৬
দীপা আর আমি। মুখোমুখি বসে আছি। কফি হাউজে। জব ছাড়বার ডিসিশান চেঞ্জ করবে না। কিছুক্ষণ আলাপও হল। নাহ, বোঝানোর চেষ্টা করলাম না। আমি জানি, এই মুহূর্তে ও আমার সব কথারই বিরুদ্ধে যাবে। চুপচাপ কফি খাচ্ছে। একবার শুধু আমার দিকে তাকিয়েছিল। এরপরে আর তাকায়নি। অপেক্ষা করে আছে, আমি কিছু বলি কি না, সেজন্য। আমি বলছি না, কারণ, কফিটা শেষ করে, ওকে নিয়ে বেরোব। আমার পয়েন্ট অফ ভিউটা একটু সময় নিয়ে ওকে বোঝাতে হবে।
নাহ, এই মিটিঙটা লুবনা অ্যারেঞ্জ করেনি। ইয়েস, দীপা নিজে ফোন করে আমাকে এখানে আসতে বলেছে। নাহ, প্যাচ আপের চেষ্টা করতে না। ও এসেছে আংটি ফেরত দিতে। সেদিন আসলে ফোনে লুবনাকে পাইনি। লুবনাকে ফোনটা করেছিলাম, কারণ ভেবেছিলাম, লুবনাকে একটু রিকোয়স্ট করব, যেন দীপাকে বোঝায়। জবটা যেন না ছাড়ে। বাট, ব্যাপারটা ঘটেনি। লুবনা ফোন রিসিভ করেনি। বার দুয়েক ট্রাই করার পরও যেখন দেখলাম, ও রিসিভ করল না, তখন আর ট্রাই করিনি।
আসলে ওকে ফোন করেছিলাম, কারণ মনে হয়েছিল, অ্যাটলিস্ট শি উইল টক। স্পেশালি লুবনার সাথে সেদিনের এনকাউন্টারের পর। সময়টা খারাপ কাটেনি। আলাপচারীটাও মন্দ হয়নি। যদিও প্রাথমিক হালকা কথাবার্তার পরে যখন আমি আমার ট্রু ফিলিংসটা বলি তখন ও ভয়ানক বিগড়ে যায়। রাগে থরথর করতে করতে 'হাও ডেয়ার ইউ?' বলে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বাট...
ওকে, শুরু থেকেই বলি। যখন বললাম, ‘আই লাভ ইউ’ তখন একটা রাগ আমি এক্সপেক্ট করেই ছিলাম। বাট এতোটা না। ভেবেছিলাম, কেবল একটা ফ্ল্যাট ডিনায়াল দেবে। ‘আমার পক্ষে সম্ভব না’ জাতীয় কিছু একটা বলবে। এমন উত্তেজিত হয়ে যাওয়ায় আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। কফির বিল আমি জানি। সেটা টেবিলের ওপরে রেখে ওয়েটারকে ইশারা করলাম। এরপরে লুবনাকে ইশারায় দরজা দেখিয়ে নিজেও দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
কফি হাউজের বাইরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে টের পেলাম লুবনা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম
— এগিয়ে দিতে হবে?
লুবনা বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। এতকিছুর পরেও আমি কিভাবে এত শান্ত আছি? চোখে কিছুটা ক্রোধ থাকলেও একটু আগের ঘৃণাটা নেই। সামনে হাঁটতে শুরু করলাম। ফিল করলাম লুবনাও আসছে। একটু জোরে হেঁটে পাশে চলে আসল। ঘাড় আলতো ঘুড়িয়ে ওকে একবার দেখলাম। লুবনা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও সামনের দিকে তাকালাম। আমার গাড়ীটা যেখানে পার্ক করে রেখেছিলাম, হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে গেলাম। জানতে চাইলাম
— পৌঁছে দিয়ে আসব?
— না।
কথা আর না বাড়িয়ে গাড়ির লক খুলতে খুলতে বললাম
— বস।
লুবনা একবার আমার দিকে তাকাল। চোখে এখনও রাগ, তবে কিছুটা কম। সেদিকে তাকিয়ে আরেকবার রিকোয়েস্ট করলাম। সিটের দিকে ইশারা করে বললাম
— প্লিজ।
এবার কাজ হল। কি ভেবে বেশ রাগ নিয়েই গটগট করে হেঁটে গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসল। লুবনা উত্তরায় থাকে। সো রাস্তায় জ্যাম থাকলে ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে।
— শাড়ি কেনা তো ক্যানসেল… আই গেস
উত্তরে লুবনা কেবল আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে এক দলা ঘৃণা, ‘এই লোকের কি লজ্জা শরমও নাই?'
গাড়ি স্টার্ট দিলাম। কফি হাউজটা কলাবাগানে। আর সময়টা বিকেল অ্যান্ড অফিস ডে। সো, বেশ ভালভাবেই জ্যামে আটকালাম। রেডিও ছাড়লাম। আওয়াজ আস্তে রাখলাম। একবার পাশে তাকালাম। গম্ভীর মুখ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে লুবনা। জিজ্ঞেস করলাম
— এখন?
ঝট করে আমার দিকে তাকাল লুবনা। দৃষ্টিতে রাগ আর অবাকের কম্বিনেশান। বলল
— এখন মানে?
— মানে, এখন কি করতে চাও?
— কি ব্যাপারে?
— আমার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে চাও?
লুবনা এবার ফেটে পড়ল।
— আপনি একটা কি? আপনি ভাবলেন কি করে…
— আমি কিছুই ভাবিনি। আই জাস্ট টোল্ড ইউ দ্যা ট্রুথ।
— তাহলে জিজ্ঞেস করছেন যে?
— জানতে চাইছি, এতো সব ঘটনার পরে, আমার সাথে কি আর সম্পর্ক রাখবে?
লুবনা এবার বেশ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। বলল
— যদি না বলি?
— দেন, ইট ইজ ওভার। আমি আর কখনও তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করব না।
-- আর ইউ ম্যাড? এভাবে হবু কনের বান্ধবীকে কেউ প্রপোজ করে?
লুবনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এরপরে জানতে চাইলাম
— সেক্ষেত্রে আমার সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
— কি?
— হোয়াট স্যুড আই ডু?
— মানে?
— মানে এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে বিয়ের কিছুদিন আগে আমি আরেকটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যাই, আমার কি করা উচিৎ?
জ্যাম কেটে গেছে। তাই লুবনার দিকে তাকাতে পারছি না। যদিও প্রশ্নটা করার সময় সামনের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, এখন সামনে দেখছি। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, লুবনা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতোটাই অবাক হয়েছে যে, উত্তর দিতে পারছে না। কিছুক্ষণ লাগল, নিজেকে সামলে নিতে। এরপরে বলল
— দীপার প্রতি ফিলিংসটা তাহলে কি ছিল?
— আই থট, ইট ওয়াজ লাভ, বাট…
— বাট?
— বাট তোমাকে দেখার পরে আবিষ্কার করলাম, ইট ওয়াজন’ট। ইট ওয়াজ… আই গেস… পছন্দ কিংবা ভাল লাগা টাইপ কিছু।
— তাহলে এবার কিভাবে সিওর হচ্ছেন, যে এটা সত্যিকারের ‘লাভ'?
— বিকজ দিস টাইম দ্যা ফিলিং ইজ ডিফ্রেন্ট। ইট নেভার হ্যাপেন্ড বিফোর।
— আপনার সো কলড ‘প্রেম’ ফিলিংটা যদি এতোটাই ভোলাটাইল হয়, আজ মনে হয় প্রেম, কাল মনে হয় ভাল লাগা, দেন ইউ স্যুড নেভার ম্যারি অ্যা গার্ল। দেখা যাবে বিয়ের তিন দিন পরে আরেকজনকে দেখে মনে হবে এটাই আসল প্রেম।
রাগে ফুঁসছিল লুবনা। ওকে শান্ত হওয়ার সময় দিলাম। এরপরে বললাম
— প্রেমে পড়েছেনকখনও?
— নান অফ ইয়োর বিজনেস।
— ওকে। ক্যান ইউ গ্যারান্টি, নিজের স্বামী ছাড়া, জীবনে কখনও অন্য পুরুষকে ভাল লাগবে না।
ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। উত্তরে সম্ভবতঃ ‘হ্যাঁ' বলতে যাচ্ছিল। কি ভেবে থেমে গেল। এরপরে বলল
— হোয়াট ইউ রিয়েলি ওয়ান্ট টু মিন?
— বলতে চাইছি, একটা রিলেশানশিপে থাকাকালীন যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেল, তখন কি করবে?
— রিলেশানশিপ ইজ অ্যা কমিটমেন্ট।
— মানলাম। কমিটমেন্ট রাখা গেলে তো অবশ্যই ভাল। বাট রাখা না গেলে?
লুবনা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। শেষ মুহূর্তে বোধহয় বুঝতে পারল, ‘রিলেশানশিপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ’ কথাটা বললে, আমার অবস্থানকেই সাপোর্ট করা হয়। আর ‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ’ বললে পরের প্রশ্নটা হবে ‘যদি সেটা করা না যায়?’ নেভার এন্ডিং একটা পাজলে ঢুকতে হবে আর যার সত্যিকারের কোন সলিউশান নেই। মুখ আবার ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে গাড়ি মহাখালী চলে এল। ফ্লাইওভারে উঠলাম। লুবনা আর কথা বলছে না। আমিও চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছি। লুবনা ব্যাপারটাকে বেশ পার্সোনালি নিয়ে ফেলেছে। পুরো ঘটনার জন্য প্রবাবলি ও নিজেকে দায়ী করছে।
ফ্লাই ওভারটা ফাঁকা। তাই লুবনার দিকে তাকাতে পারছি না। সামনের দিকে দেখছি। এমন সময় লুবনা বলে উঠল
— আমার সাথে যদি এমন কেউ করত, আমি ওকে খুন করে ফেলতাম।
কথাটা শুনে হাসি পেয়ে গেল। উত্তরে কিছু না বললেও ঠোঁটের কোণে হাসিটা থেকে গেল।
— হাসছেন যে?
ফ্লাইওভার থেকে নেমে গেছি। বেশ জ্যাম। গাড়ী নড়ছে না। তাই এবার লুবনার দিকে তাকালাম। মুখে হাসি নিয়েই বললাম
— কারণ কথাটা হাস্যকর।
কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিগন্যাল গ্রিন হয়ে গেছে। আবার স্যামনে তাকাতে হচ্ছে। বনানী পেরিয়ে রাস্তা আবার খানিকটা ফাঁকা পেলাম। লুবনার দিকে এক ঝলক তাকালাম। রাগে গাল লাল হয়ে আছে। বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে নিজেকে সংযত করবে। আবার সামনের দিকে তাকালাম। টপিক চেঞ্জ করা দরকার। ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টারি পড়ার সময়কার খবর জানতে চাওয়া যায়। কথা বলতে যাব এমন সময় লুবনা বলে উঠল
— কেন হাস্যকর?
— আইনের মানুষ হয়ে এমন কথা বললে যে কেউ হাসবে। আচ্ছা, সত্যি সত্যি বলুন তো, খুব রেগে গেলও কি পারবেন কাউকে খুন করতে?
রাগী চোখে তাকাল লুবনা। তবে এবার রাগ কিছুটা কম। ‘খুন করার’ কথাটা বলে একটা লাভ হয়েছে। রাগ প্রকাশ করতে পেরে কিছুটা রাগ পড়ে গেছে। লুবনা কিছু বলছে না দেখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
— আপনি এই মুহূর্তে যা করলেন তা হচ্ছে, রাগের মাথায় প্রবলেমটার একটা ইম্পসিবল সলিউশান দিলেন। আর আমি যা করেছি, তা হচ্ছে, ঠাণ্ডা মাথায়, ভেবে, প্রবলেমটার এমন একটা সলিউশান বের করেছি। আমার সলিউশানের সুবিধা হচ্ছে, এখানে অনেকে কষ্ট পাবে ঠিকই, তবে সবাই আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পাচ্ছে।
— এই বিষয়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলাম। বাকী রাস্তা বেশ অনেকটাই ফাঁকা ছিল আজকে। দেখতে দেখতে এয়ারপোর্ট চলে আসলাম। বার কয়েক লুবনার দিকে তাকালাম। চেহারা এখন অনেকটাই শান্ত। আবার কিছু বলব কি না ভাবছি, এমন সময় লুবনা নিজেই বলল
— আই হ্যাভ অ্যা ক্র্যাশ।
বেশ অবাক হলাম। আনএক্সপেক্টেড। এভাবে নিজের পার্সোনাল কথা আমার সাথে শেয়ার করবে ভাবিনি। তবে আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। লুবনার দিকে তাকালাম। ও সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল, বাকীটা বলবে না। কথাটা আমাকে বলার উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ বুঝিয়ে দেয়া ‘লাভ নেই’। ঠিক যখন ভাবছিলাম বাকীটা বলবে না, তখনই ও বলে উঠল।
— সো, এনগেজমেন্ট ভাঙলেও…
বাকীটা আর বলল না। মাথা দুদিকে নেড়ে বুঝিয়ে দিল, ভ্যাকেন্সি ফিল আপ। আমার সুযোগ নেই। তথ্যটা জানানো জরুরী ছিল না। কিন্তু ওর বলার ভেতরে কোথায় যেন একটা হিন্ট ছিল। মনে হল, ও অন্য কিছু বোঝাতে চাইছে।
লুবনাদের উত্তরার বাসাটা আমি চিনি না। তাই জিজ্ঞেস করতে হল
— এবার কোনদিকে?
লুবনা দেখিয়ে দিল। গাড়ী ঘোরালাম। লুবনা ‘রাইট’ কিংবা ‘লেফট' বলে আমাকে ডিরেকশান দিতে থাকল। একসময় পৌঁছে গেলাম। গাড়ির দরজা খুলে নামল। এরপরে এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। ভেতরে আসতে বলবে কি না ভাবল বোধহয়। তবে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ঝুঁকে মুখটা গাড়ির কাঁচের কাছে এনে ‘থ্যাংকস' বলল।
এরপরে ঘুরে গেল। দরজায় গিয়ে আবার ফিরে তাকাবে কি না দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম। করল না।
গাড়ী ঘুরিয়ে নিলাম।
এমন সময় মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসল। লুবনা করেছে। ছোট্ট বক্সটায় লেখাটা জ্বলছে
‘অ্যান্ড হি ইজ ম্যারিড’।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০১