১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫।
ছেলেটা কখনো প্রেম করেনি। তারপরও প্রেমের গল্প লিখতে বসেছে। কি দিয়ে যে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। প্রথম দেখা নাকি মেয়েটির রূপের বর্ণনা, নাকি ফেসবুক দিয়ে শুরু করবে? নাহ সে তো কখনো প্রথম দেখায় প্রেমেও পরেনি আবার কারো রূপেও মুগ্ধ হয়নি, কি করে লিখবে সে। অবশ্য একবার তার একটি মেয়েকে ভালো লেগেছিল তবে তা দ্বিতীয় দেখায়। প্রথম দেখাটিকে সেভাবে দেখা বলা যায়না। ছেলেটি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে আর মেয়েটি ফার্স্ট ইয়ার। ডিপার্টমেন্টের কি যেন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারে ছেলেটিকে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে গিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। ওই সময় ওই মেয়েটি ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চেই বসে ছিল। তাই ছেলেটি মেয়েটিকে একটু একটু দেখেছে। কিন্তু কাজের কথা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে ওইভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় দেখাটি হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানের রিহার্সেলের সময়। মেয়েটি পারফর্ম করবে বলে এসেছে। সেভাবে সেজে গুজে আসেনি বরং সারাদিন ক্লাসের শেষে রিহার্সেলে এসেছে বলে একটু বিধ্বস্তই লাগছে। কিন্তু ওই অবস্থাতেই মেয়েটিকে দেখেই ছেলেটির বুকে কেমন যেন ধক করে উঠলো। কেমন যেন একটা অনুভূতি। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে, তাই একটু লাজুক চাহনি একটু চঞ্চল ভাব কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মেয়েটির মুখের একটা সরল ভাব ছেলেটিকে মায়ায় জড়িয়ে ফেলল। ছেলেটি তখনই বুঝে ফেলেছিলো যে এই মেয়েটিকেই সে কতটা ভালবাসতে যাচ্ছে।
১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫।
নাহ সারাটা সকাল চলে গেল এখন পর্যন্ত দুটো লাইনও লিখতে পারলনা শুভ্র। সে বুঝতে পেরেছে যে তাকে দিয়ে আর যাই হোক প্রেমের গল্প লেখা হবেনা। মুখচোরা ছেলে শুভ্র। সে সহজে তার কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে চায়না। সে যে ভালো ছবি আঁকে, গীটার বাজায়, গল্প কবিতা লিখতে পারে, রুবিক্স কিউব মেলাতে পারে এগুলো তার কাছের বন্ধুরাও জানতে পেরেছিল অনেকদিন পর। তাই স্বভাবতই সে যে এই মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছে তা কাউকে জানতে দেয়নি। সে নিজেও মেয়েটিকে তার ভালবাসার কথা বলার সাহস করেনি। ভেবেছে যদি রিফিউজ করে। আর তাছাড়া ভার্সিটিতে আসার আগেই আজকাল সব মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড হয়ে যায়। তার উপর সেই মেয়েটি আবার শহুরে। কিন্তু ওদিকে মেয়েটিকে ভুলেও থাকতে পারছেনা শুভ্র। যতবারই সে ডিপার্টমেন্টে মেয়েটিকে দেখে ততবারই সেই প্রথমবারের মতো বুকে ধক করে ওঠার শব্দ শুনতে পায়। এভাবেই নীরবে নিভৃতে ভালোবেসে একটি বছর পার হয়ে গেলো। মেয়েটি জানতেই পারলোনা যে তাকে নিয়ে একজন নিয়ত কত স্বপ্ন তৈরি করে চলেছে। এরই মধ্যে একদিন ডিপার্টমেন্টে ইনডোর গেমসের আয়োজন করা হলো। এবারই শুভ্রদের মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবে। তাই ভাবলো লাস্টবারের মতো গেমসে অংশগ্রহণ করি। কাকতালীয়ভাবে লুডু খেলায় মনি আর শুভ্রের সাথে খেলা পড়লো লতা আর নিপুর (ও হ্যাঁ, আমাদের সেই মেয়েটার নাম কিন্তু লতা)। খেলা হলো এবং যথারীতি যা হবার তাই হল আরেকবার শুভ্রর বুকে ধক করে উঠলো এবং আগের মতই নিরবে সে ভালোবাসা লুকিয়ে রইলো।
১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫।
আজ শুভ্র গল্পটা শেষ করবেই। সে লিখতে শুরু করলো।
“আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবস। সবাই তার ভালবাসার মানুষকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হবে। কিন্তু শুভ্রর দিনটা অন্য আর দশটা দিনের মতই কাটবে। নিজের নাম দিয়েই গল্প লেখা শুরু করলো সে। ২৫ বছরেও যে তার ভালবাসার মানুষকে খুঁজে পায়নি তার জন্যে ভালোবাসা দিবস আর দশটা দিনের শুধুই একটি দিন কোনও দিবস নয়। এই দিনে............” লিখতে লিখতে কখন যেন শুভ্র ঘুমিয়ে গেলো। হঠাৎ রাফার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বেশ ব্যস্ত মনে হল রাফাকে। বলল দোস্ত কই আছিস, যেখানেই থাকিস ১ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাফে-৩৯ এ চলে আয়।
মানে কি? আজকের মতো একটা দিনে তোরা আমাকে ডাকছিস। সবাই কাপল হয়ে বসে থাকবি আর আমি তোদের কাপলামি দেখব। দরকার নাই বাবা আমি বরং ঘুমাচ্ছি এই ভালো। বলেই ফোন কেটে দিলো শুভ্র। সাথে সাথে রাজিবের ফোন।
কিরে মামা আজকের দিনে ফোনে বিজি তুমি? ঘটনাতো সুবিধার মনে হচ্ছেনা।
আরে রাখ তোর ফাজলামি। রাফার ফোন ছিল। আমাকে বলে ক্যাফে-৩৯ এ চলে আসতে। বাঁদরামির আর শেষ নাই।
বাঁদরামির কি আছে? আমিওতো তোকে এইজন্যেই ফোন দিলাম। চলে আয় মামা। তোর জন্যে সারপ্রাইজ আছে।
কিসের সারপ্রাইজ?
এলেই দেখতে পাবি। বলেই ফোন কেটে দিলো রাজিব।
সাথে সাথে আবার মনি আর সাগরের টেক্সট “বিকেল চারটার মধ্যে ক্যাফে-৩৯ এ চলে আসবি। দেরি করবিনা কিন্তু খবরদার।”
ভারি জ্বালাতো। কেউ ঠিকমতো কিছু বলছে না। আবার ফাজলামিও মনে হচ্ছেনা। কি করা যায়......
যাই ঘুরেই আসি, শুভ্র ভাবলো।
রাস্তায় একটু জ্যাম থাকায় শুভ্রর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে চারটা বেজে গেলো।
সরি দোস্ত একটু দেরি হয়ে গেলো।
এ আর এমন কি আমরাতো জানি এমনটাই হবে। ভার্সিটিতে তুমিতো সারাজীবন লেটকামারই ছিলে। বলে উঠলো মনি।
তবে হ্যাঁ এখন থেকে আর এমন দেরি করলে চলবেনা, বুঝেছ। ওঠো, এখন এই টেবিল থেকে উঠে ওই টেবিলে যাও। তোমার রাজকন্যা তোমার জন্যে আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে।
কি বলছিস এসব তোরা। ভ্যালেন্টাইনে আজকাল ড্রিঙ্কস করার ট্রেন্ডস চালু হয়েছে নাকি? এই রাজিব কি হয়েছে রে ওর?
ওই কিছু হয়নি। হবে তোর। ওই টেবিলে যাও তাহলেই বুঝবে চাদু।
আমি ওই টেবিলে যাব কেন? ভ্যালেন্টাইনে তোরা আমার সাথে ইয়ার্কি মারার জন্যে এভাবে ডেকে এনেছিস না? তোদের খেয়ে দেয়ে আর কোনও কাজ নেই নাকি।
এই রাফা যাতো ব্যাটাকে ওই টেবিলে রেখে আয়তো। বেশি বকবক করছে।
রাফা আর মনি একপ্রকার জোর করেই শুভ্রকে আরেকটা ডুয়েট টেবিলে নিয়ে বসিয়ে দিল।
টেবিলের ওইপাশে একটা মেয়ে একা বসে আছে। আরে! চমকে উঠলো শুভ্র। এতো লতা!
শুভ্র ঝট করে উঠে দাঁড়াল। কি ব্যাপার রাফা তোরা আমাকে এখানে নিয়ে এলি কেন? কি বিব্রতকর অবস্থায় ফেললি আমাকে বলতো। মেয়েটা একজনের জন্যে অপেক্ষা করছে আর তার সামনে আমাকে নিয়ে এলি।
আরে গাধা ও যার জন্যে অপেক্ষা করছে সে তো তুই-ই।
মানে?
মানে হল তুই যেমন মুখচোরা, তোর লতাও তেমনি মুখচোরা। ভালোই মিলবে তোদের। সেওতো তোকে মনে মনে ভালোবাসতো, কখনো বলার সাহস পায়নি। রাফা বলতে লাগল...... গত পরশু বিকেলে আমি তোর বাসায় গিয়েছিলাম। আন্টি বলল তুই একটু বাইরে গেছিস। তোর রুমে বসে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ তোর টেবিলের উপরে রাখা ডায়রির দিকে চোখ পড়লো। কি যেন একটা গল্প লিখছিলি। দু-এক পাতা উল্টাতেই পেয়ে গেলাম তোর লতা পাতার কথা। সেই এক বছর আগে লতাকে দেখার সেই প্রথম দিন স্যরি, দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু করে গত সপ্তাহে লতার জন্মদিন পর্যন্ত হাজার হাজার কথা লেখা। পুরো একটি বছর! এই যুগে এতোটা সময় মানুষ কি করে একা একা একজনকে ভালবেসে তাকে না বলে বসে থাকতে পারে? ওকে বলার সাহসটা পর্যন্ত পাসনি গাধা। অন্তত আমাদেরকে বলতে পারতি, আমরা না তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
ইয়ে মানে......
হয়েছে আর মানে মানে করতে হবেনা।
তোমার ভ্যালেন্টাইন এখন তোমার সামনে তার সাথে মানে মানে করো। আমরা কেটে পরি। আর হ্যাঁ, বেশি খুশি হবার কিছু নেই, আমাদের বিলটা আজ তোমাকেই মিটাতে হবে, বুঝেছ।
ইয়ে...... শোন......
এইযে......বসেন। টিস্যু নেন। এই এসির মধ্যেও ঘেমে গেছেন দেখি।
ও হ্যাঁ...... টিস্যু। দাও। সেই টিস্যু...... আবার আজকেও তুমি আমায় টিস্যু দিলে। তোমার মনে আছে এর আগেও একদিন তুমি আমায় টিস্যু দিয়েছিলে।
মনে আছেনা আবার? লুডু খেলার সময়।
তুমিও মনে রেখেছ। সব কেমন জানি স্বপ্নের মতো লাগছে। আচ্ছা আমি নাহয় মুখচোরা, তুমিওতো বলতে পারতে।
কি করে বলব, আপুর কাছে শুনলেন না আমিযে আপনারই মতন......
এখনো আপনি করে বলে যাবে?
ঠিকআছে তাহলে তুমি। ধ্যত তুমি বলতে কেমন জানি লাগছে।
আরে বলো, বলতে বলতে ঠিক হয়ে যাবে।
আচ্ছা আপনি... মানে... তুমি যে গল্পটা লিখছিলে সেটা শেষ করেছ?
উমম... শেষ করেছিলাম। তবে এখন গিয়ে শেষ প্যারাটা আবার নতুন করে লিখব। গল্পের নামটাও পাল্টাবো।
কি নাম ছিলো আগে?
না পাওয়ার গল্প।
আর এখন কি দিবে?
শেষ প্যারার গল্প।