামের ভেতর চলে এলে দেখতে পাবেন বুড়িগঙ্গা। ভ্যাপারটি অবাক করা! আমরা মোগরকান্দা পৌঁছানোর আগে ভাকুর্তা বাজারের কাছে পৌঁছে দেখি সেখানকার নতুন সেতুর ওপর ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ঢালাই শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর আগে যাওয়া যাবেনা। এখন কী করি , কোথাই যাই। এর মধ্যে মেঘ করা আকাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে! এমন পারিস্থিতিতে শামীমের কথা মনে পড়ল। শামীম আমার প্রতিেিবশী। তার কাছে গত রাতে চাইরা গ্রামের গল্প শুনেছিলাম। একই পথ চাইরা যাবার সুতরাং চাইরা যাব ঠিক করে একজন মুরুব্বির কাছে চাইরা সম্পর্কে খোঁজ খবর করি। তিনি মো: হযরত আলী একজন স্কুল মাষ্টার। থাকেন চাইরাতে। তাঁর কাছেই আমরা চাইরা সম্পর্কে অনেক তথ্য পেলাম। ভাকুর্তার রাস্তা বন্ধ সুতরাং আমাকে এখন হেমায়েত পুর হয়ে চাইরা যেতে হবে। ভাকুর্তার কাছের অন্য আরেক পথ ধরেও যাওয়া যাবে , সে েেত্র মটর সাইকেল নিয়ে যাওয়াটা একটু রিস্ক-ই বটে। কারন পুরো রাস্তাই খানাখন্দে ভরা তারওপর বৃষ্টি মিলে বারোটা বেজে আছে। আমরা দ্বিতীয় চিন্তা না করে ভাকুর্তা থেকে বের হয়ে ঢাকা আরিচা মহাসড়ক ধরে হেমায়েতপুরের দিকে এগিয়ে যাই। এর মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বেগ বেড়ে গিয়ে বড় বড় ফোটার আকার ধারন করেছে। মন্দ লাগছিলনা বৃষ্টির সঙ্গ। বৃষ্টির ছোঁয়া গায়ে মেখে আমরা হেমায়েতপুর পৌঁছে যাই। তারপর একটু বিশ্রাম সাথে চা-নাস্তা খেয়ে আবার চাইরার পথ ধরি।
এভাবে দশ মিনিট চলার পর ঋষিপাড়া হয়ে দনি শ্যামপুর চলে আসি। এখানে পথের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। চমৎকার পিচ পথ। এ পথে বাস বা বড় গাড়ি খুব একটা আসে না , সুতরাং হেঁটে হেঁটে বহুদুর চলে যাওয়া যায়। শ্যামপুর এলাকায় রাস্তার দুধারের পুরো এলাকা জুড়েই শব্জির চাষ। যদি বলি দনি শ্যামপুর শব্জির গ্রাম , তাতে কোনও ভুল হবেনা। পাটশাক , লালশাক , মুলাশাক , পুই শাক সহ কোনটা নাই এখানে। শাকের মহাজনদের দেখা গেল ট্রাকে ট্রাকে শাক বোঝাইয়ে ব্যাস্ত। এ’গুলো শহরের কারওয়ান বাজার ঠাটারীবাজার হয়ে সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। শাকের তে দেখতে দেখতে আমরা চাইরা বাজারে চলে আসি। শুক্রবার ছুটির দিন এলাকা সরগরম। তার ওপর একটু আগে জুম্মার নামাজ শেষ হওয়াতে মোড়ে মোড়ে আড্ডা জমেছে। আমাদের খুব খিদা পেয়েছিল। বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে পড়ি। এখানে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাই। এভাবে খাবার খেতে আমার-শুভমিতা দুজনারই খুব ভাল লাগছিল। এ’দিকে এলাকার লোকজন ভীড় করে আমাদের দেখছে। কেউ কেউ বলছে , মেহমানদারির যেন কোন কমতি না থাকে। এর মধ্যে একজন মুরব্বি জহির চাচা আমাদের হাতে দুটো জাম্বুরা ধরিয়ে দিয়েছে। কী বলব বুঝে ওঠার আগেই দৃশ্যপট থেকে তাঁর প্রস্থান। আমরাও মোটর সাইকেল চালু করি। এবার এক চিলতে সরু বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে যে বাজারে আসি সেখানে পুরো বাজার জুড়েই রুপার ডাইস তৈরীর দোকান। দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা হয় আমাদের। তারপর আবার পথ চলা। ইতিমধ্যে মেঘলা আকাশ ঝকঝকে রূপ নিয়েছে। এবার সমতল পিচ পথের দুই ধারে আমাদের সেই কাতি পাটের দেখা মেলে। ইচ্ছেমত আমরা পাটের ছবি তুলি। এখানে পাটের আশঁ ছড়াতে ব্যাস্ত সবাই। ব্যাস্তার মধ্যেই কথা হয় একজন পরিমল পালের সঙ্গে। তিনি নিজেই তাঁর নিজের জমির পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন , সে গুলো কাঁধে নিয়ে সাথে সাথে শুকাতেও দিচ্ছেন। তার চোখে মুখে হতাশা। কোন কর্মচারী নাই? শুভমিতার এমন প্রশ্নের জবাবে পরিমল বাবু বলেন , ‘পাটের দাম পাইনা , লোক রাখুম কী কইরা! নিজের কাজ নিজেই করছি মা। এই যে ছবি তুললা , এইবার কী পাটের দাম বাড়ব?’ এমন প্রশ্নে শুভমিতার ভাষা স্তব্ধ হয়। কী বলবে সে। পরিমল বাবুর সাথে কথা বলার ফাঁকে অনেক পাট চাষী চলে এসেছেন আমাদের সাথে কথা বলার জন্য। সবার প্রশ্ন একটা , আমরা কবে পাটের ন্যায্য মূল্য পাবো! কিছু বলার নেই , সুতরাং বিশাল কিছু দির্ঘশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাই। এভাবেই চলতি পথে আমাদের চোখে পড়ে একটা তাল গাছ , সে গাছে অনেক বাবুইর বাসা। গত বছর ভাকুর্তা এসে এর চেয়ে বেশী বাবুইর বাসা সহ তাল গাছ দেখেছিলাম। আজ আবার তাল গাছ দেখে আমাদের সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা তাল গাছে বাবুইর বাসা আর আশেপাশের সবুজ বনানীতে মুগ্ধ। সে মুগ্ধতা নিয়ে সাথে দুটি বাবুইর বাসা জোগাঢ় করে একটি ছোট্টমত বাজার পেরিয়ে পাঁচ মিনিটে চাইরা সেতু পৌঁছে যাই।
গ্রামের নামে সেতুর নাম চাইরা সেতু। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা নদী। যেহেতু আমরা এর আগে ভাকুর্তা এসেছিলাম। সুতরাং আমরা জানি নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। তবু লোকজনদের কাছে জানতে চাই নদীর নাম কী। একজন বয়স্ক মতন লোক দেখে প্রশ্নটা প্রথমে তাকেই করি। তিনি রেগে গিয়ে বলেন বাবারে তুমি নদী কই পাইলা , এইডা তো গর্ত। তিনি যা বললেন , সে কথা অবশ্য আগেই শুনে এসেছিলাম হযরত আলী মাষ্টারের কাছে। চাচার নাম জুম্মন খাঁ। তাঁর সাথে চাইরা নিয়ে অনেক গল্প হয়। তারপর ব্যাস্ততা দেখিয়ে জুম্মন চাচা বাড়ি চলে যান। এখন আমরা চাইরা সেতুর ওপর মটর সাইকেল নিয়ে যাই। মাঝ বরাবর আসতেই হুড়মুড় করে কোত্থেকে যেন ছুটে আসে এক ঝাঁক মেঘেদের দল। শুরু হয়ে যায় প্রচন্ড শব্দ করে মেঘেদের গর্জন। বৃষ্টি আসবে ভেবে একটু আড়ালে যাবার প্রস্তুতি নিতেই , হঠাৎ আসা মেঘে হঠাৎ করেই কোথায় হারায়। সাথে সাথে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন। এখনকার প্রকৃতি অসাধারন। সেতুর ওপর থেকে নিচে নদীর দিকে তাকাই , প্রচন্ড হাওয়ায় নদীতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। চাইরা সেতুর ওপর থেকে দুই পাশের সৌন্দর্য অসাধারন। এখানে নদী খুব সুন্দর। দুরে এলাকার অনেক সৌখিন মাছ শিকারী ছিঁপ হাতে নৌকায় বসে আছে। ছুটির দিন বলে কথা , আজ সৌখিন মাছ শিকারীর দল বেশী হলেও জেলেরাই এখানকার আসল মাছ শিকারী। অনেক জেলে নৌকার দেখা পেলাম , এদের কেউ কেউ আবার মাছ সহ ফিরে চলেছে গন্তব্যে। আমাদের মাছ কিনতে ইচ্ছে হলে আমরা সেতুর নিচে চলে যাই। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে বাইন ও চিংড়ি মাছের গল্প শুনে একজন জেলের কাছ থেকে ৫০০টাকার চিংড়ি মাছ কিনে আবার সেতুর ওপর চলে আসি।
চাইরা সেতুটির নির্মান সাল ২০০৫-২০০৬ সাল। এর আগে দুপাশ বিচ্ছিন্ন ছিল। সে সময় পারাপারের জন্য নৌকাই একমাত্র ভরষা ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। চাইরা সেতু এখন এলাকার মূল সংযোগ স্থল। ভাকুর্তা বা হেমায়েত পুর যে পথেই আসেন না কেন চাইরা গ্রাম বা চাইরা সেতু ও এখানকার প্রকৃতি সবাইকে মুগ্ধতায় ভড়িয়ে দেবে। ছুটির দিনের বিকালটা এখানে বেড়ানোর জন্য খুব চমৎকার বলা যায়। ইচ্ছে করলে নৌকায় ও বেড়ানো যাবে। আমরা আগেভাগে মাছ কিনে ফেলায় নৌকায় ঘুড়ে বেড়াতে পারিনি। তা’ছাড়া যে কোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে বিধায় ফেরার পথ ধরি। ইতিমধ্যে আকাশও বেশ মুখ ভার করেছে। আমি বাতাসের ধাক্কায় মটর সাইকেলের গতি বাড়াই , সে গতিতে উড়ে চলে শুভমিতার কালো চুল।
শেষকথা
চাইরা সেতু বা বুড়িগঙ্গা নদী অনেক আগে এখানে ছিল না। পুরোটাই আসলে চাইরা গ্রাম। এখনও এখানকার মানুষ গ্রাম জেগে ওঠার অপোয়। অনেকেই নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের যায়গা খোঁজে। লোক-জন সেতুর নিচের নদীর এলাকাকে বলে কুম বা গর্ত। ১৯৬২ সালের আগে বুড়িগঙ্গা চাইরা থেকে বহুদুরে ছিল। তখন বুড়িগঙ্গা খরস্রোতা। বুড়িগঙ্গার ঢেউ এর তোড়ে চাইরা গ্রামে প্রায় সব সময় ভাঙ্গন লেগে থাকত। একদিন সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে চাইরা গ্রাম বুড়িগঙ্গা গ্রাস করে। সে কথাই চাইরা সেতুর ওপর ওঠার সময় বুড়ো চাচা বলেছিলেন। যেমন বলেছিলেন হযরত আলী মাষ্টার।
চাইরার পথ
গাবতলি হয়ে আমিন বাজার। তারপর একটু সামনে গেলেই ভাকুর্তার পথ। ভাকুর্তা হয়ে চাইরা যাওয়া যায়। আবার হেমায়েতপুর হয়েও চাইরা যাওয়া যায়। ভাকুর্তা হয়ে চাইরা গিয়ে হেমায়েতপুর দিয়ে বের হয়ে ঢাকা চলে আসতেপারেন। তাতে করে ভাকুর্তা ও হিন্দু ভাকুর্তার সৌন্দর্য ও এখানকার বুড়িগঙ্গা দেখতে দেখতে চাইরা পৌঁছে যাওয়া যাবে। সেখান থেকে দনি শ্যামপুরের কাছের শব্জি গ্রাম দেখে হেমায়েতপুর হয়ে ঢাকা চলে আসতে পারবেন। আবার ফেরার জন্য একই পথ অর্থ্যাৎ ভাকুর্তার পথ ও বেছে নিতে পারেন। যেভাবেই যান , নিজস্ব বাহন হলেই ভাল। এবং সাথে ক্যামেরা। যেতে আসতে সময় লাগবে শহরের জ্যাম বাদে দুই ঘন্টা। একেবারে ঢাকার কাছে বলে দুপুরের পরের সময়টাই চাইরা বেড়ানোর জন্য উত্তম।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন