আমাদের বাসা বাড়িতে যেমন চোরের ভয়ে রাত এগারোটা বারোটার দিকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় ঠিক তেমনি সরকারও চিন্তা ভাবনা করছে ফেসবুকে রাত বারোটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত তালা লাগানো যায় কিনা। এ ভাবনাটিও এসেছে ওই চোরের ভয়েই, তবে এখানে চোর ফেসবুক নিজেই। কি চুরি করে সে? আমাদের মহামূল্যবান সময়। হুম, চিন্তার বিষয় বটে! তবে কথা হলো কেউ যখন কারও বেডরুমের নিরাপত্তা দিতেই অক্ষমতা প্রকাশ করে, তখন তার সেই বেডরুমের বেডের বেডশিটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাওয়াটা হাস্যকর বটে।
ফেসবুক যে আমাদের সময় চুরি করে নিচ্ছে এই ভাবনাটা ঠিক আছে। উদ্বিগ্নতার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে এজন্য ফেসবুকে তালা লাগাতে হবে এই সিদ্ধান্তটিকে “মাথাব্যাথার যন্ত্রণায় মাথা কেটে ফেলা”র মতই মনে হচ্ছে। মধ্যরাতে ফেসবুক বন্ধের কারণ হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে তরুণদের অযথা সময়ক্ষেপণ এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের ব্যাপারটিকে। এক্ষেত্রে বলতে হয় বাংলাদেশে তরুণদের সময়ক্ষেপণ এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের জন্য কি ফেসবুকই কি একমাত্র কারণ? যেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে, অতঃপর উচ্চশিক্ষায় সেশনজটে পড়ে এবং অবশেষে চাকুরীর বাজারে হাহাকারের কারণে একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে অনেকগুলো বছর অযথাই হারিয়ে যাচ্ছে সেখানে সময় ক্ষেপণের অজুহাতে এক নিরীহ ফেসবুকের উপর খড়গ নামানো হাস্যকর নয় কি?
ফেসবুকে মানুষ তার নিজের বলয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রকের আসনে বসিয়ে বিভিন্নভাবে মজা উপভোগ করে। ফেসবুক মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে নিজের ভালোলাগা মন্দলাগার ব্যাপারগুলো সবার সাথে শেয়ার করার। নিজের মতামত খুব সহজে প্রকাশ করার। যোগাযোগের জন্য ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক কলিং, ফেসবুক লাইভ, বিভিন্ন গ্রুপ এবং ইভেন্ট খোলা, বিজ্ঞাপনের সুযোগ ইত্যাদি বাহারি ফিচার দিয়ে ফেসবুক মানুষের অত্যাবশ্যকীয় এক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যে খারাপ কাজ হচ্ছেনা তা নয়। তবে যেটা বলার সেটা হচ্ছে ফেসবুক মানুষকে কমপক্ষে একটা বিনোদনের জায়গা করে দিয়েছে যেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেই মানুষটি নিজে। তাছাড়া দেশে এখন সুস্থ বিনোদনের জায়গা কোথায়? খেলার মাঠগুলো সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, পাঠাগারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো নানা অজুহাতে বন্ধ করার পায়তারা চলছে, এক সিনেমা শিল্প মৃতপ্রায়, ব্যাঙের ছাতার মতন গড়ে ওঠা টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনময় মানহীন অনুষ্ঠান, নড়বড়ে সামাজিক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের এমন এক অবস্থায় মানুষ কোথায় গিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে? এই ব্যাপারগুলো ভেবে দেখার মত কেউ কি আছে?
সব কথাই বুঝলাম তবে তালগাছটা কিন্তু আমার। আচ্ছা সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে, ইংরেজীতে “ইউথ্যানাসিয়া” নামে একটা ব্যাপার আছে। এটি হলো কোনো দূরারোগ্য রোগে মৃত্যুযন্ত্রনাপ্রাপ্ত কোনো রোগীর মৃত্যু ঘটানোর প্রক্রিয়া। এই ইউথ্যানাসিয়া তিন রকম হতে পারে। রোগীর স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় অথবা যখন সম্মতি নেবার মতো অবস্থায় রোগী থাকেনা তখন (যেমনঃ কোমায় চলে যাওয়া রোগী)। কিছু কিছু দেশে কেবলমাত্র রোগীর স্বেচ্ছায় এই ইউথ্যানাসিয়া ঘটানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে, বাকী ক্ষেত্রগুলোতে নয়। আমাদের দেশের কর্তাব্যাক্তিদের কাছে ফেসবুককে যদি আসলেই একটি দূরারোগ্য রোগ বলে মনে হয় তবে ইউথ্যানাসিয়া ঘটানোর পূর্বে অবশ্যই যন্ত্রনাপ্রাপ্ত রোগীর সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি (আমরা না নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ বলি!)। যদি বন্ধ করতেই হয় তবে ফেসবুক ব্যাবহারকারীদের উপর একটা জরিপ চালানো হোক। সেটা ফেসবুকেই সম্ভব। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সমর্থন করলে তবেই তা কার্যকর করা হোক। সমর্থন পেলে শুধু ছয় ঘন্টা কেন পুরোপুরিই বন্ধ করা হোকনা। তবে সেটা হোক ব্যবহারকারীদের সম্মতিতে।
জোড় করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে তার ফলাফল ভালো হয়না এটা সবাই জানে। এক বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন নিয়েই জনসাধারণকে যত বিড়ম্বনার শিকার হতে হলো তার ইয়ত্তা নেই। খুব বেশি লাভ কি কিছু হয়েছে? সমস্যা তো অনেক জায়গায়। সেগুলোতে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের মাথাব্যাথা দেখা দিলে জনসাধারণের মাথাব্যাথা কিছুটা কমতো। যাই হোক ফেসবুক বন্ধ করা এতো সহজ কাজ হবে বলে মনে হয়না। মানুষ ঠিকই প্রক্সি সার্ভার দিয়ে ঢুকে পড়বে। মাঝ থেকে সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনার শিকার হবে। কথায় আছে, “নিজের ভালো পাগলেও বোঝে”। কারও জন্য ফেসবুক ব্যবহার যদি ক্ষতির কারণ হয় সেটা দেখার জন্য তার নিজের বুদ্ধিমত্তা আছে, অভিভাবক আছে। যেটা করলে বেশি লাভ হবে তা হলো সচেতনতা সৃষ্টি করা, বিনোদনের বিকল্প মাধ্যমগুলো চালু রাখা আর তরুণদেরকে বেশি বেশি সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করা। তাহলেই ফেসবুককে আর ছিটমহল বানিয়ে রাখতে হবে না। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, ফেসবুকে তালা লাগানো বন্ধ হোক।
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩১