২
আর কিছুক্ষণের ভেতরে দীপা আসবে। অবশেষে ফোনটা করেছিলাম। গতকালকেই করেছিলাম। দীপা বেশ অবাক হয়েছিল। নাহ, ফোন করার জন্য না, অবাক হয়েছিল, এমন জরুরী তলব করছি দেখে। আমার গলার আওয়াজেো হয়তো কিছু ছিল। দীপা সম্মতি জানাল।
এনগেজমেন্ট উপলক্ষে আজকে অফিস থেকে দুজনেই ছুটি নিয়েছিলাম। এমনটা না হলে হয়তো কথাগুলো অফিসেই বলা যেত। আগামীকালও বলা যেত। অফিসে। বাট, আমি সেই ধাতুতে তৈরি না। আমার এক্ষুনি বলা চাই। গতকাল রাত কিভাবে কাটিয়েছি, আমিই জানি। বিছানায় এপাশ ওপাশ অ্যান্ড রিহার্সেল। কিভাবে শুরু করব। কি কি বলব। কখন দীপার হাতে হাত রাখব। কখন চোখে চোখ রাখব।
ঘড়ির দিকে একবার তাকালাম। এখনও মিনিট পনের দেরী আছে। এই ফাঁকে গতকালকের বাকী গল্পটা সেরে ফেলি। কোথায় ছিলাম যেন? হ্যা। দীপা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছে।
ড্রয়িং রুমে আমরা যারা আছি সবাই নড়ে চড়ে বসলাম। আমার পাশের সোফা ফাঁকা করা হল। এমন সময় দীপা আর লুবনা দরজায় এসে দাঁড়াল। নামটা এখন বলছি ঠিকই, তবে নামটা আমার অজানা ছিল। ইভেন লুবনাকেও আমি আগে কখনও দেখিনি। সেই মুহূর্তে আমার রিয়াকশান ছিল, কে এই অপরুপা? প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষনের ভেতরেই পেয়ে গেলাম। লুবনা হচ্ছে দীপার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড। ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড গিয়েছিল। সম্প্রতি ফিরেছে।
দীপার অন্য সব বান্ধবীদের আমি চিনি, এমন দাবী করছি না। কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছে। কেউ কেউ ‘দুলাভাই’ হিসবেও ডাকে। বাট, সামহাও, এই লুবনা নামক অপরুপার মুখোমুখি আজই প্রথম হলাম। আর আবিস্কার করলাম, ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। নট অনলি দ্যাট, আই হ্যাভ ফলেন ইন লাভ।
একটা সময় নিয়ম ছিল, মেয়ের সুন্দরী বোন থাকলে, ওরা মেয়ে দেখার সময় সামনে আসত না। নানী দাদী মার্কা মানুষগুলো বংশ পরম্পরায় এই নিয়ম চালু রেখেছিলেন। ব্যাপারটা আজ মেইনটেইন করা হয়নি। কারণ উনাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল, ছেলে আর মেয়ে যেহেতু নিজেরা নিজেদের পছন্দ করেছে তাই এমন কিছু ঘটবে না। বাট...
বিচ্ছিরী শোনাচ্ছে, আমি জানি। বাট কি করব? কথাটা তো মিথ্যে না। ইট’স ট্রু। ‘অনুচিত’, ‘কি বলবে সবাই’, ‘ছি ছি’ এসব রিয়াকশানের কথা মাথায় আসেনি, তা না। কাজটা যে একটা জঘন্য কাজ, সেটা না বোঝার মত ইডিওট আমি না। তারপরও ঘটনাটা ঘটে গেল। অ্যান্ড লাভ ইজ লাইক দ্যাট। ইট হ্যাপেন্স।
লুবনা আমার দিকে তাকিয়ে একটা সোশ্যাল স্মাইল দিল। হার্ট বিট জানিয়ে দিল, সামথিং হ্যাপেন্ড ইনসাইড মি। স্মাইল ব্যাক করলাম। এরপর থেকে শুরু হল, লুকোচুরি খেলা। অবশ্যই ওয়ান সাইডেড। বিভিন্ন টালবাহানায়, দীপাকে ছেড়ে লুবনার দিকে তাকাতে লাগলাম। দীপা পরিচয় করিয়ে দিল
--লুবনা।
প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি আন্তরিক হয়ে জানতে চাইলাম
--আপনার সাথে পরিচয় হয়নি কেন?
--কারণ, আপনি এখনও কোন ক্রাইম করেননি।
আবার স্মাইল। আবার ফোর্সফুল হার্ট বিট। তবে ব্যাপারটা এঞ্জয় করবার সুযোগ পেলাম না। চারপাশ থেকে তাগাদা আসল। ‘তাড়াতাড়ি’। রুম ভর্তি লোক। আংটি পড়ানো দেখবার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে। আমার হাতে আংটি দেয়া হল। দীপা আঙ্গুল এগিয়ে দিল।
নাহ। অঘটন যা ঘটবার মনের ভেতরেই ঘটেছে। বাইরের ঘটনাগুলো যেমনটা হয়, সেভাবেই, রুটিন মাফিক ঘটতে থাকল। আংটি পড়ানোর পরে শুরু হল করতালি। তার আগে অবশ্য কিছুটা নাটক করতে হয়েছিল। ফটো শ্যুটের জন্য। আংটি পড়িয়ে, সেটা ধরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। লুবনার চোখের দিকে তাকালাম। বান্ধবীর জন্য আনন্দ ছিটকে বেরোচ্ছে।
দেন... বাকী ঘটনাগুলো ঘটল। কেক কাটা। একে অপরকে খাওয়ানো। এক ফাঁকে মা এসে নেকলেস পড়ালেন। শুরু হল ডিনার টাইম।
এরপরের কাহিনীতে উল্লেখ করার মত কিছু নেই। দীপা ভেতরের ঘোরে চলে গেল। ওখানে খাবারের ব্যাবস্থা। ও সারাটা ক্ষণ ব্যস্ত ছিল গেস্টদের দেখা শোনায়। লুবনাও হেল্প করছে। ঘরের মেয়ের মত এটা সেটা এনে টেবিলে সার্ভ করছে। ‘আরেকটা রোস্ট দিই?’ টাইপ ফর্মালিটি। এরপরে, যথারীতি বিয়ের বাকীসব ব্যাপার নিয়ে আলাপ শুরু হল। গেট ধরায় কত দিতে হবে, হাত ধোয়ানো...
আমার মাথায় তখন ঝড় চলছে। দুটো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। দীপাকে সব খুলে বলব। আর এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে ফেলব। যে সিদ্ধান্তটা নেয়া বাকী ছিল, তা হচ্ছে, কখন বলব। একটা ব্যাপারে সিওর ছিলাম, কথাগুলো সামনাসামনি বলব। গতকাল বলার পরিবেশ ছিল না। তাই...
একটা রিকশা এসে থামল। মনে হচ্ছে দীপা। হ্যা দীপাই। রিকশা থেকে নামল। হালকা নীল রঙের একটা শাড়ী পড়েছে। বেশ সুন্দর লাগছে। এই কফি হাউজটা অফিসের একেবারে কাছে। এখানেই আমরা গত দেড় বছর অবসর সময় কাটিয়েছি। আজ এখানেই হতে যাচ্ছে আমাদের বিচ্ছেদ।
নাহ। আপনারা যা ভাবছেন, তা না। আমি সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করা টাইপ না। বলতে পারেন, দীপার ব্যাপারে তো চেঞ্জ করলাম। ব্যাপারটা আসলে তা না। লুবনাকে দেখার পরে আমার যে অবস্থা হয়েছিল, দীপার জন্য এমনটা আমার কখনই হয়নি। দ্যাট মিনস, আই নেভার লাভড দীপা। দেন, হোয়াট ওয়াজ দ্যাট? অনেস্ট উত্তর, জানি না।
দীপার সঙ্গ ভাল লাগত। গল্প করতে ভাল লাগত। এক্সাইটেডও ফিল করতাম। গত এক বছর অন্য কোন মেয়ের জন্য ট্রাই করিনি। ইভেন লুবনাকে দেখার আগে পর্যন্ত আমি নিজেও জানতাম না, প্রেম কি?
এবার প্রশ্ন হল, কেন দীপার মন ভাঙছি। কেন ওকে আঘাত দিচ্ছি। ওয়েল, এটার অ্যান্সারও একই। অনেস্টি। মনে অন্য কাউকে রেখে দীপার সাথে রিলেশানশিপ কন্টিনিউ করাটা কি ঠিক হত? বলতে পারেন, আই স্যুড ট্রাই। না। এব্যাপারে আমি রিজিড। জীবন একটা। লিভ ইওর লাইফ।
হ্যা, বলতে পারেন দীপার কি হবে। বলুন। কি হবে? কিছুদিন কাঁদবে, মনে খারাপ হবে, ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে, ব্লা ব্লা ব্লা। হ্যা হবে। বাট কতদিন? বড়জোর একবছর। এরপরে? ইয়েস। সি উইল স্টার্ট এগেইন। দীপা সুন্দরী। অ্যান্ড অবশ্যই ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল। ওর বিয়ে কিংবা প্রেম, কোনটাই আঁটকে থাকবে না।
নাও দ্যা ভাইটাল কোয়েশ্চেন। এসব জানবার পরে লুবনা কি আমাকে ভালবাসবে? লজিক বলে, ‘না’। শুধু তা ই না। লুবনার মত এমন অপরূপার ইতিমধ্যে একজন প্রেমিক নেই, এটাই বা এক্সপেক্ট করছি কি করে? না, করছি না। আই অ্যাম জাস্ট ট্রাইং টু বি অনেস্ট।
এনিওয়ে, দ্যা বটম লাইন ইজ, এই মুহূর্তে আমি নিজের পায়ে বড়সড় একটা কুড়াল মারতে যাচ্ছি। পা কাটবে, নিশ্চিত। তবে দীপা উইল বি সেফ। পরের স্টেপ কি হবে, আমি এখনও জানি না।
দীপা আসছে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে। বাট, নো হার্ট বিট। ফোনে ওকে একটাই ইন্সট্রাকশান দিয়েছিলাম। একা। হয়তো ও একাই আসত। তারপরও বলে দিয়েছিলাম, কারণ রিস্ক নিতে চাইনি। প্রথম কারণ, কথাগুলো একাকী বলার মত কথা। আর দ্বিতীয় কারণ, রিয়াকশান। কান্নাকাটি, ‘হোয়াট?’ টাইপ মেলোড্রামা, অনেক কিছুই হতে পারে। তাই... নো থার্ড পারসন।
দীপা এগিয়ে এসে আমার সামনের সিটে বসল। মুখে স্মাইল।
--কি ব্যাপার?
দীপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। রিহার্সেল করা আছে। কি বলব, ঠিক করে এসেছি। তারপরও শুরু করতে পারছি না। ঠিক হেজিটেশান না। আসলে ঠিক করে উঠতে পারছি না, কথাটা হার্সলি বলব? না সফটলি? ‘দেখো, কষ্ট পেয়ো না, আমাকে ভুল বুঝো না’ টাইপ অ্যাপ্রোচ হবে? একটু প্রিপেয়ার করে নিয়ে তারপরে বলব? না...?
এসব নিয়েও গতরাতে ভেবেছি। আমি সরাসরি অ্যাপ্রোচের পক্ষে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে লাভ কি? ইম্প্যাক্ট তো সেই একই হবে। ওর মনে ভয়ানক একটা ধাক্কা লাগবে। সেটা আস্তে দিই আর জোরে দিই। কষ্টের কি এমন কমবেশি হবে?
--কি হল? কিছু বলছ না যে?
দীপার দিকে তাকালাম। ঠোঁটে সুন্দর একটা হাসি টেনে বললাম
--তোমাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।
মনে হল কথাটা বিশ্বাস করল। কিছুটা ব্লাশও হয়ত করল। তবে মুখে অন্য কথা বলল
--অন্য সময় লাগে না?
নাহ, এসব গপ্প কন্টিনিউ করার কোন মানে হয় না। একটা ভুল আইডিয়া জেনারেট হচ্ছে। পরিবেশ রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে। আই স্যুড বি অ্যা লিটল হার্স। স্যুড টক স্ট্রেইট। গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বললাম
--তোমাকে আসলে অন্য একটা কারণে ডেকেছি।
দীপার ভ্রু কুচকালো। পরিস্থিতিগুলো গতকাল রাতে যেমনটা ভেবে রেখেছিলাম, তেমনটাই ঘটছে। এরপরের প্ল্যান হচ্ছে দীপার হাত নিজের হাতে নেয়া। চোখের দিকে তাকানো। এরপরে শুধু একটা শব্দ বলা, ‘সরি’।
হাতটা এগিয়ে নিলাম। দীপার হাতে হাত রাখলাম। গতকালকে পড়িয়ে আসা আংটিটা এখনও ওর আঙ্গুলে। নিজের অজান্তেই সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম কিছুক্ষণ। বুঝতে পারছি দীপা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে দোখ তুললাম। ওর চোখে চোখ রাখলাম। গতকাল থেকে রিহার্স করা কথাটা বলতে যাব এমন সময় সামনে রাখা দীপার মোবাইলটা বেজে উঠল। স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে কলারের নামটা জ্বলে উঠল। লুবনা। টের পেলাম, হার্ট ইজ বিটিং।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:১৮