বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আর বিপদে যে এগিয়ে আসে সেই তো পরম বন্ধু। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা অনেককেই বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছি। আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম ভিনদেশী কিছু মমতাময় মানুষকে। সেইসব দরদী বন্ধুদের নামগুলো আজও আমাদের মনে পড়ে। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনেক আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংগঠন নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে দ্বিধা করেনি। ১৯৭১ এর সে ৯ মাসের পুরোটাই এমন অনেক অকৃত্রিম বন্ধু পেয়েছিলাম আমরা।
মানবতার পক্ষে একজন ; টেড কেনেডি
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে যখন গনহত্যার মহোৎসব চলছে, তখন একজন ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেট সদস্য জনপ্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন. এফ. কেনেডির কনিষ্ট ভ্রাতা টেড কেনেডি পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে আসতে চাইলেন, কিন্তু পাক সরকার তাকে এদেশে আসার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালো। অগত্যা তিনি এলেন পশ্চিম বাংলায়, ঘুরে ঘুরে দেখলেন শরনার্থী শিবিরগুলো। এভাবেই তিনি জানলেন কি মর্মন্তুদ মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী দীর্ঘ প্রতিবেদন সিনেটে উপস্থাপন করলেন এবং এই অমানবিক কর্মকান্ডে পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন দানের মার্কিন নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন।
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতায় তখন রিপাবলিকান পার্টি এবং দলের রিচার্ড নিক্সন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীদলীয় নেতা টেড কেনেডির প্রতিবাদে মার্কিন সরকারের নীতির কোন পরিবর্তন হলো না, কিন্তু সেই রিপোর্টটি মার্কিন জনগনের মাঝে বাংলাদেশের পে একটি অনুকূল মনোভাব নিশ্চিতভাবেই তৈরি করেছিল। অতিসাম্প্রতিক ইরাক পরিস্থিতির মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে মার্কিন সরকার এবং মার্কিন জনগনের মনোভাব তখনও ছিল বিপরীতমূখী। হয়তো জনগনের মনোভাব বাংলাদেশের অনুকূলে থাকার কারনেই সে যুদ্ধে সরাসরি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধে নামতে পারেনি মার্কিন সেনারা।
পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বহু স্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। জনগনের মাঝে তখন মার্কিন বিরোধী মনোভাব অত্যন্ত প্রবল, কিন্তু একজন মার্কিন নাগরিক হয়েও তিনি পেয়েছিলেন জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত প্রানঢালা সংবর্ধনা। বিদেশী অতিথী হিসেবে তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন।
এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র নতুন জন্ম নেয়া এ শিশু রাষ্ট্রটিকে স্বীকার করে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা অবস্থান নেয় পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সে অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
একাত্তরের পরও বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে সব সময় তিনি বাংলাদেশের অনুকূলে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের এ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের পর পর সাতবার নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। তিনি নিহত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও নিহত এটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির ভাই। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব। ২০০৮ সালের মে মাসে তার ব্রেন ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি তাঁর কর্মযজ্ঞ। অহর্নিশ তিনি দুর্গত মানুষের জন্য কাজ করেছেন দেশে দেশে। যেভাবে বাংলাদেশের বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেভাবে কাজ করেছেন ইথিওপিয়াসহ বিশ্বের অনেক বিপন্ন জনপদে। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর জনমানুষের এই বন্ধু ২০০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
টাইম ম্যাগাজিন ২০০৬ সালে আমেরিকার যে ১০ জন শ্রেষ্ঠ সিনেটরের নাম ঘোষণা করে তার মধ্যে এডওয়ার্ড কেনেডি অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের নারী, পুরুষ ও শিশুদের জীবনমানের ওপর প্রভাব পড়েছে এমন বহু আইন প্রণয়নে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
পর্ব - ১
পর্ব - ২
পর্ব - ৩
পর্ব - ৪ পর্ব - ৫