শুক্রবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি। বরষায় বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবু এবার বরষার অন্য রূপ চোখে পরার মত। কারন গত কয়েক বছর যন্ত্রপাতির মতই বরষার অবস্থা ছিল ঠিক যেন মরচে ধরা। এবার বরষা তার সেই আরষ্টতা ভেঙ্গে প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। বরষা এবার পূর্ন যৌবনবতী হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে। এমন বর্ষা মাথায় দুজনই চলে এলেন বলধাবাগানে। আমি থাকি বলধা বাগানের পাশেই কলতাবাজারে। আমিও বৃষ্টি উপো করে মটরসাইকেল নিয়ে বলধার পথে নামলাম। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নয় একেবারে ঝুম বৃষ্টিরদিন।
দুই
বলধাবাগান আমার খুব পরিচিত। কতবার আমি এখানে এসেছি তা গুনে শেষ করতে পারবোনা। ৩.২ একরের বলধাবাগান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত। ১৯০৯ সালে রাজা নরেন্দ্রনারায়ন বলধাবাগান তৈরীর কাজ শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে ৬৭২ প্রজাতির গাছ নিয়ে সম্পুর্ন হয় বলধাবাগান। এর দুটি অংশ একটি সাইকী অন্যটি সিবিলী। আমি সাইকী ভাগে প্রবেশ করে মুশতাক কাদরী আর মুস্তফা আমীনদের পেয়ে যাই। দুজনই বলধার হাজারো বৃরাজীর সান্নিধ্যে ভিজে চলেছেন। পুরুষ লজ্জাবতীর পাশে তাদের ছাতা দুটি গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশের চৌবাচ্চায় বড়নখা দৃষ্টি মেলে আছে। আর আছে হরেক রকমের শাপলা। তাতে বৃষ্টির পানি পরার একটানা শব্দ। গাছ গুলো যেন হয়ে উঠেছে আরও সবুজ। চোখে নেশা ধরে যায় সবুজের। পাশে অন্য একটি চৌবাচ্চায় পদ্ম ফুটেছে। কিছুদিন আগে কালের কন্ঠ পত্রিকায় ফখরে আলম নীল পদ্ম নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। নীল পদ্ম নয় ওটা ছিল নীল শাপলা। নীল পদ্ম একটা মিথ। আসলে নীল পদ্ম বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। এখানে সারা বছরই নীলশাপলা ফোঁটে তবে বর্ষায় একটু বেশী। আজ এক সাথে চারটি নীল শাপলার দেখা পেলাম। আমরা এখানে কনকসূধার নিচে পাতা বেঞ্চে বসে ছবি তুললাম। তারপর এখান থেকে বের হতে হতে পথে ঘৃতকুমারী ছায়াতরুর পাশে গ্লোবলতার দেখা পেলাম। এখানেই অফিস রুমের কাছাকাছি একটি ক্যাকটাস গাছে ফুল ফুটেছে। গাছটি একশত বছরের পুরানো। অবশ্য বলধার প্রায় সব গাছই এমন। কোন রিপ্লেসমেন্ট এর ব্যবস্তা নেই , কতৃপরেও এই নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। এভাবেই গাছগুলো হারিয়ে একদিন হবে ইতিহাস।
সাইকী ভাগ মুলত গবেষনার জন্য। এখানে প্রবেশ সিমিত। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের অনুমতি ছাড়া এখানে প্রবেশ নিষেদ। অথচ এই গবেষনার যায়গাটি উত্তরমুখি নয়তলা ভবনটির জন্য যে ভাবে আলো বাতাসহীন হয়ে পড়েছে তাতে করে সাইকী ভাগের গাছ গুলোর ধ্বংষ দেখা কেবল সময়ের ব্যাপার। আমরা এখন সাইকী ভাগের পেছনের দিকে চলে এসেছি। এখানে হংসলতায় ফুল এসেছে আর ঢোলসমুদ্র তার সমস্ত স্নিগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা পাশেই ক্যাকটাস গ্যালারীতে প্রবেশ করি। ক্যাকটাস গ্যালারীর সামনে হুসনেলতা। এখানেই অপরাজিতা নীল ও সাদা দু’রঙের সাথে আমাদের দেখা হয়ে যায়। দেখা হয় ব্লিডিংহার্টের সঙ্গে। রাজঅশোক গাছে এখন ফুল নেই। রাজঅশোক নামটি অমৃত লাল আচার্যের দেয়া। অমৃত বাবু পরম যতেœ বাগানটি গড়ে তুলেছিলেন। বাগান শুরুর পর থেকেই অমৃত লাল আচার্য বাগান দুটির দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তিতে বেগম-এ-হাশেম বলধাবাগানের পরিচর্যার দায়িত্বে পান। সে যাই হোক রাজঅশোক গাছে ফুল নেই। তবে ব্রুনফেলসিয়া আমেরিকানায় ফুল ফুটে আছে। ব্র“নফেলসিয়া রমনা উদ্যানে প্রচুর। সেটির ফুল নীল পরে বাসি হলে সাদা হয়। ব্র“ন ফেলসিয়া আমেরিকানা ঘিয়ে রঙের , বাসি হলে সাদা হয়। আমেরিকানার মাথার ওপর করমচা গাছে করমচা ধরে আছে। আমরা করমচা গাছের করমচা ছিঁড়ে পাশে ভুতনাগিনীর সান্নিধ্য নিয়ে প্যাপিরাস , উলটচন্ডাল , পান্থপাদপ , অর্কিড আর আমাজন লিলির বিশাল পাতা দেখে একেবারে পেছনের ছায়াতরুর ভেতরের গুহা অংশ উপভোগ করে সাইকী ভাগ থেকে চলে আসি সিবিলী ভাগে।
তিন
অনেক দিন তো বিদেশ কাটানো হল। এবার দেশে স্থায়ী হতে চান মুশতাক কাদরী। যদি তাই হয় , তাহলে তিনি চেষ্টা করবেন বলধাবাগানের গাছ নিয়ে কাজ করার। কিভাবে গাছ গুলো রা করা যায়! শুধু টাকার প্রাচুর্য থাকলেই হয়না। মনেও প্রাচুর্যবান হতে হয়। তাহলেই এমন একটা বলধাবাগান বানানো যায় বলে হাসলেন মুস্তফা আমীন। ইতিমধ্যে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। আমরা সাইকী থেকে সিবিলী ভাগে প্রবেশ করি। এখানেই আছে বিখ্যাত জয় হাউস , একটি একক বিশিষ্ঠ দোতলাঘর। যেখানে বসে কবিগুরু তার বিখ্যাত ক্যামেলিয়া কবিতাটি রচনা করেন। আমরা এখানে এসে স্মৃতি কাতর হই। স্মৃতি কাতরতার মধ্যে মনে কাব্যের রঙ ধরে। মুশতাক কাদরী তো মুস্তফা আমীন ভাইকে ক্যামেলিয়া পাঠের অনুরোধ করে বসেন! এখানে রয়েছে সূর্যঘড়ি এবং অনিন্দ্যসুন্দর শংখনাদ পুকুরসহ বহু দূর্লভ বৃরাজী। শংখনাদ পুকুরটির বেহাল অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়। কিভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শংখনাদ পুকুর ঘাটের চিনি ঠিকরার কাজ গুলো অবিবেচক সব দর্শণার্থীরা তুলে ফেলছেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। আমরা হেঁটে একেবারে পেছনের দিকে চলে আসি। এখানে এক সময় প্রাচীন মহুয়া গাছটি ছিল। তারপাশেই মৃত সুগারপাম গাছটির অবস্থান। এখানে আমাদের দেখা হয় বেশ কয় প্রজাতির গার্ডেনিয়ার সাথে এবং ডুকডুকি , চালতা , টর্চফাওয়ার , কর্ডিয়াসেবাষ্টিন , নাগলিঙ্গম , অশোক , জুহুরীচাঁপা , সহজচাঁপা , ক্যানাঙ্গা , মরুগোলাপ , স্ক্যান্ডাল এবং গুস্তাভিয়া ছোট বড় দুটোর সাথেই। এখন ক্যামেলিয়ার মওসুম নয়। আমরা ক্যামেলিয়ার দেখা পাইনি কিন্তু ক্যামেলিয়া হাউস ঘুরে দেখেছি। আমরা দেখেছি বেহুলাবট এবং কৃষ্ণবট। কৃষ্ণবট বলধাবাগান ছাড়া আমাদের দেশের আর কোথাও নাই। বর্ষার ফুল ইয়ক্কা বলধায় এলে দু’চোখ আবেশে জড়িয়ে নেবে। তারার মত অজস্র ডাকুরের ছোট ছোট ফুল ঝিঁকমিক করছে। ডাকুর হচ্ছে গার্ডেনিয়ার এক দু¯প্রাপ্য প্রজাতি। আপনি জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গেলে নার্সারীর পাশের অশোক গাছের সাথে এমন একটি ডাকুর গাছের দেখা পাবেন। ডাকুরের পাশেই রয়েছে মন মজানো ভাদ্রা ফুল। আসলে বলধায় এমন অনেক দু¯প্রাপ্য গাছ আর ফুলের কথা বলে শেষ করার নয়।
শেষকথা
আমরা বলধাবাগানের দুই অর্ধ্বে ছিলাম দুইঘন্টার মত। দুই ঘন্টায় বলধার সব কিছু দেখে শেষ করার নয়। সারা দিনের জন্য যেতে পারলেই ভালো। ফুলে ফুলে চোখ জুড়িয়ে নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। আরেকদিন বলধা গার্ডেনে সারাদিনের জন্য যাবার প্রতিশ্র“তি দিয়ে মুশতাক ভাই এবং মুস্তফাআমীন ভাইর কাছ থেকে বিদায় নেই।
কীভাবে যাবেন
বর্ষায় প্রকৃতি অসাধারন। এই বর্ষায় হাজারো গাছÑগাছালিতে পূর্ন বলধা বাগানে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন। ফুলে ফুলে চোখ জুড়িয়ে নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। প্রকৃতি আমাদের পরম বন্ধু , প্রকৃতির কাছে গেলে মন ভাল হয়ে যায়। বলধাবাগান পুরান ঢাকার ওয়ারিতে অবস্থিত। রিকসা , সিএনজি বা নিজস্ব বাহনে বলধায় চলে যেতে পারেন। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বলধা খোলা পাবেন। সাইকীভাগে প্রবেশের পূর্ব অনুমতি লাগবে। সিবিলীতে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশ ফি জনপ্রতি পাঁচ টাকা। কষ্ট করে পুরান ঢাকায় যখন যাবেনই। খ্রীষ্টান কবরস্থান , বাহাদুর শাহপার্ক , বিউটি বোর্ডিংসহ আহসান মঞ্জিল ও রুপলাল হাউস দেখে আসতে পারেন। আর খেয়ে আসতে পারেন আদি ঢাকাই খাবার! বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস না থাকলে সঙ্গে ছাতা নেবেন এবং অবশ্যই ক্যামেরা!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:০১