দুই
শংকর আর্মেনিয়ান চার্চের পরিচর্যাকারী। তার সাথে পরিচয় বহু আগে। যেহেতু আর্মেনিয়ান চার্চে প্রবেশ সংরতি। সেহেতু শংকরের সাথে পরিচয়টা সেখানে প্রবেশে খুব কাজে লাগে। তা না হলে অনুমতি নিয়ে এখানে প্রবেশ করা একটু ঝামেলারই বটে। বাড়ির কাছে আর্মেনিয়ান চার্চ অথচ সেখানে আমার প্রথম যাওয়া হয় বছর দশেক আগে বর্তমান সকালের খবরের আলোকচিত্রি মোহাম্মদ আসাদের আগ্রহে। সেই তখন শংকরের সাথে পরিচয়। তারপর বহুবার সেখানে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবারই শংকরকে পেয়েছি। এখানকার ফাদার একটু কড়া ধরনের লোক বিধায় শংকরের ওপর চাপ থাকে যেন অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ না করতে পারে। যদি অনুমতি হয়ও তাতে একটু নিষেধাজ্ঞা থাকে , চার্চে ফাদার যে দিকটায় থাকেন সে দিকটায় কোনও দর্শনার্থী ঘুড়ে দেখতে পাবেন না। দীর্ঘদিন যাবৎ এই নিয়মের মধ্যেই আমি আর্মেনিয় চার্চে যাই। তবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করিনা। পুরো এলাকাই ঘুরে দেখে আসি। এবার দীর্ঘ বিরতীতে পনের আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকীর দিন সকাল বেলা ছবি তোলার নেশায় আর্মেনীয়ান চার্চে গিয়ে উপস্থিত হই। বাবুবাজার বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে সামনে পড়বে আরমানীটোলা খেলার মাঠ। খেলার মাঠ ঘিরে আছে আরমানীটোলা গণগ্রন্থ্াগার। তার পাশে এমটিসি টাওয়ার , আলিফ লাম মিম টাওয়ার এবং এ এন এ টাওয়ার। ওদের ঠিক উল্টা দিকে এক সময় শাবিস্তান সিনেমা হল ছিল। সিনেমা হলটি এখন আর নেই। সেখানে দাঁড়িয়েছে বিশাল ইমারত। সে যায়গাটুকু পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই আর্মেনিয়ান চার্চের জন্য নির্ধাারিত স্থান। আমি থাকি পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশের মহল্লা কলতাবাজারে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আর্মেনিয় চার্চে পৌঁছাতে আমার বেশী সময় লাগেনা।
তিন
পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহি এলাকা আরমানীটোলা। আবাসিক এলাকা হলেও পুরান ঢাকার রীতি বা ঐতিহ্য অনুযায়ী এর আশে পাশে ব্যবসা বানিজ্য চলে সমানে। এখানে মুল হচ্ছে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা। তাছাড়া রয়েছে ফার্মাসিউটিক্যাল , পারফিউমারী , টেক্সটাইল সহ নানাবিধ ব্যবসা। এমন একটি এলাকায় বিশাল একটি যায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্মেনীয় চার্চ। মুসলিম শাষনামলে এলাকাটির নাম ছিল মহল্লা আলে আবু সাঈদ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আর্মেনীয়রা এখানে চার্চ প্রতিষ্ঠা করলে এলাকাটির নাম হয় আর্মানীটোলা। ব্যবসা বানিজ্য সুদ এই তিনে মিলে হচ্ছে আর্মেনীয় জাতি। যীশু খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই তারা সারা বিশ্বে ব্যবসা বানিজ্য করে বেড়াত। এভাবেই তাদের বাংলাদেশে আগমন। ভারত বর্ষে আর্মেনীয়দের আগমনের সঠিক সময় জানা না গেলেও , সম্ভবত সপ্তদশ শতকে আর্মেনীয়দের ভারত বর্ষে আগমন ঘটে বলে ধারনা করা হয়। প্রথমে তারা গাধা ও ঘোড়ার পিঠে চড়ে এখানে যাতায়াত ও ব্যবসা বানিজ্য শুরু করে। পরে জাহাজে যোগাযোগ শুরু হলে তাদের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটে। আর্মেনীয়রা শুরুতে আমাদের দেশ থেকে মশলা , রেশম , মসলিন নিয়ে বিনিময়ে নানাবিধ দ্রব্যাদি দিয়ে যেত। আমাদের সোনালী আশ পাটকে তারাই প্রথম বিশ্বে পরিচিত করে তোলে। আর্মেনীয়রা এদেশে মোঘলদের হয়ে ব্যবসা-বানিজ্য শুরু করলেও পরবর্তিতে নিজেদের নামেই ব্যবসা চালু করে। অষ্টাদশ ও ঊনিশ শতকে তারা খুব দাপটের সাথে ব্যবসা বানিজ্য করে গেছে। তাদের কাজ-কর্ম কেবল ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলোনা। তাদের হাত ধরে ঢাকা শহর ঝলমলে হয়ে ওঠে। পানি নিস্কাশনের জন্য ধোলাই খাল খনন , তার ওপর সেতু নির্মান এবং বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মান সহ পোগজ স্কুল ও রুপলাল হাউসের নির্মান কাজ তাদের হাতেই শুরু হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন দেশে নির্মান ও উন্নয়ন কাজের বিশাল এক উল্লেখ যোগ্য দিক ছিল তারা যেখানেই যেতো সেখানেই একটা গির্জা নির্মান করতো। এভাবেই আরমানী টোলার বিখ্যাত আর্মেনীয় গির্জাটির গোড়াপোত্তন। প্রথমে তারা এখানে ছোট একটি গির্জা নির্মান করেছিলো। পরবর্তিতে এখানে আর্মেনীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৭৮১খৃ: আরমানীটোলাতে এই বৃহত্ত গির্জাটির নির্মান করা হয়।
চার
আরমেনীয় চার্চে প্রবেশ মুখে দীর্ঘদিন একটি নোটিশ বোর্ড শোভা পাচ্ছে। দর্শনার্থীদের সচেতন করা সে নোটিশ বোর্ডে মরিচা ধরেছে। আমি চার্চের মুল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে সে নোটিশ বোর্ডটি পরে পাশের কলিং বেল চাপি সাথে শংকর দা বলে চিৎকার করি। শংকর এসে ফটক খুলে দিলে ভেতরে প্রবেশ করি। আজ আমি একাই এসছি। শুভমিতা আজ ঘুমে। শংকর দা ফটকের দরজা খুলে দিতে দিতে বলেন , আজ এখানে বেশী সময় থাকা যাবেনা। ফাদারের মন মেজাজ ভালোনা। সুতরাং এপাশ থেকেই ছবি তুলে আপনাকে বিদায় নিতে হবে। আমার তো চোরাই মন , তাতেই রাজি হয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। চার্চের ভেতর প্রবেশকরেই মনটা ভালো হয়ে যায়। এমন ভালো লাগা আমার সব সময়ই হয় , কেন এমন হয় প্রায় সময় ভাবি। কবরস্থান বা কোন সমাধিস্থলে এলেই আমার এমনটা হয়।
পাঁচ
আর্মেনীয় চার্চে প্রবেশ করে সোজা চলে আসি সেই ভাঙ্গা হাতের মুর্তিটির সামনে। হাত ভাঙ্গা ছাড়া আর অন্য কিছু নষ্ট হয়নি। পরিচর্যা আছে বলা যায়। এখানে ছবি তুলে আমি আরো পেছনে চলে যাই। এখান থেকে চার্চের মুল ভবনটির ছবি তুলে নেই। আশেপাশে তাকাই বিশাল সব অট্টালিকা আর্মেনীয় চার্চকে ঘিরে রেখেছে। অন্য ভাবে বললে এমন ভাবে ঢেকে ফেলেছে যে এখন আর বাইরে থেকে বোঝার উপাই নাই। অথচ এক সময় এই নগর এমন ছিলোনা। আমার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গার লঞ্চের মাস্তুল দেখা যেত। এত সব সু-উচ্চ অট্টালিকার ভিড়ে সে সব হয়েছে ইতিহাস। তেমনি ইতিহাস অংশ আরমেনীয় চার্চ ও তার মিনারটি। অনেক আগে চার্চের মিনারটিতে ঘড়ি ছিলো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে চার্চটি তিগ্রস্ত হয়। উল্লেখযোগ্য তি হয় মিনারটির। পুরো মিনারটি সে সময় ভেঙ্গে যায়। পরবর্তিতে মিনারটি মেরামত হলেও ঘড়িটি আর লাগানো হয়নি। প্রচলিত আছে ভুমিকম্পে মিনারটি ভাঙ্গার আগে নারায়নগঞ্জ থেকেও সেই সময় মিনারটি দেখা যেত , আর তার ঘন্টাধ্বনি শোনা যেত বহুদুর থেকে। এখন এসব গল্পকথা , ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে যাই। এর মধ্যে শংকরের তারা - আমি শংকরকে উপো করে চার্চের ভেতর চলে যাই। এখানে মঞ্চের ওপর বিশাল যিশু খ্রিস্টের ছবি। একটি প্যাচানো সিড়ি আর কিছু ঘন্টা। আর যারা প্রার্থনা করতে আশে তাদের বসার স্থান। আমি সে যায়গাতে কিছুটা সময় বসে সামনের যিশু খ্রিস্টের ছবির দিকে তাকাই। এর মধ্যে মঞ্চে আগমন শংকরদার। দাদা হইছে এইবার চলেন যাই। কী আর করবো মুলত ছবি তোলা শেষ। এবার আমি বের হবার প্রস্তুতি নেই। বের হতে হতে অনেক গুলো কবর বা সমাধির ছবি তুলি। এর মধ্যে একটি সমাধি আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি তার সামনে অল্প সময় দাঁড়াই , ছবি তুলি। ম্যাক এস ম্যাকারটিচের সমাধি এটি। প্যারিসে জন্ম , মৃত্যু হয়েছে চাঁদপুরে , ২১ ডিসেম্বর ১৯২০ সালে মাত্র চব্বিশ বছর তেরো দিন বয়সে। সমাধির ওপর থেকে চোখ সরাতে সরাতে আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় আর এর সাথে সাথে আমিও বের হয়ে আসি আর্মেনীয় চার্চ থেকে।
শেষকথা
ঢাকার সে সব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সগৌরবে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে আছে আর্মেনীয় চার্চটি তাদের মধ্যে অন্যতম। আর্মেনীয় চার্চটি আর সব চার্চ বা গির্জা থেকে একটু আলাদা। প্রতিটি চার্চ বা গির্জার কবর বা সমাধিস্থল আলাদা কিন্তু আর্মেনীয় চার্চ পুরোটাই যেন সমাধিস্থল। আর সে সব সমাধি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে গড়া। একজন আর্মেনীয় নিকোলাস পোগজ ছিলেন বলেই সে সময় এমন একটি চার্চ নির্মান সম্ভব হয়েছিল। চার্চ অব দি রিজারেকশন নামের আর্মেনীয় চার্চটি আপনিও ঘুরে দেখে আসতে পারেন। সে জন্য আপনাকে যেতে হবে পুরান ঢাকার আরমানীটোলায়।
কীভাবে যাবেন
আপনি ঢাকা বা বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন গুলিস্তান হয়ে চলে আসুন আর্মানীটোলায়। এখানে এক সময় শাবিস্তান সিনেমা হল ছিলো। রিকসা ওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে আর্মেনীয় চার্চে পৌঁছে দেবে। তবে আর্মেনীয় চার্চে যাবার অঅগে প্রবেশের অনুমতি নিতে ভুল করবেন না। এ েেত্র শংকরদার সাহায্য নিতে পারেন। তাছাড়া পুরান ঢাকায় নিজস্ব বাহনের চাইতে রিকসা যাতায়াতই ভালো। সুতরাং গুলিস্তান হয়ে রিকসায় আর্মেনীয় চার্চে চলে যান। চার্চ দর্শন শেষে ঢাকাই খাবার অবশ্যই খেয়ে আসবেন। চাইলে কাছের নান্নার বিরিয়ানীর স্বাদ নিতে পারেন। দেখতে পারেন বিখ্যাত তারা মসজিদ আর আরমানীটোলা উচ্চ বিদ্যালয়। তাছাড়া বাবু বাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা দ্বিতিয় সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মৃত বুড়িগঙ্গাকে দেখে একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পারেন!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৮