১ সংখ্যাটি ১০০ এর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নয়। বরং ১ এর অবস্থান সঠিকভাবে না থাকলে (১ ০০ বা ১.০০ এমনটা হলে) ১০০ কে নিয়েই সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আবার ১০০ থেকে ১ যদি একদম বাদই চলে যায় তবে ১০০ আর ১০০ থাকেনা ৯৯ হয়ে যায়। আমাদের দেশে এই ‘‘১’’ এর অবস্থা এখন চরম সংকটের মুখে, ‘‘১’’ এখন আক্রান্ত আর অবহেলিত। ফলে ১০০-র অবস্থানও আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই এই ‘‘১’’।
আমরা জানি “বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য”। একটি দেশের বা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে ওই দেশের বা জাতিসত্তার বৈচিত্রের উপর। যে দেশে যত বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, যত বেশি বৈচিত্র আছে, তারা তাদের কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতিতে তত বেশি সমৃদ্ধ, উন্নত। আমাদের দেশেও এমন বৈচিত্র্যমণ্ডিত কিছু সত্তা আছে যাদেরকে আমরা বলি “সংখ্যালঘু”। প্রকৃতির নিয়মে, নির্বাচনী মৌসুমে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজকে আবারও আক্রান্ত। প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের উপর হামলা-নির্যাতনের ঝড় ঝাপটা যেন তাদের জন্য নিয়তির অমোঘ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দোষ তারা একটি নির্দিষ্ট পক্ষকে ভোট দেয়। তাদের দোষ তারা নিজের দেশের মাটিতে নিরাপদে সাধারণ মানুষ হয়েই বেঁচে থাকতে চায়। আক্রমণকারীদের আক্রমনের প্রধান কারণ সংখ্যালঘুদের একটি নির্দিষ্ট পক্ষকেই ভোট দেয়া। কিন্তু তারও তো একটা কারণ আছে, আক্রমণকারীরা তা খুঁজে বের করুক, নিজের দলকে সেভাবে তৈরি করুক যাতে সংখ্যালঘুরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারে, তাদের দলকে সমর্থন দেয়। তা না করে গৃহকর্ত্রী, কর্তার উপর রাগ করলে তাকে কিছু করতে না পেরে যেমন বাড়ির কাজের লোকের উপর রাগ ঝাড়ে তেমনি আমাদের উগ্র গোষ্ঠী প্রতিবার নির্বাচনের পর তাদের রাগ প্রদর্শন করে থাকে। সংখ্যালঘুরা হচ্ছে তাদের সেই রাগ ঝাড়ার জায়গা, তাদের মিথ্যে আস্ফলন দেখানোর জায়গা। গোষ্ঠী হিসেবেওতো সংখ্যালঘুরা এদেশে কারও জন্য হুমকি নয়। তারা তাদের কৃষ্টি-কালচার নিয়ে শুধু দুটো খেয়ে পড়ে ভালভাবে দিনযাপন করতে পারলেই খুশি থাকে, আমাদের দারিদ্রঘেরা অধিকাংশ বাঙালিরই যেটা চাওয়া। তারপরও কেন শুধু তাদের উপরই অত্যাচার নিপীড়ন?
আমরা কি কখনও খেয়াল করে দেখেছি যে, বারবার সংখ্যালঘুদের উপর এসব আক্রমণ হচ্ছে কেন? কেন হামলাকারীরা বারবার এসব করেও পার পেয়ে যাচ্ছে? কারণ সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, নেই কোন গোষ্ঠী, কোন প্রশাসন, কোন সরকার। অসাম্প্রদায়িকতার কথা এদেশে এখন ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। গত পাঁচ বছর ধরে এই নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়েছে। ক্যান্সারের মত সারা দেশে এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। যে সরকারকে সংখ্যালঘুরা তাদের জন্য নিরাপদ মনে করেছিল তারাও নীরব থেকেছে তাদের উপর আক্রমনের সময়। সাম্প্রদায়িক এসব হামলাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটেছে অথচ হামলা বন্ধের জন্য কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ তারা জানে যাই হোকনা কেন তাদের এই সংখ্যালঘুর ভোটব্যাংক অন্যত্র যাবার সম্ভাবনা আপাতত নেই। তাই আজ দেশের উগ্র হিংস্র একটি গোষ্ঠী হায়নার মত তার থাবা বসিয়ে দেবার সাহস পায় নিরীহ শান্তিপ্রিয় সংখ্যালঘুর উপর! কি চায় এসব উগ্র, ধর্মান্ধ আক্রমণকারীরা? তারা কি চায় বাংলাদেশ থেকে সব সংখ্যালঘু মানুষগুলো দূর হয়ে যাক। কোথায় যাবে? কেন যাবে? এদেশটা কি তাদের নয়? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে এই সংখ্যালঘুরাই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে আজকের এই সংখ্যাগুরু বাঙালীরই সাথে। তাহলে কেন তাদেরকে আজকে আবার একাত্তরের মত উদ্বাস্তু হতে হবে? এ প্রসঙ্গে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকাতে যাওয়া এক বড়ভাইয়ের হতাশাভরা ফেসবুক স্ট্যাটাসটা এখানে না দিয়ে পারছিনা। তিনি লিখেছেন-
‘‘বাবা-মা কে জিআরই ও টোফেল পরীক্ষা দেবার পরামর্শ দিলাম.........
মার খেয়ে, খালি হাতে ইন্ডিয়া যাবার চেয়ে ২৮ ইঞ্চি দুইটা লাগেজ নিয়ে ইউএসএ যাওয়া ভালো!’’
আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের বৃহৎ অংশটাই ভালো, শান্তিকামী এবং তারা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবই পোষণ করে থাকেন। শুধুমাত্র গুটিকতক উগ্র ধর্মান্ধ মানুষের কারণে সবাই দোষী হতে পারেনা। তবে তাদেরকে তাদের অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিতে হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মাধ্যমে, সংখ্যালঘুদেরকে মানুষ হিসেবে বাঁচবার সুযোগ করে দেবার মাধ্যমে। নাকি সংখ্যালঘুদের উপর হামলা তখনই বন্ধ হবে যখন এদেশে আর সংখ্যালঘুই থাকবেনা। যদি তা-ই হয় তবে বুঝব আমার বিশ্বাসে ভুল ছিল।