ভয়ংকর ঠগী (দ্বীতিয় পর্ব)
ভয়ংকর ঠগী (তৃতীয় পর্ব)
ভয়ংকর ঠগী (চতুর্থ পর্ব)
ঠগীদের দমন
এখনও ঠগিরা বেঁচে আছে ইতিহাসের পাতায় আর লোকমুখে। এদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন একজন ইংরেজ সেনা, নাম ‘ফিরিঙ্গি ঠগি , হেনরি শ্লীম্যান’! ১৮৩০-এর দশকে ভারতে প্রশাসক এসেছিলেন উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যান- ঠগী দমনে তার উৎসাহ আর একনিষ্ঠার ফলে যার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ঠগী শ্লীম্যান’ অথবা ‘ ফিরিঙ্গি ঠগি’।
১৮২২ সালে উইলিয়াম শ্লীম্যান বেঙ্গল আর্মির অফিসার ছিলেন। পরে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন; তাকেই গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক শ্বাসরুদ্ধকারী ঠগীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন। চারটি ভারতীয় ভাষা জানা শ্লীম্যান অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যাক্তি ছিলেন।
উইলিয়াম শ্লীম্যানই সর্বপ্রথম ঠগীদের কার্যপ্রনালী সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেন। তিনি জানতেন ঠগীদের দমন করা সহজ না। কেননা, অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদেও থেকে ঠগীদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল তারা। উইলিয়াম শ্লীম্যান গুপ্তচর নিয়োগ করেন, গঠন করেন পুলিশ ফোর্স।বিশেষ ট্রাইবুনাল ও দ্রুত বিচার আদালত গঠন করেন। এরই পাশাপাশি শ্লীম্যান ঠগীদের অপরাধস্থল সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করে মানচিত্র তৈরি করেন এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করেন; যার ফলে তিনি পরবর্তী গনহত্যার সময়কাল আঁচ করতে সক্ষম হন। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান।
এভাবে ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে ৩, ৭০০ ঠগী ধরা পড়ে। ঠগীদের জিজ্ঞাসাবাদের ফলে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন মাত্র ২০ জনের দল ৫,২০০ পথযাত্রীকে হত্যা করেছে । এদের মধ্যে এক ঠগী সর্দার বেহরাম ; সে ১৭৯০ থেকে ১৮৩০ সাল এর মধ্যে প্রায় ১২০০ টি খুন করে! তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এর জন্য তার অনুশোচনা হয় কি না? উত্তরে বেহরাম নির্বিকার কন্ঠে বলেছিল, ব্যবসার জন্য কারা আক্ষেপ করে! সেসময় ৫০০ জনের মত ঠগীর ফাঁসি হয়, বাকিদের দ্বীপান্তর অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ফাঁসীকাষ্ঠে ঠগীরা ছিল অভিব্যাক্তিশূন্য । বরং তারা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর আবেদন করে, যে ভাবে তারা নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করত!
ঠগীদের দীর্ঘ বিচারপর্বে উঠে এল অনেক কাহিনী, যাতে স্তম্ভিত হল সভ্য সমাজ। ঠগীদের জবানবিন্দ থেকে খুনের একটা সাম্ভাব্য হিসাবও পাওয়া গেল। ১৯৩৩ সালে শ্লীম্যানের নাতি জেমস শ্লীম্যানের লেখা থেকে জানা যায়, একজন ঠগী গড়ে মাসে ৮-১০ জনকে খুন করত। ২০ বছর ধরে সে যদি এই কাজ করে যায় আর এই সংখ্যাকে ভারতে ঠগীর সংখ্যা দিয়ে গুণ করা হয়, তা হলে সংখ্যাটা কম করেও বিশ থেকে তিরিশ লক্ষ হতে পারে। ১৮৪০ দশকে ঠগীদের বিচারের পর ঠগীদের কথা আর খুব বেশী শোনা যায়নি।
এরপর ঠগিদের স্থান হয় গল্প উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে। হলিউডি মুভি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দি টেমপল অভ ডুমস’ এ ঠগীদের দেখানো হয়েছে। সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ এ ছবিতে অভিনেতা বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা অমরেশপুরী কালীউপাসক ঠগী চরিত্রে অভিনয় করে প্রসংশা কুড়িয়েছেন। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের গোঁসাইপুর সরগরম ঊপন্যাসেও ঠগিদের ফাঁস লাগিয়ে হত্যাপদ্ধতি বর্ণিত আছে।
এখনও ভারতের রাজস্থানে ঠগীদের বংশধরদের দেখতে পাওয়া যায়- যদিও তারা এখন স্বাভাবিক মানুষদের মত জীবনযাপন করে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:৪৪