৫
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, সেটাই হল। দীপা রিজাইন করল। পরের দিনই। নাহ, কোন জব অফার পেয়ে ছাড়েনি। এমনি ছেড়েছে। আমি পরের দিন অফিসে দৌড়েছিলাম, এনগেজমেন্ট উপলক্ষে নেয়া ছুটিটা এক্সটেন্ড করতে। ঠিক করেছিলাম, কক্সবাজার ঘুরতে যাব। বাট, গিয়ে জানতে পারলাম, দীপা মেইলে রিজাইন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।
ব্যাপারটা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই দীপাকে ফোন করলাম। সুইচড অফ। এক্সপেক্টেড। সম্ভবতঃ বাসায় গিয়েই দীপা আমাদের ব্রেকাপের ঘটনাটা জানায়। আর তার পর থেকে, আমি নিশ্চিত, কাছের দূরের আত্মীয় থেকে শুরু করে সব বন্ধু বান্ধব ‘কেন' জানতে ফোন করা শুরু করা দেয়। বিরক্ত হয়ে…। অর্থাৎ বেশ বিচ্ছিরী অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে দীপা।
মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। দীপার কষ্ট পাওয়াটা পর্যন্ত আমি মেনে নিতে পারছি, বাট এভাবে, আমার জন্য, এতো ভাল চাকরি ছেড়ে দেয়াটা মেনে নিতে পারছি না। যেভাবেই হোক ব্যাপারটা থামাতে হবে। জাস্ট কিছুদিনেরই তো ব্যাপার। এরপরে সবাই এসব ভুলে যাবে। কি করব দ্রুত ভাবলাম। ওর বাসায় যাওয়া যায়, বাট ওখানে এক বিচ্ছিরী জেরার মুখে পড়ব। অনলি অপশান ইজ… ইয়েস...লুবনা। আই থিঙ্ক ও ই কেবল ওর বাসায় গিয়ে ওকে বোঝাতে পারে। অ্যাট লিস্ট ব্যাপারটা নিয়ে ওকে রিকোয়েস্ট করা যায়। মন বলছে, আমার রিকোয়েস্ট অনার করার জন্য না হলেও দীপার জন্য কাজটা ও করবে।
লুবনার ফোন নাম্বার? লুবনাই দিয়েছে। লুবনার সাথে আমার ‘হাই হ্যালো'ও সেদিন হয়েছিল। ইনফ্যাক্ট, ইট ওয়াজ মোর দ্যান দ্যাট। সেদিন যখন বুঝলাম, অ্যাভয়েড করা যাবে না, তখন ঘুরে দাঁড়ালাম। লুবনা এগিয়ে আসছে, নিজের অজান্তেই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম। হার্ট তার আওয়াজ করার মাত্রা ছাড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে আশে পাশের সবাই শুনে ফেলছে। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যে লাভ নেই, তা আমি জানি। তাই চেষ্টাও করলাম না। চুপচাপ অপেক্ষা করলাম
— চলে যাচ্ছেন যে?
উত্তর না দিয়ে লুবনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আসলে কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 'দীপা আমার প্রেমে পড়ার কাহিনী শুনে মন খারাপ করে চলে গেছে, লুবনার সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি করার জন্য একটা অপশান রেখে গেছে’, এমন সব কথা এখন বলতে মন চাইছে না। কিছু একটা এক্সকিউজ দেখিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে চাইছি।
কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। কেন জানি না, মনের সাথে কণ্ঠনালী কো অপারেট করছে না। দেখা গেল, মুখে কিছু না বলে লুবনার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন আচরণ সম্ভবতঃ এক্সপেক্ট করেনি লুবনা। ওর চাহনিতে কেমন একটা অবাক ভাব চলে এল। আমার চলে যাওয়ার চেয়ে বেশি অবাক হল বোধহয় আমার আচরণে। চোখের কোণ কিছুটা দুষ্টুমি নিয়ে বলল
— আপনি কি সব মেয়েকেই এভাবে স্টেয়ার করেন?
কথাটায় অভিযোগ ছিল না। কেমন একটা হালকা ভাব ছিল। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। কিছু একটা বলে বিদায় নেয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দিলাম।
মনে হল, এই স্টেয়ার করাটা ও এঞ্জয় করেছে। হার্ট জানান দিচ্ছে, গো অ্যাহেড। কথাগুলো বলে ফেলা যায়। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে দুষ্টুমির একটা হাসি এসে গেল। বললাম
— না। ফার্স্ট টাইম।
এবার বেশ অবাক হল লুবনা। চোখে অবিশ্বাস আর ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি টেনে বলল
— ফার্স্ট টাইম?
—ইয়েস
— অ্যান্ড ইউ ওয়ান্ট মি টু বিলিভ দ্যাট।
লুবনার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে ও ব্যাপারটা নিয়ে খানিকটা দুষ্টুমির মুডে আছে। গল্পটা করতে আমারও মন চাইছে। ইচ্ছে হচ্ছে… জানি না কি হবে, গাট ফিলিংস বলছে… শি ইজ ইন গুড মুড। গল্প লম্বা চলবে। কথাটা বলেই ফেললাম
— বাকী গল্প ভেতরে গিয়ে করি?
লুবনা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। দুজন কফি হাউজের দিকে এগিয়ে গেলাম। কফি হাউজটাতে ঢুকে আগের টেবিলেই বসলাম। লুবনাও বসল। এবার কথাটা জানতে চাইল
— দীপা?
লুবনার দিকে তাকালাম। কথাটা কি এখন বলব? না আরেকটু পরে। এখন বলার একটা সমস্যা হচ্ছে, ভায়োলেন্ট রিয়াকশান হতে পারে। সেটা অ্যাভয়েড করার উপায় হচ্ছে, কাহিনী ঘোরানো। বলব, তবে এখান থেকে বেরিয়ে, ফেরার পথে। তাই কফি অফার করলাম
— কফি?
সুন্দর একটা স্মাইল দিল।
— আপত্তি নেই।
এরপরে এদিক ওদিক তাকাল।
— জায়গাটা মন্দ না। এখানেই নাকি প্রেম পর্ব চলেছিল আপনাদের?
জায়গাটা যে আমার আর দীপার স্মৃতি বিজড়িত, এনিয়ে আলাপ করার সময় এটা না। লুবনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। লুবনা তখনও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। কফি হাউজটার ডেকোরেশান দেখা শেষ হয়নি। ডেকোরেশানের সাথে বিভিন্ন কাপল গুলোর উপরও একনজর বুলিয়ে নিচ্ছে।
আরও একটা কাজ করছে। সিওর না, বাট আই গেস, আমার স্টেয়ার করাটা ও এঞ্জয় করছে। আমার দিকে তাকালেই আমি চোখ নামিয়ে নেব, ও জানে। সেটাই ও চাইছে না।
হঠাৎ ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লুবনা। ফোনে নাম্বার সার্চ করতে করতে বলল,
— দীপাকে বলেছিলাম, আমি আসছি। তারপরও…
— ও দায়িত্বটা আমাকে দিয়ে গেছে।
লুবনা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
— মানে?
— মানে মার্কেটে গিয়ে শাড়ি কিনতে আপনাকে হেল্প করার কাজটা আমাকে করতে বলেছে।
লুবনা বেশ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকাল। তারপরে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির একটা হাসি টেনে বলল
— আপনার মত মেয়েদেরকে স্টেয়ার করা পুরুষকে এভাবে একা ছেড়ে দিল?
কথাটা মিন করল কি না জানি না। মনে হল, দুষ্টামি। উত্তরে আমিও হয়তো দুষ্টামি করতে পারতাম, বাট কথাটার ভেতরে কিছু একটা ছিল। মনে জোরে একটা ধাক্কা লাগল। দুষ্টুমির ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। অল্প হলেও ইচ্ছেটা জাগল, কথাগুলো বলেই ফেলি। পারলাম না। বরং চেয়ারে হেলান দিলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে বললাম
— আপনার সম্পর্কে জানা হয়নি।
ঘাড় কাত করে কেমন একটা দুষ্টুমির এক্সপ্রেশান দিল। এরপরে মুখে সেই অপূর্ব স্মাইল টেনে বলল
— বলুন, কি জানতে চান?
ইশারায় মোবাইলটা দেখালাম। লুবনা আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির একটা হাসি দিল। এরপরে বলল
— সেভ করুন…
সেভ করলাম। এবার আমার মোবাইল থেকে ওকে একটা রিং দিলাম। রিং বাজলে বললাম
— আমার নাম্বার।
সেটার দিকে এক নজর তাকিয়ে মাথা ঝুকাল। ঠোঁটের কোণে হাসিটা এসেই মিলিয়ে গেল। এরপরে আমার দিকে তাকাল। আমিও লুবনার দিকে তাকালাম। আমার চোখে এবার অন্য দৃষ্টি। সেই এনগেজমেন্ট ডে’র ‘সুবিধার না’ চাহনি। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে লুবনা ভ্রু কুঁচকালো। এরপরে চোখ নামিয়ে খুব মৃদু স্বরে জানতে চাইল
— আই থিঙ্ক আমার এখন ওঠা উচিৎ।
কথাটা বলার পরেও ও বসে থাকল। মাথা নীচু। আমিও বেশ কিছুক্ষণ লুবনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে বললাম
— একজন স্টেয়ার করা পুরুষকে ভয় পাচ্ছেন?
কথাটা শুনে লুবনার ভ্রু কুঁচকে গেল। এটা অন্যরকম অবাক হওয়া। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপরে মাথা নীচু করে কি যেন ভাবল। এরপরে আলতো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। একটা এম্ব্যারাসড টাইপ হাসি দিয়ে বলল
— আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং।
মুখে না বললেও মনে মনে বললাম, জানি। এও জানি তোমার ক্যারেকটারটা দুষ্টুমি করা টাইপ। কিংবা বান্ধবীর হবু বর ভেবে এসব বলছিলে। যে কারণেই করে থাকো, আমি যে সিরিয়াস, সেটা ওকে ক্লিয়ার করে দেয়া উচিৎ। সিদ্ধান্ত নিলাম, কথাগুলো আজই বলব। পরে বললেও হয়তো চলত, তারপরও মুখ গম্ভীর করে বললাম
— বাট আই ওয়াজন’ট।
এবার লুবনা বেশ ভালো রকম অবাক হল। মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বোঝার চেষ্টা করছে আমি কি বলতে চাইছি। আমিও তাকিয়ে থাকলাম। ভ্রু কুঁচকে লুবনাই প্রথমে কথাটা বলল
— মিন?
লুবনার দিকে সরাসরি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে বেশ স্পষ্ট করে ধীরে ধীরে কথাগুলো বললাম
— উই জাস্ট ব্রোক।
ভূত দেখার মত করেই চমকে উঠল লুবনা। প্রথমটায় মুখে কথা ফুটল না। এরপরে নিজের অজান্তেই বলে ফেলল
— কি বলছেন এসব?
— ট্রুথ।
লুবনার হতবাক হওয়া চরমে উঠল।
— মানে?
আমি উত্তর না দিয়ে কেবল ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এর মানে হচ্ছে, ‘আই হ্যাভ নাথিং নিউ টু সে’। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লুবনা অস্থির হয়ে উঠল। বলল
— আই ওয়ান্ট টু মিন… কেন? মানে হঠাৎ কি হল?
— হঠাৎ
কথাটা বলে কিছুক্ষণ থামলাম। আমার বাকী কথাটা শোনার জন্য অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল লুবনা। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম
— গতকাল আমি জীবনে প্রথমবারের মত প্রেমে পড়ি।
লুবনা সম্ভবতঃ প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারল না, আমি ফাজলামি করছি কি না। ‘কি বলছে এসব’ টাইপ একটা এম্ব্যারাসিং হাসি দিল। তারপরে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল, আই অ্যাম সিরিয়াস। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। মুখে কথা আসছে না, আই গেস। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কি বলবে। ওকে সুযোগ না দিয়ে আমি আমার কথা কন্টিনিউ করলাম। বললাম
— আর সেটা অন্য একজন মেয়ের। অ্যান্ড দেন আই ডিসাইডেড টু… ব্রেক আপ।
লুবনা এতোটা অবাক বোধহয় জীবনে কখনও হয়নি। এনগেজমেন্টের পরের দিন ব্রেকাপের মত ঘটনা, জীবনে কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না। হতবাক ভাবটা এতোই বেশি যে, মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাই আমিই কথা বললাম
— জানতে চান, মেয়েটা কে?
আমার বলায় সম্ভবতঃ কোন হিন্ট ছিল। হতবাক ভাবটা হঠাৎ করেই কেটে গেল। শুধু তা ই না, আই থিঙ্ক, উত্তরটা লুবনা আঁচ করেও ফেলল। ওর চোখে হতভম্ব ভাবের বদলে সন্দেহ জেগে উঠল। মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মুখের মাংসপেশীর শক্ত হয়ে ওঠাটা স্পষ্ট টের পেলাম। ছোট্ট করে শুধু বলল
— না।
বড় করে একটা নিঃশ্বাস টেনে উত্তর দিলাম
— বাট ইট’স ট্রু। আই লাভ ইউ।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৪