দ্বীতিয় পর্ব
ঠগীদের ছিল নিজস্ব ভাষা
বিভিন্ন এলাকায় ঠগিদের ছিল বিভিন্ন নাম। যেমন, জলের ঠগিদের নাম পাঙ্গু, নদী-নালার ঠগিদের নাম আবার ভাগিনা। কোথাও কোথাও এদের নাম ছিল,‘আরিতুলুকর’, কোথাও ‘তন্তাকালেরু’ কোথাও ‘ফাঁসুড়ে’ ইত্যাদি। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম থাকলেও এদের হত্যা করার পদ্বতি ছিল অভিন্ন। এদের মধ্যে কড়া নিয়ম ছিল কোথাও রক্তপাত করা চলবে না। ঠগিদের এলাকাও ভাগ করা থাকত। নেহায়েত দরকারে না পড়লে কেউ কারও সীমানা অতিক্রম করতো না। দরকার মতো এরা দলে সদস্যসংখ্যা কমাত কিংবা বাড়াত। শিকার ধরার সময় দরকার পড়লে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিত শত-শত মাইল। তিন চারটি দলে ভাগ হয়ে এরা শিকার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যে কোনও সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতো নিজস্ব সাংকেতিক ভাষাও ছিল ঠগীদের। তাদের ভাষার নাম ছিল ‘রামসি’। নানারকম সংকেতও ব্যবহার করতো তারা। ঠগীদের গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই ভাষা বা সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।
ঠগিদের দলের আগে আগে চলত ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাব জমানো ছিল তাদের কাজ। ইতিমধ্যে দলের খানিকটা পিছনে চলতে শুরু করবে ‘তিলহাই’রা। গুপ্তচর ও পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখত তারা। ‘নিসার’ বা নিরাপদ জায়গা দেখে তাবু গাড়া হত। খাবার পর বাসন মাজার অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। কিন্তু, ‘বিয়াল’ বা কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানত সময় এগিয়ে আসছে। এবার ‘ঝিরনী’ উঠবে অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হল ‘তামাকু লাও’। এক লহমায় ফাঁস জড়াবে শিকারের গলায়। ‘চামোচি’ ধরে থাকবে শিকারকে। ‘চুমোসিয়া’ তার হাত আটকে রাখবে, যাতে সে বাধা দিতে না পারে। ‘চুমিয়া’ তার পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে।
তারপর ‘ভোজারা’ দেহগুলোকে নিয়ে যাবে কবরে। ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হল দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ যাতে ফুলে উঠে কবর থেকে বেরিয়ে না পড়ে। সাদা কাপড়ের ফালি নিয়ে পাহারায় থাকবে ‘ফুরকদেনা’। বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেবে এরাই। এরপর অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় জায়গাটা সাফসুতরো কওে ফেলবে ‘ফুরজানা’। এইরকম আরও কিছু ভাষার নমুনা হল, খৌর (ঠগির সাম্ভাব্য শিকার), বাজিত খান (কাজ শেষ), সোথাই (ভিনদেশী অচেনা পথিকদের বশ করা যার কাজ), তাইওয়া (পথিক দল) ইত্যাদি।
সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়াজালে ঠগিরা
সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসবে ঠগীদের অমৃতের ভোজ। আসলে ভোজ আর কিছুই নয়, গুড়ের ভোজ। কিন্তু তাদের সংস্কার ছিল, ‘এ গুড় মন্ত্রপূত প্রসাদ। যে একবার খাবে, সে ঠগী হয়ে যাবে।’
ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল অদ্ভুত। অতি সাধারণ, কিন্তু কী সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠবে অব্যর্থ মরণ ফাঁস। আর ফাঁসের আগে সেই ফাঁদ পাতার গল্প।
বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের প্রত্যেক সদস্যের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল। ঠগীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল, কিন্তু সবাই তারা কালীর নামে শিকারে রেরুত। তারা বিশ্বাস করত শিকার তারা বেছে নেয় না, শিকারকে নির্দিষ্ট করে তাদের কাছে উৎসর্গ করে পাঠিয়ে দিতেন কালী মা। তারা নিজেদের ঠগী ধর্ম পালন করত শুধু। তারা নিমিত্ত মাত্র। তাই হত্যা করার পরও তাদেও মনে কোনও পাপবোধ বা অনুসোচনা হত না। এই বিশ্বাস থেকেই শিকার ঘিরে এক বিশাল সংস্কারের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। কবর খোড়ার কোদাল, মৃতদেহকে কেটে ভাঁজ করার ছুরি, হলদে রুমাল সব কিছুকেই সুদীর্ঘ পদ্ধতি আর উপচারের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ, মন্ত্রপূত করে নেওয়া হত।
শিকারও চিনিয়ে দিতেন মা। ঠগীদের শুধু সেই ইঙ্গিতগুলো জানতে হত। হঠাৎ কা কা করে কোনও কাক যদি ডাল বদল করে, বুঝতে হবে মা অনুমতি দিয়েছেন। ডাইনের ডালে ঘুঘু থাকলে বা ডাহুক চোখে পড়লে শিকার সামনেই মিলবে। দিনে শিয়াল ডাকলে সে অঞ্চল ছেড়ে দেওয়াই ভাল! আর, রাতে ঘুঘু ডাকলে তো সমূহ বিপদ। সামনে দিয়ে খরগোশ পার হলেও অযাত্রা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:১৭