নেত্রী ১- এই কে ওখানে? এত রাতে কে ওখানে? সিকিউরিটি?
নেত্রী ২- অ্যা......কে? কার এত বড় সাহস আমাদের দুজনের মিটিংএর মাঝে আসিস?
সিদ্ধার্থ- আমি সিদ্ধার্থ।
নেত্রী ১- সিদ্ধার্থ? কোন সিদ্ধার্থ?
সিদ্ধার্থ- সেকি ম্যাডাম আমাকে ভুলে গেলেন? দুদিন আগেইতো আমি সবগুলো পত্রিকার শিরোনাম ছিলাম। আমি সিদ্ধার্থ চন্দ্র সরকার। পুলিশ কনস্টেবল।
নেত্রী ১- ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি......... রাজশাহীতে বোমার আঘাতে মারা যাওয়া সিদ্ধার্থ?
সিদ্ধার্থ- হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন ম্যাডাম।
নেত্রী ১- তা তুমি এখানে এলে কিভাবে? কি চাও তুমি?
সিদ্ধার্থ- না, আমি কিছু চাইনা। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম আমি কেন মারা গেলাম। বোমাটা বুকে এসে লাগার পর থেকে আর তো কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব অন্ধকার। আপনারা কেউ কি বলতে পারেন আমি কেন মারা গেলাম? কি অপরাধ ছিল আমার?
নেত্রী ১- না তোমারতো কোন দোষ ছিলনা। তুমি তো আমাদের, মানে সরকারেরই লোক ছিলে। এ সবইতো হয়েছে বিরোধী দলের জন্যে। তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির কারনেই তুমি এভাবে মারা গেলে।
নেত্রী ২- আরে থামেন। দোষ কি সব শুধু বিরোধী দলেরই। আপনাদের জন্যই তো এতকিছু হল। ছিয়ানব্বইয়ের জলজ্যান্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও তো আপনারা একদলীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছিলেন। আর তা দেখে আমরা হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকব ভাবলেন কি করে? আপনারা বসে ছিলেন ছিয়ানব্বইয়ে? আন্দোলন চললে এরকম কিছু জীবন তো যাবেই। এ আর নতুন কি? ছিয়ানব্বইয়ে আপনার আন্দোলনের সময় গেছে এখন আমার আন্দোলনেও যাবে, নাহলে আন্দোলন জোরদার হবে কি করে। এই তুমিতো দুইদিনের ছেলে তুমি এসব বুঝবানা। তুমি চলে যাও। আর আপনি ওর পরিবারকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দিয়েন।
নেত্রী ১- হ্যাঁ দেখছি, আমি দ্রুত সে ব্যবস্থা করছি। কি ঠিক আছেতো, না? কি যেন নাম বললে? আ.....আ...... সিদ্ধার্থ।
সিদ্ধার্থ- ......কি যে কষ্ট হচ্ছিল ম্যাডাম! বোমাটা যখন আমার বুকে বিস্ফোরিত হল, আমার ফুসফুস ছিদ্র করে দিল, কি অসহ্য যন্ত্রণা আমি আপনাদের বলে বোঝাতে পারবনা ম্যাডাম। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার। আপনারা কি একটু অনুভব করতে পারেন ম্যাডাম......... বোমাটা আমার বুকের ঠিক এই জায়গাটায় পড়েছিল...... দেখুন ম্যাডাম, দেখুন.........
নেত্রী ২- এই ছেলে এসব কথা বন্ধ কর এখন। এমনিতেই আমার হার্ট দুর্বল। সোজা সাপটা বল কি চাও। আমাদের খুব জরুরী মিটিং চলছে। দেশের মানুষের জন্য আমরা আজকে আলোচনায় বসেছি। সামনে আবার নির্বাচন হবে। দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা এখন অনেক ব্যস্ত।
সিদ্ধার্থ- আমি আর কি চাইব বলুন। দেশের মানুষের জন্য আপনারা ভাবছেন। আমি তো এখন আর মানুষই নই। তবে কদিন আগেও মানুষই ছিলাম। আমার ঘর ছিল বাবা, মা, ভাই ছিল, বউও ছিল- দীপ্তি ওর নাম। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা, বেশিদিন হয়নি। আমার একটা ছোট্ট স্বপ্নও ছিল ম্যাডাম। আমার বাবা মাকে একটু আর্থিক সচ্ছলতা দেয়া। খুব কষ্ট করে তারা আমায় বড় করেছিলেন। পুলিশের চাকরিটা হবার পর তারা খুব খুশি হয়েছিলেন। সংসারটা একটু সচ্ছল হবে, ছোট ভাইকে মানুষ করব এতটুকু আশাই তারা করেছিলেন। আমার স্বপ্নগুলো সব......... জানিনা আমার বাবা মা কি করে বেঁচে থাকবে বাকিটা জীবন। না জানি মা আমার চোখের জলে......... তারা আমায় অনেক ভালবাসতেন। জানিনা দীপ্তির কি হবে...... কিভাবে থাকবে পাগলীটা.........
নেত্রী ১- শোনো সিদ্ধার্থ...... স্বজন হারানোর বেদনা আমার থেকে আর কেউ ভালো জানেনা। সেই পঁচাত্তরে যখন......
নেত্রী ২- আরে রাখেন আপনার পুরানো ভাঙা রেকর্ড। আমি কি আমার স্বামীকে হারাইনি? এটা নিয়ে এত ইমোশনাল হওয়ার কি আছে? এখন ইমোশনাল হওয়ার সময় না বুঝছেন। এই ছেলেকে নিশ্চয়ই কেউ পাঠিয়েছে আমাদের আলোচনা ভণ্ডুল করার জন্য। নিশ্চয়ই এসব তৃতীয় কোন পক্ষের কারসাজি। অবশ্য হতে পারে এটা আপনাদেরই কারসাজি। আপনাদেরকে আমরা ভালো করেই চিনি। আপনারা.........
নেত্রী ১- চুপ করেন। জনগণ জানে কে কেমন। গত নির্বাচনেই তা প্রমাণ হয়ে গেছে।
নেত্রী ২- রাখেন আপনার পাতানো ইলেকশনের কথা। ওটা যে ইলেকশন নয়, সিলেকশন ছিল সেটা এখন প্রমাণিত। আর এজন্যই আবার নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবং এবার আমরা ক্ষমতায় আসছি। আপনারা যতই আর জনগণকে......
সিদ্ধার্থ- ......ম্যাডাম দয়া করে আমার কথাটা কি আপনারা একটু শুনবেন? জনগণের সেবার জন্য নিযুক্ত হয়েও কেন আমাকে মরতে হল বলতে পারবেন? আমাকে বলতে পারবেন কি আমার মত আর কতজন মানুষকে আপনাদের রাজনীতির বলি হতে হবে। আর কত দিন? একটি স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষের জীবন আর কতদিন আপনাদের দূষিত রাজনীতির হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে? আমাদের মরে যাওয়ার একটা কারণতো অন্তত থাকবে ম্যাডাম। আপনারা কি বলতে পারেন কি সেই কারণ.........
নেত্রী ১ ও নেত্রী ২- সিকিউরিটি.........এই সিকিউরিটি.........
সিদ্ধার্থ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
হ্যাঁ, এভাবেই সিদ্ধার্থরা হারিয়ে যায়। অন্ধকারে নয়, দিনের আলোতেই শতশত মানুষের ভিড় থেকেই হারিয়ে যায়। কিন্তু সিদ্ধার্থরা জানতে পারেনা কেন তাদের এভাবে চলে যেতে হয়। কি অপরাধ ছিল তাদের? কাকে দোষ দেবে সিদ্ধার্থ? যে বোমাটা ছুঁড়েছে তাকে? ওই লোকটিকে বোমা মারার জন্য যে নির্দেশ দিয়েছে তাকে? ওই লোকটি যে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে তাকে, তার প্রধানকে? নাকি যেই রাজনৈতিক দলের বিপরীতে তারা এমন মানুষ হত্যার কর্মসূচি চালাচ্ছে সেই দলের প্রধানকে? দোষ আসলে এদের একজনেরও না। সব দোষ সিদ্ধার্থের। কেন সে মানুষের সেবার জন্য পুলিশে যোগ দিয়েছিল? কেন সে স্বাভাবিক সুন্দরভাবে বাঁচতে চেয়েছিল? কেন সে বাংলাদেশের মত একটা দেশে জন্ম নিল, বাঁচার স্বপ্ন দেখল? দোষতো তারই হওয়ার কথা।
আপনি কে?
নিজেকে প্রশ্ন করুন।
আজকে হয়ত আপনি রাম সাম কিংবা যদু মধু কিছু একটা। কিন্তু কালকেই আপনার নাম হয়ে যেতে পারে সিদ্ধার্থ।
সিদ্ধার্থ কে? একজন পুলিশ কনস্টেবল। না হয়নি। সিদ্ধার্থ একজন পুলিশ কনস্টেবল ছিল। হ্যাঁ, অতীতকালেই লিখতে হবে। সিদ্ধার্থ এখন অতীতকাল। কালকে হয়ত আমি, পরশু আপনি যে কেউ যেকোনো সময় অতীতকাল হয়ে যেতে পারি। হয়ে যেতে পারি খবরের কাগজের গরম শিরোনাম কিংবা টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজ। দরকার শুধু ছুটে আসা একটি বোমার মরণস্পর্শ।
কিন্তু এমনটা কি হবার কথা ছিল?
নিশ্চয়ই নয়।
সিদ্ধার্থ আমার গ্রামের ছেলে। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ও আমার চেয়ে এক বছর জুনিয়র ছিল। আমার মনে পড়ে যখন আমরা স্কুলে পড়তাম তখন একবার সিদ্ধার্থদের পাড়ার সাথে আমাদের পাড়ার ক্রিকেট খেলা হয়েছিল। আমার মনে আছে সিদ্ধার্থ বড় বড় ছয় মেরে ওদের দলকে জিতিয়েছিল। এমনিতে খুবই ভদ্র ছিল ছেলেটা। দেখা হলেই আগ বাড়িয়ে কুশল বিনিময় করত সে। গত পূজাতে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সাথে ওর বউ দীপ্তিও ছিল। এর আগে ওদের দুজনকে একসাথে দেখিনি। সেবার দেখে মনে হয়েছিল বাহ দুজনকে বেশ মানিয়েছেতো। মারা যাওয়ার মাত্র দুদিন আগেও সিদ্ধার্থর সাথে আমার ফেসবুকে চ্যাট হয়েছিল। নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিল সে। ওর ফেসবুক নাম ছিল গৌতম রায়। ওর আরও একটা নাম আছে। আমরা গ্রামের সবাই ওকে সবুজ নামেই ডাকি। ও আমায় বলেছিল ও রাজশাহীতে আছে, ভালই আছে। সময় পেলেই বাড়ি যাবে। এই ছেলেটাই দুদিন পর হঠাৎ পত্রিকার শিরোনাম হয়ে গেল এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যে মেনেই নিতে পারছিলামনা।
আসলে এসবই সিদ্ধার্থর সাথে আমার স্মৃতির কথা। আরও অনেক স্মৃতিই ঘুরে ফিরে মনে আসছে। তবে ও এভাবে মারা যাওয়াতে বারবার আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে যে, এই ছেলেটা এভাবে কোন কারণ ছাড়াই মরে গেল? যেকোনো বয়সী মানুষের মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে ওর মত অমন তরুণ সতেজ একটা ছেলে যে কিনা সবেমাত্র জীবন শুরু করল তার ওভাবে মারা যাওয়াটা একটু বেশিই কষ্ট দেয়। ও মারা যাওয়াতে আমারই কত খারাপ লাগছে। তাহলে ওর পরিবারের অবস্থাটা এখন কি সেটা কি একবার চিন্তা করা যায়? আসলে প্রতিদিনই তো নানান রকম দুর্ঘটনায় কত লোক মারা যায়। আমাদের কাছে তারা কেবল সংখ্যা কিংবা খবরের শিরোনাম হয়েই থাকে। কেবলমাত্র কাছের কেউ হলেই তখন আসল দুঃখটা অনুভব করা যায়, সিদ্ধার্থ মারা যাওয়ায় যেটা আমি বুঝতে পেরেছি।
আমার এক বন্ধু সেদিন যখন জানল যে সিদ্ধার্থ আমার গ্রামের পরিচিত একজন তখন সে আশ্চর্য হয়ে বলল ‘‘কই তোকে তো দেখলাম না ফেসবুকে একটা পোস্ট দিতে’’। তার কথা শুনে আমি আরও বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বলে কি সে! আমি যেখানে এখনও কল্পনাই করতে পারছিনা সিদ্ধার্থ আর নেই সেখানে সে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কথা বলে। আমি অবাক হয়ে যাই যে মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়টি মানুষ এখন কত সহজভাবে নেয়। একটু শোক করারও সময় নেই আমাদের। দরকার শুধু খবর তৈরি করা আর দু কলম লিখে তার প্রচার করা। কেউ কেউ ভাবেন যে লিখলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। লিখে কি হবে। সরকার বড়জোর অপরাধীকে সাজা দিবে কিন্তু এতে সিদ্ধার্থ ফিরে আসবে না, পূরণ হবেনা তার পরিবারের শুন্যতা, কিংবা বন্ধ হবেনা এই লাশের মিছিল। আমাদের ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের কাছে মরে যাওয়া মানুষটির কিংবা তার পরিবারের আর্তচিৎকার এখন আর পৌছায়না। হয় তারা বধির হয়ে গেছে অথবা লাশের মিছিলই তাদের কাঙ্ক্ষিত। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তাদের রক্তের পিপাসা পায় আর এই রক্তের স্রোত বেয়েই তারা গণতন্ত্র(!) প্রতিষ্ঠা করে চলেন।
নতুন বছর শুরু হয়েছে, নতুন নতুন কত ইস্যু সামনে। নির্বাচন, পুনঃ নির্বাচন আরও কত নতুন নতুন কর্মসূচির আভাস চারিদিকে। সিদ্ধার্থ এখন শুধু পুরানো খবরই নয়, গত বছরের খবর হয়ে গেছে। দুদিন পরই তাকে ভুলে যাবে সবাই ইতোমধ্যে গেছেও অনেকে কারণ এ নিয়ে তেমন লেখালেখিও হয়নি। হবে কেন? সিদ্ধার্থতো সরকারের পুলিশ বহরের নিম্নপদস্থ একজন সাধারণ সদস্য মাত্র। সে মারা যাওয়াতে সরকারের শুধু একজন পুলিশ সদস্যই তো কমলো এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু সিদ্ধার্থের পরিবারের সবার স্মৃতিতে যে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেল তা কি কখনও মুছে যাবে? আমরা জানিনা। আমরা জানিনা আর কতজনকে এমন সিদ্ধার্থ হতে হবে। আর কতদিন চলবে এমন প্রতিহিংসার রাজনীতি যেখানে বলি হয় শুধু সাধারণ মানুষ। আমাদের নেতা নেত্রীগণ বোধহয় জানেন। আজ তারাই আমাদের ঈশ্বর, তারাই আমাদের নিয়ন্তা। জানিনা বেঁচে থাকতে বাংলাদেশে কখনও এমন সুস্থ রাজনীতির মুখ দেখতে পারব কিনা যেখানে ক্ষমতা নয়, মানুষের কথা আর দেশের কথা ভাবাই হবে রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য, আর রাজনীতিবিদদের জীবনের লক্ষ্য হবে মানুষের সেবা করা। নাকি আমাদের বাঙালি জাতির সে যোগ্যতাই নেই।
তাহলে বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তরের চেতনা এসবকি শুধুই ফ্লুক!