বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আর বিপদে যে এগিয়ে আসে সেই তো পরম বন্ধু। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা অনেককেই বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছি। আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম ভিনদেশী কিছু মমতাময় মানুষকে। সেইসব দরদী বন্ধুদের নামগুলো আজও আমাদের মনে পড়ে। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনেক আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংগঠন নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে দ্বিধা করেনি। ১৯৭১ এর সে ৯ মাসের পুরোটাই এমন অনেক অকৃত্রিম বন্ধু পেয়েছিলাম আমরা।
তথ্যচিত্রে মুক্তির কথা
শিশুর লাশ নিয়ে কুকুর আর শকুনের কাড়াকাড়ি, সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নীরিহ জনগণকে হত্যা, শতবর্ষী বৃদ্ধার গড়িয়ে-গড়িয়ে সীমান্তের ওপারের নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে কান্তিহীন চলা, গুলিবিদ্ধ লাশের স্তূপ, মানবেতর শরণার্থী শিবির, পুড়িয়ে দেয়া ঘরবাড়ি, মাতৃভূমির মুক্তির জন্য গেরিলাদের শপথ, পতাকা ওড়ানো, গানবোটে গেরিলা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের দেশাত্ববোধক গান, জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত হাজারো মানুষ- এসব ১৯৭১-এর বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র। যা গাঁথা আছে সেলুলয়েডের রুপালি ফিতায়।
তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা'। এসব প্রামাণ্যচিত্রের বেশিরভাগই সরাসরি যুদ্ধত্রে থেকে শুটিং করা। কিছু নির্মিত হয়েছে নিউজ রিল থেকে। মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ধারণ করা ফুটেজ সংগ্রহ করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন 'মুক্তির গান'। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এসব প্রামাণ্যচিত্র আসলে প্রামাণ্য দলিল।
পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় এসব প্রামাণ্যচিত্রে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল নিবেদিত প্রাণ সাংস্কৃতিক কর্মী শরনার্থী শিবির ও মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে, পুতুলনাচ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখতেন, শরনার্থীদের বুকে যোগাতেন সাহস। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও তাদের অবদান এক হিসেবে যে অতুলনীয় তা অনুধাবন করেছিলেন মার্কিন চিত্রপরিচালক লেয়ার লেভিন।
দু:সাহসী এই পরিচালক ক্যামেরা হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরেছেন " মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার" কর্মীদের সাথে সাথে, ধারণ করেছেন, সেলুলয়েডে লিখেছেন তাদের আরেক যুদ্ধের দিনলিপি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে প্রায় ২০ ঘন্টার ভিডিও করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরী করতে পারেননি।
দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরতি উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সাথে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে ছবিটি নির্মিত হয়।
আমেরিকান টিভি সাংবাদিক লেয়ার লেভিন একাত্তরের বেশ কিছু সময় ধরে চিত্রায়ণ করেছিলেন শরণার্থী শিবিরসহ এ দেশের মুক্তির চেতনাকে। তার ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয় ‘মুক্তির গান’। পরবর্তীতে সেইসব ফুটেজের অংশবিশেষ নিয়ে নির্মিত হয় "মুক্তির গান" এবং "মুক্তির কথা" নামক দুটি ডকুমেন্টারি সিনেমা। লেয়ার লেভিনের সংগৃহিত ফুটেজ এর উপর ভিত্তি করে মুক্তির গানের মাধ্যমে যা ঐতিহাসিক কারনেই ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র মুক্তির গান মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে।
পর্ব - ১
পর্ব - ২
পর্ব - ৩
পর্ব - ৪ পর্ব - ৫